শফি শণ্ডল

শফি শণ্ডল

কিছু ঘটনা

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : মে ২১, ২০১৮

জীবনে কিছু ঘটনা থাকে, যেগুলো ভোলা খুবই কঠিন। যারা ওই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে, তারাও কখনো ভোলে না।

ঘটনা ১: বিয়ের পর থেকে আমার শশুরকে দেখছি, উনি ওনার মেয়েকে একটা গানই শিখিয়ে যাচ্ছেন। ‘বলিও আমার গোলাপ বালা’। আজ ১৫-১৬ বছর হয়ে গেল, তবু গোলাপ বালাটা শেষ হলো না। যখনি দেশে যাই তখনি ডে ওয়ান থেকেই শুরু হয়ে যায়, বলিও আমার গোলাপ বালা। শুধু তাই নয়, এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় গিয়ে কাপড়টা কোনোরকমে খোলার পরপরই শুরু হয়, বলিও আমার গোলাপ বালা। এই বলিও আমার গোলাপ বালাটা একটা বিরাট জ্বালা হয়েছে আমার জন্য। কোনোদিন দেখলাম না যে, এক সিটিংয়ে পুরো গানটা একবারে গাইতে। সবসময় খেয়াল করেছি, গানটা শুরু হওয়ার পর ‘বলিও আমার গোলাপ বালা’ লাইনটা শেষ হওয়ার পরই শশুর মেয়েকে ধরে বসেন ‘হয় নাই’ বলে।

এভাবে শুরু হয়ে যায় বারবার একই লাইন গাওয়া। মনে মনে ভাবি, এই বলিও আমার গোলাপ বালার জ্বালা থেকে কবে বাঁচবো! মাঝে মাঝে এমনও হয় যে, ওনার মেয়ে শুরু করার ঠিক আগমুহূর্তে উনি বলে বসেন, হয় নাই। মেয়ে তখন বলে, সে কি! আমি তো শুরুই করি নাই। মেয়ের বাবা তখন বলেন, হবে না। শুরু করলেও হবে না। তুমি যেভাবে শুরু করতে গিয়েছিলে, সেভাবে গাইলে হবে না।

এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর। ১৬ বছরে একবারের জন্যও দেখলাম না যে, ‘বলিও আমার গোলাপ বালা’ গানটা একবারের জন্যও সম্পূর্ণ গাওয়া শেষ হয়েছে। এখন আমার প্যানিক হয়ে গিয়েছে, কাউকে ‘বলিও আমার গোলাপ বালা’ গাইতে দেখলেই মনে হয়, হয় নাই অথবা হবে না। কেন হয় নাই বা হবে না, তা আমি জানি না। তবে একটা জিনিস বুঝি যে, এই গান হওয়ার না।

ঘটনা ২: কয়দিন আগে একটা দাওয়াতে গেলাম। যাওয়ার সাথে সাথে গৃহকর্ত্রী আমার স্ত্রীকে বললেন, এত দেরি করে আসলে কেন? স্ত্রী বলল, অনুষ্ঠান কি শেষ? গৃহকর্ত্রীর জবাব, অ্যাপেটাইজার শেষ। স্ত্রী বলল, কোনও অসুবিধা নাই ভাবি।

আমরা লিভিং রুমে বসলাম। মিনিট দশেক পরে গৃহকর্ত্রী এসে লিভিং রুমে বসা সবাইকে বেজমেন্টে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানালেন। সবাই মিলে বেজমেন্টে রওনা দিলাম। বুঝলাম, নিশ্চয়ই গান বাজনার বিষয় আছে। গিয়ে দেখি, সারি সারি চেয়ার বসানো। প্রজেক্টর লাগানো। সামনের দেয়ালে স্ক্রিন লাগানো। ডান পাশের দেয়ালে টেলিভিশন লাগানো এবং প্রোজেক্টরের সাথে টেলিভিশন কানেক্টেড। সবাই বসলো চেয়ারে। আমাদের জায়গা হলো একেবারে শেষের লাইনে। যেখানে বসলাম, সেখান থেকে কোনোভাবেই বের হওয়া সম্ভব না কঞ্জাস্টেড জায়গা হওয়ার কারণে। ভীষণ চাপাচাপি। ছোট্ট একটা রুমের ভিতর পুরা গুলিস্তানের ছয় নম্বর বাসের মতো ভিড়।

ওয়েট করতে থাকলাম অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার জন্য। গৃহকর্ত্রী ল্যাপটপ ঘাটাঘাটি শুরু করলেন। ল্যাপটপ প্রোজেক্টরের সাথে লাগানো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ইউটিউবের মনোগ্রাম। আমি শুধু ভেবে যাচ্ছি, এখন আসলে কি হবে? কোনো মাইক্রোফোন দেখলাম না। গান তাহলে কিভাবে হবে? গান শুরু হয়ে গেল। তবে লাইভ না, ইউটিউবে। শিল্পী শফি মণ্ডল। ভাবলাম, গানটা দিয়ে অনুষ্ঠানটা শুরু করা হলো, এরপর নিশ্চয়ই লাইভ কিছু একটা শুরু হবে। শফি মণ্ডলের প্রথম গানটা শেষ হলো। আমরা অধীর আগ্রহে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হলো। শফি মণ্ডলের দ্বিতীয় গান ইউটিউবে। এভাবে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক শফি মণ্ডলের যাবতীয় গানসহ আরও কয়েকজনের গান ইউটিউবে শুনলাম, যা আমরা কোনোদিন ইউটিউবে শুনিনি বা দেখিনি বলে গৃহকর্ত্রীর ধারণা, অথবা ইউটিউব নামে যে একটা অ্যাপলিকেশন আছে, তা হয়তো আমরা জানি না। মনে হলো, সৌরজগতে এই প্রথম দেখলাম যেখানে দাওয়াত দেয়ার পর খাবার দেয়ার আগে জোরপূর্বক ইউটিউবে শফি মণ্ডলের গান শোনানো হয় দরজা বন্ধ করে দিয়ে।

একপর্যায়ে আমি বলে উঠলাম, ভাই আগে থেকে বলে দিলে বাসা থেকে শফি মণ্ডলের সব গানগুলি দেখে আসতে পারতাম। তাহলে কমন পড়তো।

লেখক: সঙ্গীতশিল্পী