গুমবিষয়ক কল্পকাহিনি

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৩, ২০১৮

শফিকুজ্জামান বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করেন। জঙ্গিবাদ নিয়ে বেশি লেখেন; গবেষণা করেন। এটাই তার জন্য কাল হয়েছে। তিনি কেন লিখবেন? জঙ্গিবাদ কেন তার প্রিয় বিষয়? নিশ্চয়ই তার কোনো সমস্যা আছে! সমস্যা না থাকলে কি আর এই সময় কেউ ওসব নিয়ে নাড়াচাড়া করে!
শফিকুজ্জামানের স্ত্রী আঞ্জুমানের কাছে আননোন নাম্বার থেকে একটি কল আসে। টেলিফোনে নাম-পরিচয় না দিয়ে জনৈক ভদ্রলোক তাকে জানান, আপনার স্বামী জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছেন। তাকে সাবধান করুন। তা না হলে কিন্তু তিনি বিপদে পড়বেন। কিডন্যাপও হয়ে যেতে পারেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এখন নানা গ্রুপ সক্রিয় আছে। যে কেউ তুলেও নিয়ে যেতে পারে।
টেলিফোন পেয়ে আঞ্জুমান অস্থির হয়ে ওঠেন। তিনি কী করবেন কিছুই বুঝতে পারেন না। বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলবেন কীনা, তা-ও বুঝতে পারছেন না। শ্বশুর-শাশুড়িকে জানালে তারা যদি ভুল বোঝেন! সেই ভয়ে তিনি তাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারছেন না। আবার তিনি স্বামীর কাছেও বলতে পারছেন না। যদি ভুল বোঝে!
আঞ্জুমানের অস্থিরতা দেখে শফিকুজ্জামান এর কারণ জানতে চান। তিনি বলেন, প্লিজ, আমাকে শেয়ার করো। এত অস্থিরতার কারণ কী?
নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর আঞ্জুমান বলেন, আমার কাছে একটা টেলিফোন এসেছে। জনৈক ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিতে রাজি হননি। তিনি জানালেন, তুমি নাকি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গেছ!
শফিকুজ্জামান বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, এসব তুমি কী বলছ? তুমি জানো না আমি কী ধরনের মেন্টালিটির মানুষ!
জানি। এরপরও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কারণ ওই লোক জানিয়েছেন, তুমি কিডন্যাপও হতে পারো!
সেকি! কিডন্যাপ কেন হব? জঙ্গিবাদ নিয়ে লেখালেখি করি মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য। তার মানে এই নয় যে, আমি জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী। পৃথিবীজুড়েই জঙ্গিবাদ একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যা নিয়ে বিশ্বের সব মিডিয়ায় লেখালেখি হচ্ছে। মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই কোনো অন্যায় নয়!
তা আমি বুঝি। কিন্তু লোকটা যে তোমাকে কিডন্যাপের কথা বললেন!
বলো কী!
সে জন্যই তো আমি দুশ্চিন্তা করছি।
আচ্ছা শোনো, থানায় চলো। বিষয়টা থানায় জানিয়ে রাখি।
ঠিক আছে চলো।
শফিকুজ্জামান ও আঞ্জুমান থানায় গেলেন। তারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করলেন। পরদিন সিএনজি অটোরিকশায় শফিকুজ্জামান ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিলেন। মহাখালী ফ্লাইওভারের কাছে যানজটের কারণে গাড়ি থেমে ছিল। এ সময় কয়েকজন যুবক তাকে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে একটি মাইক্রোবাসে তুলল। এরপর চোখ বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে গেল।
নিরিবিলি একটি জায়গায় বদ্ধ ঘরে আটকে রাখা হলো তাকে। ঘরে কোনো আলো নেই। দিনের আলোও ঘরে ঢোকে না। চারপাশে কোনো সাড়া-শব্দও পাওয়া যায় না। তিনবেলা কেউ একজন তাকে খাবার দিয়ে যায়। খাওয়ার পর থালাবাটি আবার নিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে দু-একজন লোক এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
টাকা-পয়সা কেমন আছে, জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কবে যুক্ত হয়েছেন? কেন যুক্ত হয়েছেন? জঙ্গিদের টাকা-পয়সা দেন কি না? সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড কিছু করেন কি না! মুক্তিপণ চাইলে কত টাকা দিতে পারবেন?
শফিকুজ্জামান খুব ভেবেচিন্তে জবাব দেন। তিনি মনে মনে বলেন, আমাকে কি মুক্তিপণ আদায়ের জন্য কিডন্যাপ করা হয়েছে? তাহলে তো আমার পরিবারের কাছে টেলিফোন করত। বলত, টাকা নিয়ে অমুক স্থানে আসেন। তা তো বলছে না। দু-একবার জানতে চেয়েছে, টাকা-পয়সা কেমন আছে?
শফিকুজ্জামান মনে মনে ভাবেন, আমার বাবা একজন চাকরিজীবী। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার স্ত্রী একটি এনজিওতে কাজ করেন। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। আমাদের কাছে আর কত টাকা থাকতে পারে! টাকার জন্য আমাকে কিডন্যাপ করেছে— এটা আমার বিশ্বাস হয় না। শুধু মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে। এই যন্ত্রণা দিয়ে ওদের কী লাভ?
শফিকুজ্জামান জানেন না, তাকে কত দিন আটকে রাখা হবে। নাকি তাকে মেরে ফেলা হবে! কয়েকজন তার সামনে আলোচনা করেছে। একজন মেরে ফেলার কথা বলেছে। আরেকজন বলল, না, মারা যাবে না। এটাই ওর সাজা। বদ্ধ ঘরের মধ্যে একাকী জীবন!
একদিন শফিকুজ্জামান সাহস করে বললেন, আমাকে কেন শুধু শুধু শাস্তি দিচ্ছেন? আমি তো কোনো কিছুর মধ্যে নেই। কোনো দিন ছিলামও না। কোথাও আড্ডা দিতেও যাই না। বাসা আর ইউনিভার্সিটি।
সঙ্গে সঙ্গে একজন ধমকের সুরে বলল, এই চুপ! তুমি কিছু করো না; তাই না? তলে তলে জঙ্গিদের নিয়ে কী পরিকল্পনা করো সেটা বলো! সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র! তুমি ভাবছ, আমরা কিছু জানি না! সব খোঁজখবর আমরা রাখি। সব কিছু জানি।
মিথ্যা কথা। এসবের মধ্যে আমি নেই। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনারা বোধ হয় ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আমাকে ধরেছেন। আরেকটু যাচাই করে দেখুন। শফিকুজ্জামান বললেন।
এ সময় অপহরণকারীদের একজন বলল, ছেড়ে দে। ও মনে হয় নিরীহ।
আরেকজন বলল, না না! মোটেই না।
একপর্যায়ে দুজনের ঝগড়া শুরু হলো। পরে সিদ্ধান্ত হলো, শফিকুজ্জামানকে ছেড়ে দেয়া হবে। পরে এক সন্ধ্যায় ওরা গাড়িতে করে এয়ারপোর্ট রোডে শফিকুজ্জামানকে চোখ বাঁধা অবস্থায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
শফিকুজ্জামান চোখের কাপড় খুললেন। অনেক দিন পর আলো দেখতে পেলেন তিনি। অনেকক্ষণ লাগল তার স্বাভাবিক হতে। তারপর তিনি সিএনজি অটোরিকশায় করে বাসার উদ্দেশে রওনা হলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই বাসায় পৌঁছলেন। তাকে পেয়ে মা-বাবা ও স্ত্রী যেন আকাশের চাঁদ পেলেন। তারা শুধু মনে মনে বললেন, হে আল্লাহ, এ রকম বিপদে যেন আমার শত্রুও না পড়ে!

লেখাটি আগে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল