গোসলের পুকুরসমূহ: বাংলাদেশের উপাখ্যান

জাফর জয়নাল

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৮

গত বইমেলায় মেহেদী উল্লাহর `জ্বাজ্জলিমান জুদা` পড়ার পর থেকে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম কখন তার নতুন বই পাব। অনুবাদক বন্ধু সিয়ামের কল্যাণে `গোসলের পুকুরসমূহ` হাতে পেলাম। অবশেষে ডুব দিলাম। পড়ে মুগ্ধ হলাম। অত্যন্ত সরল কিন্তু অর্থপূর্ণ বাক্য বিন্যাসে সাজানো এই উপন্যাস। লেখার ভেতর সরল, সরস, সংক্ষিপ্ত, স্পষ্ট, পরিমিত এবং সহজ বোধ্যতার চমৎকার সম্মিলন হয়েছে। ঔপন্যাসিক বর্তমান ও অতীতের মেলবন্ধনের ভেতর দিয়ে ইউটোপিয়া নির্মাণ করেছেন। পুরো উপন্যাস জুড়েই আছে স্বাপ্নিক যাত্রার ছোঁয়া। পুকুরকে উপলক্ষ করে গল্প এগিয়ে গেলেও এর মূল বিষয় ছিল প্রেম ও বাংলাদেশের কালচার। সংস্কৃতির নানা রূপ পপ কালচার, আধুনিক সংস্কৃতি এবং লোকসংস্কৃতি`র উপাদান ছিল উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়।

মোট ষোলটি অধ্যায় নিয়ে এ উপন্যাস। প্রতিটি অধ্যায়ের রয়েছে আলাদা আলাদা শিরোনাম। যেমন, গোসলের পুকুরসমূহ, বিবাহ স্বপ্নের কনে, সর্পবংশের শেষদিন, দাগ, মনসামঙ্গল, কোন পরান বিদ্যাশ হইলায়, মেডেন/মেডেনবিহীন, এতিমখানার ইলম, মাতাই পূখিরী।

গোসলের পুকুরসমূহের সবচেয়ে অদ্ভুত ও রহস্য আবৃত চরিত্র হলো আলমাস। আলমাস যেন বাংলাদেশের কোনো একজন ভগ্ন বুদ্ধিজীবীর ছায়া। যার হৃদয়ে দেশ বিভাগের গাঢ় বেদনা। তাকে ঘিরে নানা গুজব ছড়িয়ে আছে, তারই সমাজের মানুষের কাছে। মেহেদী উল্লাহ তাকে নান্দনিক উপায়ে নিয়ে এসেছেন: কে দ্যাশে, কে বিদ্যাশে এসব নিয়াও তাহার কোনো মাথাব্যথা নাই। কাকে বলে `দ্যাশের মায়া তাহাও কোনো দিন জানিবে না সে। কারো নাম লইয়া কান্দার সময় নাই তার।

উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি লাইন:
১. এককালে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ তাদের ঠিকানা জানিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। আজ এতবছর পর বিশ্ববাসী যদি প্রেরকের দেয়া সেই `পদ্মা মেঘনা যমুনা`র ঠিকানায় চিঠি লেখে তবে কি তা পৌঁছাবে?
২. এদেশের কতজন অনর্থক কত কী করে ন্যায় ছাড়া, বিবেক ছাড়া, হিসাব ছাড়া, বিচার ছাড়া। আলমাস না-হয় এট্টু আগুনই জ্বালায়।
৩. এই অঞ্চলের মুসলমান এখনও এতটা অন্ধ আর রক্ষণশীল হয়ে যায়নি যে, কাল থেকে তারা বলবে, পদ্মায় আর গোসল করব না। পদ্মা `হিন্দুর দেশের গঙ্গা।
৪. ছোটবেলায় মসজিদের সামনের জুতোগুলো দেখিয়ে সে একদিন বলেছিল, সাইজ অসমান হলেও এগুলো সমান মানুষদের জুতো।
৫. সে দুঃখ করে বলে, বন্ধু কণ্ঠটা সোন্দর না বলে মুয়াজ্জিনের চাকরিটাও গতবছর গেল।
৬, শরবতে দ্রবীভূত চিনির মতো সে নিজেকে সবসময় অদৃশ্য রাখতে পছন্দ করে। একটা মায়াবী নৈঃশব্দ্যের ঘোমটা পরে থাকে।
৭. সে কি সেদিন ভাবতে পেরেছিল, পৃথিবীতে খেলা চার প্রকারের। জলের, স্থলের, অন্তরীক্ষের। আর? আর মানুষের মনের।

আমার কথার চেয়ে ভালো হয়, এই উপন্যাস পড়ুন এবং নিজের ব্যক্তিগত পুকুরের সাথে মেলান। যে পুকুর সময়ের আর স্মৃতির সাক্ষী। উপন্যাসের কথক অতীত জীবনে প্রেমিকা আর বর্তমান জীবনে সন্তান জলধিকে হারানোর গল্প বলে। কথক পেশায় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার আইডিয়াবিদ (নতুন ধারণা নির্মাতা)। প্রতিটি পুকুরের কাছে গিয়ে সে ছবি তুলে আনে এবং সেই ছবি তাকে স্মৃতি এবং সন্তান জলধির কাছে নিয়ে যায়।
উপন্যাস জুড়ে অসংখ্য চরিত্রের আনাগোনা। ফারিয়া, দিশা, লিজা, লায়লা, হামজা মিয়া, আয়নাবুড়ি, খাদিজা, মঞ্জুর, মঞ্জুরি, মোস্তফা, মালতী, আলমাস, জুলকারনাইন, আবু সুফিয়ান এসবের মধ্যে অন্যতম চরিত্র। এই উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রতি আমাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বাঁক পরিবর্তন ঘটানো। এ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিষয় বৈচিত্র্যে নতুন দিগন্ত আনতে সাহায্য করবে বলে আমার মনে হয়েছে।

একুশে বইমেলা ২০১৮