জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা: একটি আলোচনা

শেষ পর্ব

জ্যোতির্ময় মুখার্জি

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২১, ২০১৯

হাংরি একটা কামড়  দিতে পেড়েছিল সেই পচাগলা মাংসে। হাংরি আন্দোলনে আন্ডারগ্রাউন্ড বা চোরাগোপ্তা পথের কোনো স্থান ছিল না। যুদ্ধটা সামনাসামনি। আর ক্ষমতার উৎস বন্দুকের নল নয়, কলম-তুলি। যা মুখোশ খোলে, রক্ত খায় না। ‘ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে দেখল জঙ্গিলা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের গুপ্ত গুলছররা চলছে।’….নকশাল আন্দোলন ছিল অপরদিকে  চোরাপথে গেরিলা কায়দায় আঘাত হানা, এখন মাওবাদীরা জঙ্গলে লুকিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়াস করছেন, ভারতের জাতিপ্রথার কোনো বিশ্লেষণ তারা করেন না। গল্পকার যে এই চোরাগোপ্তা পথে মানুষখুনের আন্দোলনগুলিকে ভালোভাবে নেননি তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই গল্প থেকে। ‘সবাই ইংরেজিতে কথা বলছিল, তর্কাতর্কি করছিল, চাপানউতর করছিল; মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা।’ মার্কসবাদকে সামনে রেখে দেশে দেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে সবচেয়ে ভুল ছিল, আঞ্চলিক বা নিজস্ব সমস্যাকে বিচার বা বিশ্লেষণ না করে সবকিছুকেই মার্কসবাদের আলোকে ফেলা। অর্থাৎ এখানেও যেন সেই ধর্মের মতো গোঁড়ামি। নিজস্ব চিন্তাভাবনা নয়, নিজের সমাজকে চিনে বিচার বিশ্লেষণ নয়, ধর্মগ্রন্থের মতো একটি বইয়ের কথাগুলিকে চিরসত্যন ধরে তা প্রশ্নহীন আনুগত্যে পালন করে যাওয়া। ‘মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা’-র মধ্য দিয়ে গল্পকার যেন এটাই বোঝাতে চাইলেন যে, কীভাবে আন্দোলনকারীরা নিজেদের ভারতীয় আইডেন্টিটি ভুলে গিয়ে, নিজেদের চিন্তাভাবনার পরিসরটাকে শূন্য করে ক্রমাগত কপচে যায় মুখস্থ করা বুলি। আর অ্যাকশন্ ঠিক সেই আদি অকৃত্রিম পথেই। নিজস্ব পথ আবিষ্কারের কোনো চেষ্টা নেই।

‘একের পর এক দিগগজ নেতার তরল সান্দ্র গভীর সংঘাতী তঞ্চিত খামিরি মাতানো ধূমিত রসাল ভারিক লঘু চোহেল আবিল সতেজ শুটকো আধসেদ্ধ বিদগ্ধ বক্তৃতা শুনতে-শুনতে জঙ্গিলা-জীবন আর জীবনদর্শন সম্পর্কে খটকা লাগল শিলাদের। বিস্ফোরক বানানো, সেটাকে যার মাথায় ইচ্ছা ফাটানো, আর যার মাথায় ফাটানো হচ্ছে তাকে জঙ্গিলা শত্রু ঘোষণা করা, এইই মনে হচ্ছে মোদ্দা কথা।’ এইভাবেই তিনি সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলনগুলিকে সন্ত্রাসবাদের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সাধারণ মানুষ মেরে আর যাইহোক সমাজের ভালো কিছু হয় না। যা মানবিক নয়, যা ধ্বংস করে মানবিকতাকে তাকে সরকারি সন্ত্রাসবাদ বলতে তিনি দ্বিধাহীন। কোনো আদর্শের মোড়কেই এই মানুষ হত্যারকে তিনি জাস্টিফাই করতে চান না। শ্রীকৃষ্ণের হাত দিয়ে শুরু হয়েছিল যে যাত্রা, যুদ্ধের সাথে হত্যার সাথে ধর্মকে সরাসরি মিলিয়ে দেওয়া, তার ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে আজও। আসলে রক্তে হাত ভেজানোটাই আসল। আদর্শ, মতবাদ,  জাস্ট আই-ওয়াশ, ঝুলিয়ে রাখা কেতাবি ধুলো। ‘আমি তো হতে চেয়েছিলুম সমাজবদলকারী; হয়ে গেলুম সেলাম-গ্রহণকারী উড়োনছু কংকাল, ওই সব জঙ্গিলাগুলোর জন্যেই। কত ভাল-ভাল কথা শুনিয়ে জনগণকে বোকা বানিয়ে আমায় করে ফেললে উড়োনছু কংকাল আর নিজেরা দিব্বি আমোদ-প্রোমোদ নিয়ে মজা করে চালালে।’ ব্যাপারটি যেন পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পটচিত্র।

সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ রক্তপায়ী। রক্ত পান করার সুযোগ তাকে ছলে বলে কৌশলে আবিষ্কার করে নিতেই হয়। সন্ত্রাসীদের দ্বিচারিতাও ধরা পড়েছে শিলাদের কথায়, স্পষ্টভাবেই, ‘জঙ্গিলা জীবনের কত কি জানত না শিলাদ। নানা রঙ্গিলার দেশে গিয়ে তাদের পয়সায় ডেঁড়েমুশে খেয়ে মৌজ করা, আর সেখানে লুকিয়ে থাকা যে জঙ্গিলার উদ্দেশ্য তা জানত না। ভ্যাবাচাকা গিলে-গিলে খেতে লাগল শিলাদ।’ বহু লেখক ও কবি একসময়ে সোভিয়েত দেশে যেতেন, ছেলেমেয়েদের পাঠাতেন আনন্দ করার জন্য। তাদের মুখোশ খুলতে, তাদের নগ্ন করতে, মহান আদর্শের ফাঁকা বুলি ঝেড়ে, আন্ডারগ্রাউন্ডে ঘটে চলা প্রকৃত সত্যকে তিনি আমাদের চোখের সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। ‘অধৈর্য হবেন না সাথী; অ্যানোলসাথী এবার চরস গাঁজা আফিম কোকেন হেরোইন বিক্রির টাকা ডলার পাউন্ড ইয়েন রিয়াল রুবল লিরা দিরহাম ফ্রাঁ মার্ক আমাদের বিলি করবেন।…….হ্যাঁ সাথী, তা না হলে আর্ডিএক্স মর্টার বাজুকা রকেট রাইফেল গ্রেনেড ডিটোনেটর কিনবেন কী করে? খালি হাতে কজনকেই বা মারবেন? আর চোখ কান বুজে মারতেই যদি না পারলেন তাহলে জীবনের উদ্দেশ্য কী করে পুরো হবে?….শুনে, দমে গেল, মুষড়ে পড়ল শিলাদ, হতাশ, মনোহত। জঙ্গিলা মানে কি মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা, মারা, মরা? ধুসশালা।’…..এই প্রশ্নের উত্তর আজও আমরা খুঁজে পাইনি। হয়তো পাবোও না কোনদিন। ধুসশালা।

বিশ্বজুড়ে বাড়বাড়ন্ত সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, বালক-কিশোর সন্ত্রাসবাদী। শৈশবকে জাস্ট খুন করে তাদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে অস্ত্র। কখনোবা তারা মানববোমা। বালক হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই অনেক সময় সন্দেহের বাইরে থাকে তারা। এই সুযোগটাই বারবার নিয়ে চলেছে সন্ত্রাসের সর্বাধিনায়কেরা। আবার অনেক সময় শিশু চুরি করে এনে ছোট থেকেই ব্রেন ওয়াশ করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে হার্ডকোর টেররিস্ট রূপে। আদিম যোদ্ধাগোষ্ঠীগুলোতেও ছিল এই একই প্রক্রিয়া। তা সে চেঙ্গিজের বা আত্তিলার সেনা, নিনজা হোক বা স্পার্টান। বর্তমানের কদর্যতম রূপ এটাই যে বালিকা ও কিশোরীদের অপহরণ করা হচ্ছে সন্ত্রাসীবাদীদের যৌনদাসী হিসাবে ব্য বহার করায় জন্যে। ‘আমরা রঙ্গিলা ডিম চুরি করে এনে জন্মের আগে থেকে জঙ্গিলা বানাই। জঙ্গিলা গোষ্ঠীর রঙ অনুযায়ী সেই মতাদর্শের আরকে চোবাই। ডিম ফুটে বেরোলেই ওদের ইনডকট্রিনেট করে জীবন্ত অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে শত্রু নিধনে পাঠানো হয়।’

‘রঙ্গিলা জীবনে ল্যাজ নিয়ে করবিটা কী? কাউকে কায়দামাফিক সেলাম ঠুকতে হয় না। তোদের তো হেঁ হেঁ করলি, হাত কচলালি, ব্যাস, সেলাম হয়ে গেল।’…..সন্ত্রাসীদের নগ্ন ছবি আঁকতে আঁকতে মেরুদন্ডহীন দুধে ভাতে বাঙালিকে কি খোঁটা দিয়ে গেলেন গল্পকার?

‘আপনি ভুল করছেন। জঙ্গিলা আমি স্বেচ্ছায় হয়েছি। কেউ আমায় ভুল বুঝিয়ে, ফুসলিয়ে, লোভ দেখিয়ে, কেতাব পড়িয়ে বা বাড়ি থেকে চুরি করে এনে জঙ্গিলা বানায়নি।’….স্বেচ্ছায় যে কেউ সন্ত্রাসবাদী হয় না, তার পিছনে যে থাকে নেতারা, এই নির্জলা সত্য টাকে তুলে ধরতে কসুর করেননি গল্পকার। মহাভারতের  সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অর্জুন’ও নাকি তাঁর অস্ত্র নামিয়ে নিয়েছিলেন । তারপর তাঁর রথের উপর উপবিষ্ট সর্বাধিনায়কের ব্রেন ওয়াশের পর সে নির্দ্ধিধায় লেগে যায় মারো মারো আর মারোর রক্তপানে। ফর্ গডস্ সেক্, হোল্ড ইয়োর বো এন্ড কিল্ দ্যা এনিমি। এনিমি? শত্রু? কে শত্রু? তুমি যাকে মারবে সেই তোমার শত্রু। যে অপর, সেই তোমার শত্রু। বিরুদ্ধ মত ও পথ বলে পৃথিবীতে কিছু হয় না। হয় ‘আমরা’ নয় ‘ওরা’। আবার সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে বিভাজনটাও কিন্তু খুব স্পষ্ট। সবাই ফ্রন্টে গিয়ে গুলি খাওয়ার রিস্ক নেয় না। তাদের জীবন যে ভীষণ ‘দামি’। তাই কেউ কেউ মারে ও মরে আর কারো কারো হাতে রথের দড়ি। ‘ওইটুকু জঙ্গিলা জীবনে ও দেখেছিল তাদের মধ্যে খয়রাতি জঙ্গিলা আর ভিখিরি জঙ্গিলার মাঝে বর্ণভেদ রয়েছে, তেমনই আছে বড়লোক জঙ্গিলা আর ছোটলোক জঙ্গিলার মাঝে, ডলার জঙ্গিলার সঙ্গে টাকা জঙ্গিলার, শাস্ত্রজ্ঞের সঙ্গে আনপঢ়ের, আস্তিকের সঙ্গে না-আস্তিকের, গোরার সঙ্গে কালার, বলিতে পাঠাও আর বলিদান দাও জঙ্গিলার মাঝে, বস্তিছাপ আর এয়ারকান্ডিশান জঙ্গিলার মাঝে।’ বিপ্লবের রোমান্টিসিজম্ এইভাবেই শুষে নিয়ে গল্পকার, কদর্য সত্যনটাকে তুলে ধরেছেন। ‘জঙ্গিলাজীবন আর আগেকার কালের হিরো-জীবনের মতন রোমান্টিক নেই; এখন সবাই ধান্দাবাজ।’

শুধু সমাজ-বদলকারীদের নয়,  সুখী সামাজিক মানুষদের শ্রেণিবিভাজন’টাও তিনি ধরেছেন  নিপুণভাবে। ‘রয়েছে যবাক্ষারজান জলের নিচড়া বর্গ, রোদবৃষ্টিমাখা জলের উচড়া বর্গের সঙ্গে মাঝামাঝি জলের নিচড়া বর্গ। অতি নিচড়া বর্গের গায়ে আঁশ নেই চোয়াল নেই ডানা নেই, তলানি খায়। নিচড়া বর্গের গায়ে হাড় নেই, সবই কার্টিলেজ, কানকোর জায়গায় খড়খড়ি; জলের বেসমেন্টে নামলে চোখের তলায় গর্ত দিয়ে শ্বাস নেয়। আর উচড়া বর্গ তো রোদের পাউডার চাঁদের ক্রিম আর শিশিরের পারফিউম মেখে চোপরদিন গোমরে ঝিকিমিকি।’ এই বিভাজনকে বৈচিত্র্য মেনে মানুষ’ও বেশ খুশি। তাই  সুখী খুশি কানে যদি কেউ নতুন কিছু শোনাতে যায় শোনে না, ভাবতেও চায় না, শুনতেও। ‘রঙিন কাউকে দেখলেই ওদের পোঁদে হিং জমে’। চিরদিনই নতুন কিছু যাঁরা জানাতে চেয়েছেন মানুষকে, তাঁদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘রঙিন বলে ওই সব বর্গের মাছেরা কেউই শিলাদকে নিজেদের লোক বলে মনে করে না, অথচ খুব হিংসে করে।’

এই অরূপকথনে সাম্রাজ্যবাদীশক্তির দাদাগিরিকেও তিনি শিলাদের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘এই বোটকা মালটা কোত্থেকে এল রে সুনন্দা, আমেরিকা না ইজরায়েল? সেই বুড়ো বাঘটার এলাকা গায়ের জোরে জবরদখল করে বসে আছে।’ হয়তো উপনিবেশের রঙ পাল্টে গেছে, ‘নিজেকে আলেকজান্ডার কিংবা দারিয়ুস ভাবছে, মুতে-মুতে জবরদখল আর পাকাপাকি রাজ্যপাট, হাঃ হাঃ হাঃ…’ এখন লক্ষ্য অর্থনৈতিক উপনিবেশ স্থাপন। কিন্তু তার এফেক্ট একই। অসংখ্য হাড়জিরজিরে মানুষের লাশের উপর গুটিকয় নাদুসনুদুস মানুষের ভুড়ি ভুড়ি ভুরিভোজ। ‘দ্যাখে কি, গির্গিটবোমা অ্যানোলের পচাগলা লাশের মোরব্বা চেখে-চেখে খাচ্ছে মার্কিন কানিমাগুর আর ব্রিটিশ পাঁকাল।’

পশ্চিমবঙ্গের পুঁথিনির্ভর শিক্ষকমুখী শিক্ষাব্যবস্থার হাল যে কতখানি করুণ তা আর নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। এটা যেন ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে, সবাই মানে তবু হরিদাসের গোয়াল খালি থাকে না। উপায়ও নেই। যেন তেন প্রকারেণ চাই ডিগ্রি, পরীক্ষায় পাশ করাটাই সাফল্যের খতিয়ান। শিক্ষা? সেটা আবার কী স্যার? ‘শিমুল-পলাশের ডালে-ডালে ঠাকুরাল-বাঁদর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছাত্র পড়ানো দেখছিল শিলাদ। প্রগতিশীল বাঁদর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেশ হোঁতকা-হোঁতকি রাঙা পোঁদা রাঙামুখো। কারোর চতুর্থ হাতে বিপত্তারিণির হর্তুকি, কারোর তৃতীয় হাতে জয় বজরংবলির মাদুলি, কারোর দ্বিতীয় হাতে রুপোর চেনে মাকলা-বাঁশের শেকড় বাঁধা। ছাত্র-ছাত্রীরা রোগা টিংটিঙে।’….শিক্ষকরা নিজেরাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আর তারাই দেয় বিজ্ঞানের শিক্ষা। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া ছেলেমেয়েরা আসে ফ্রি স্কুলে শিক্ষা নিতে। বাড়িতে ঠিকঠাক খেতেও পায় না। অপুষ্টি শরীরে ও মনে, আর তারাই মুখস্থ করে বাড়ি ফেরে ভিটামিন কাহারে কয়। এই দূরাবস্থা থেকে আজ আশার আলো স্কুলে-স্কুলে মিড-ডে মিল প্রকল্প। এই গল্পটি যখন লেখা হচ্ছে তখন মিড-ডে মিল চালু হয়নি। তাই গল্পকারের তর্জনী নিক্ষেপ সফল। অবশ্য শুধু সরকারি ফ্রি স্কুল নয়, ঝাঁ চকচকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষাব্যপবস্থাও যে খুব ভালো এমনও নয়। সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যকবস্থার মূল লক্ষ্যই হলো নাম্বার, আরো নাম্বার, আরো আরো নাম্বার। নো ইনোভেশন ওনলি মুখস্থং নোটং।

‘একজন টিচার বেশ ঠাটি, ফুটেক ল্যাজের ছড়ি উঁচিয়ে, মগডাল থেকে তাক-তিড়িং-তুং লাফ মেরে ক্লাসে নামল, তারপর, হেঁচকা মেরে, এক মাওরা ছাত্রীকে চামড়াসুদ্ধ এক-খাবলা লোম তুলে নিয়ে যেতে, বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকারা পেছনের দুহাতে তালি বাজিয়ে বাহবা দিল। এরপর এক ধিঙ্গিনাচন শিক্ষিকা, পলাশের কাঁটাদার জিঙ্গলকাঠি ভেঙে তিন হাত দিয়ে এক কচি ছাত্রকে দমাদম উত্তম-মধ্যম দিতে, সে আধমরা হয়ে গাছের নমনা আঁকড়ে ঝুলতে লাগল।’…….শিক্ষার অধিকার আইনে আজ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক ন্যূরনতম নির্যাতন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আজও শিক্ষার্থীরা একইরকম শারীরিক ও মানসিক আঘাতের শিকার হয়ে চলেছে প্রতি মুহুর্তে।

‘শিলাদ তরফদার নিজেকে বোঝাল, ভাগ্যিস ও মানবজীবন চায়নি বা পায়নি। সেক্ষেত্রে ছাত্র আর শিক্ষক দুটো স্তরের রাঙাপোঁদা রাঙামুখো পর্ব পেরোতে হতো। শিক্ষকরা তো মানব গড়ার কারিগর।’ তবে আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, এই ব্যাাপারটা এখন অনেক কমেছে। শিক্ষার্থীরা আজ অনেকটাই শিক্ষক-শিক্ষিকার বন্ধুর মতো। ঠিক ভয় পায় না, কিন্তু ভালোবাসে। এখানেও আবার দেখি উল্টো সমস্যা, গার্জেনদের বলতে শুনি, এখনকার চ্যাং ড়া মাস্টাররা সব পড়ায় কোথায়? ক্লাসে বসে শুধু গল্প আর আড্ডা। সারা ক্লাস জুড়ে শুধু হো হো আর হা হা। আমাদের সময় ক্লাসে মাস্টার ঢুকলে ভয়ে কথা বলতে পারতাম না। উফ্ কী পড়াতেন, পড়া ধরতেন, বাড়ির জন্য হোমটাস্ক দিতেন আর না বলতে পারলেই মার। এদের সে দায়িত্ব কোথায়, এরা তো জানে মাস ফুরালেই মোটা মাইনে তাই পরের ছেলে পরমানন্দ, যত উচ্ছন্নে যায় তত আনন্দ।

‘ডাকাতগুলো এখন পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খাবে। তারপর ছ-জন নাক ডেকে ঘুমিয়ে রাতে বেরোবে গেরস্ত জেলেদের নৌকোসুদ্ধ বমাল ধরতে। কাদের ধরতে হবে সে খবর ওরা পঞ্চায়েতের লোকেদের ভাঙিয়ে জেনেছে।’…….সুন্দরবন খাড়ি অঞ্চলে জলদস্যু দের উৎপাত একটা জ্বলন্ত আন্তর্জাতিক সমস্যা। এই জলদস্যুরা বেশিরভাগই আসে বাংলাদেশ থেকে। লোকাল সোর্স’ও থাকে। ডাকাতি করে তারা আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে যায়। হাতেনাতে না ধরতে পারলে প্রশাসন তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। অবশ্য সুন্দরবন অঞ্চলে প্রসাশনের অস্তিত্ব প্রায় নামেই। জঙ্গলে চলে জঙ্গলেরই নিয়ম। বাঘ কুমির আর ডাকাতদের সাথেই সহবাস সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষদের। আমার একজন বন্ধুর সুন্দরবনের কোনো এক ছোট্ট দ্বীপে বাড়ি। ও বলতো, আমাদের গ্রামে প্রায়ই বাঘ আসে। গরু ছাগল খেতে। তবে বেশিরভাই বুড়ো বাঘ। তোরা যেভাবে কুকুর তাড়া করিস আমরা সেইভাবেই লাঠি নিয়ে সবাই মিলে বাঘ তাড়া করি। বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে বিস্ময়ের। মৃত্যু তো স্বাভাবিক পরিণতি। প্রায় প্রতি ঘরে বিধবার অস্তিত্ব সেই তথ্যেকে পুষ্টি যোগায়। এরসাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র। মূলত বাঘের চামড়ার কারবারিরা আসে বাঘশিকার করতে। ‘কপালে গুলি মারলি কেন? মাথার চামড়াটা ড্যামেজ হলে ভাল দাম পেতে অসুবিধা হবে,  জানিস না?’ তাদের হাতে মানুষের সরাসরি কোনো ক্ষতি হয় না ঠিকই, বরঞ্চ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লোকাল ইন্ধন থাকে পুরোপুরি। কিন্তু বাস্তুতন্ত্র তথা সুন্দরবনের মূল বাসিন্দা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আজ বিলুপ্তির মুখে। সরকারি প্রচার ও বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংস্থার প্রচারে বর্তমানে সুন্দরবন বাসিন্দাদের মধ্যে কিছু সচেতনতা দেখা দিয়েছে।

‘পর-পর চারটে গুলি লাগল বুকে আর পেটে। শিলাদ বুঝতে পারল ও মরে যাচ্ছে।’……শকুন থেকে যে জার্নিটা শুধু হয়েছিল গল্পকারের এবং আমার, শিলাদের অস্তিত্বের অবসানে চোখ শুকনো রাখার কোনো উপায় ছিল না আর। শিলাদের সাথে আমিও এতক্ষন এগিয়ে গেছি অরূপকথনের পথে। নিজেকে যেন আমি শিলাদের সাথে এক করে ফেলেছিলাম। হয়তো এটা গল্পকারের দক্ষতা বা আমার মানসিক দুর্বলতা। সে যাইহোক, গুলি খেতেই চমক ভাঙল, বুঝলাম যে আমি বেঁচে আছি আর শিলাদ নেই। ‘ও চলে গেল জলের তলায়।’….’দাদুকে চিনতে অসুবিধা হয়নি শিলাদের। দাদু-দাদু চিৎকার করেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল না। নিজের শবের ওপর দাদুকে নিয়ে ভেসে চলল শিলাদ তরফদার।’……শেষ হলো একটা জার্নি।

মন খারাপ হলেও অবকাশ পেলাম নিজেকে খোঁজার, জীবনের অর্থ খোঁজার শিলাদের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে। ‘নানা পর্বের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে সন্দেহ ধরে গেল যে জগৎসংসার সম্ভবত বোধগম্য, সুসংহত, আসঞ্জনশীল ব্যবস্থা নয়। উদাসীন পৃথিবীটা আমাকে লাথিয়ে-লাথিয়ে আমারই স্বাধীনতায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, আর আমি, পাখনা চাপড়ে বিলাপ করতে বাধ্য হচ্ছি। সম্ভাবনার সুযোগ সুবিধের মধ্যেই আমাকে কাৎ মেরে-মেরে খতিয়ে বেরোতে হবে। না কি?’ প্রশ্ন করতে বাধ্যধ হই নিজেকে, আর উত্তর? ‘নিজেকে নিজের কাছে, নিজের বাছবিচারের সম্ভবানার কাছে, বেঁচে থাকার খামখেয়ালি অথচ নির্বিকার স্রোতের কাছে, নিজেকে পরাজিত লাগে, হেরো, পরাভূত।’