টাকা কোথায়

পর্বঃ ৩

সাজ্জাদ হায়দার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৯, ২০১৮

শক্ত একটি অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের চীন। এ অবস্থায় পৌঁছতে এ জাতির রয়েছে নানা ত্যাগ ও পরিকল্পনা। পশ্চাৎপদ চীনা জনগোষ্ঠীকে সুসংবদ্ধ একটি অর্থনৈতিক পাটাতন পেতে যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন উ শিয়াওবো। শিখরে চীন শিরোনামে এটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাজ্জাদ হায়দার। আজ প্রকাশিত হলো তৃতীয় পর্ব

শুরু করাই সবচেয়ে কঠিন, এই চীনা প্রবাদ সেই ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য ছিল, যিনি চীনের সার্বিক পুনর্নির্মাণে উদযোগি হন। তার সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, বিশাল এই কর্মযজ্ঞে টাকা আসবে কোত্থেকে?
১৯৭৮ সালে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল খুবই সামান্য, মাত্র ১৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ত্রিশ বছর পর ২০০৮ সালে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ১.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে। যা ১৯৭৮ সালের চেয়ে দশ হাজার গুণের বেশি। মাও জে  দুং অর্থনৈতিক উন্নয়নে জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, দেং সেই পথে না গিয়ে মুলধন সংগ্রহের পথ ধরলেন। চীনের বিশাল বিনির্মাণের জন্য তিনি পুঁজিবাদী অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা করলেন।
তার প্রথম পদক্ষেপ ছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্যদের সাথে আলোচনা শুরু করা। এসব আলোচনায় তিনি জোর দিয়ে বললেন, বৈদেশিক অংশীদারদের সাথে বাণিজ্য চালাতে ঐক্যমতে আসতে হবে। তাহলে ৫০ বিলিয়ন ডলার পাওয়া যেতে পারে। সামান্য সাহসী হোন, এগিয়ে চলুন। অনন্তকাল ধরে বির্তক চালাবেন না। লক্ষ্য ঠিক করে কাজ শুরু করে দিন। শিল্পায়নের হ্মেত্রে কয়লা, ফার্নেস অয়েল, তেল, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ইলেকট্রনিকস, সমারাস্ত্র, পরিবহন, যোগাযোগ এমনকি খাদ্যশিল্পের জন্য সময় নষ্ট না করে কারখানা তৈরি ও উৎপাদনে যাওয়া উচিত।
এ আলোচনার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় কমিটি কৃষি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র শিল্পের প্রসারের জন্য ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য দশ বছর মেয়াদী বিশাল পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনায় খনিজ সম্পদ উত্তোলন, ওষুধ কারখানা ও ইস্পাত পরিশোধনগারসহ ১২০টি বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
দীর্ঘ সময়ব্যাপী এ আলোচনার পর গৃহীত এ পরিকল্পনার পর বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আর্কষণই হয় সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। দি বিল্ডিং অফ মর্ডান চায়না বইয়ে লেখক পেং মিন উল্লেখ্য করেন, শুধুমাত্র ১৯৭৮ সালে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অর্ধেক চুক্তি হয় মাত্র দশ দিনে। ১৯৭৮ সালে ২০ ডিসেম্বর থেকে বছরের শেষ দশদিনে।
১৯৭৮ সালের আগস্টে চীনা মটরগাড়ি শিল্পের দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রণালয় তারবার্তা পাঠিয়ে জেনারেল মটরস্, ফোর্ড, টয়োটা, নিশান, রেনাল্ট, সিট্রন, বেঞ্জ, ভক্সভেগান ও অন্যান্য গাড়ি উৎপাদন কারখানাগুলোর কর্মকর্তাদের চীন ভ্রমণ করে চীনা বাজরে অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা যাচাই করার অনুরোধ করে। প্রথম আসে জেনারেল মটরস্। অক্টোবরে সম্ভবনাময় প্রকল্প নিয়ে আলোচনার জন্য টমাস এ মার্ফির নের্তত্বে ২১ সদস্যে বিশাল দল চীনে আসে।
লি লানকিয়াং, যিনি পরবর্তিতে চীনের উপ-প্রধান মন্ত্রী হন, তিনি এই প্রতিনিধিদলকে সরকারি পক্ষে  স্বাগত জানান। মার্ফি তাকে যৌথ প্রকল্পের ধারণা দেন। মার্ফি তাকে প্রশ্ন করেন, কেন চীন শুধু প্রযুক্তি আমদানিতে আগ্রহী। যৌথ প্রকল্পে কেন নয়?
লি লানকিয়াং পরে সিসিটিভির সাংবাদিকদের বলেন, চীনা জনগণ ইংরেজি জানলেও জয়েন্ট ও ভেঞ্চার শব্দ দুটির আলাদা আলাদা অর্থ জানত। তাদের কাছে দুটি শব্দের অর্থ দাঁড়ালো, যৌথভাবে ঝুঁকি নেয়া। আসল মর্মার্থ তাদের কাছে জটিল মনে হলো।
অল্প কয়েকদিন পরেই, ভক্সভেগান কোম্পানির একটি প্রতিনিধিদল সাংহাই এলো। প্রতিনিধিদল নেতৃবৃন্দের সাথে ভক্সভেগান গাড়ি উৎপাদনের জন্য যৌথ প্রকল্পের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনায় বসল। এর অল্প কয়েকদিন পর ভক্সভেগান কোম্পানির একটি প্রতিনিধিদল সাংহাই সফরে আসে। প্রতিনিধিদলটি চীনা নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করে যৌথ উদ্যোগে ভক্সভগান গাড়ি উৎপাদনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করে। এ আলোচনা দশ বছর ধরে চলেছিল এবং চীনা পক্ষ ভক্সভেগান গাড়ির দেশীয় বাজারজাত চেয়েছিল।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো চীনে ঢুকতে শুরু করে। ১৯৭৯ সালে কোকাকোলার ৫০টি ব্যাংকের প্রথম চালান হংকং থেকে বেইজিংয়ে পাঠানো হয়। বাজার যাচাইয়ের পর কোকাকোলার সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, মিনিটে ৩০০ বোতল কোকাকোলা ভর্তি করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বোতলজাত প্লাট চীনা রাষ্ট্রীয় সংস্থা সি,ও,এফ,সি,ও কে অনুদান হিসাবে দেয়া হবে। চুক্তিতে ওই কোম্পানিকে দশ বছরের জন্য কোকাকোলা ব্র্যান্ড ব্যবহার এবং মূল চীনা ভূখণ্ডে উৎপাদন ও বিক্রির জন্য বিশেষ লাইসেন্স দেয়া হয়।
সি,ও,এফ,সি,ও চেয়েছিল, সোডা বোতলজাত করার ঐতিহাসিক কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃত সাংহাইয়ে কোকাকোলার প্লান্ট স্থাপন করতে। ১৮৬৪ সালে সাংহাইয়ে সোডা বোতলজাত করার জন্য এ্যকুয়ারিস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু সাংহাই সেখানে কোকাকোলা কোম্পানি স্থাপনের বিরোধিতা করে। সাংহাই কর্তৃপক্ষ সি,ও,এফ,সি,ও এর বিরুদ্ধে দেশ বিক্রি এবং পুঁজিবাদী সমাজের নষ্ট জীবনাচার আমদানির অভিযোগ আনে। এছাড়া অভিযোগ করে, এরা দেশীয় শিল্প অবমূল্যায়িত করেছে। এসব অভিযোগের পর সি,ও,এফ,সি,ও সাংহাইয়ের পরির্বতে বেইজিং এর অদূরে ফেংতাই এ কারখানা স্থাপন করে। প্রথম দিকে উৎপাদিত কোকাকোলা শুধু মাত্র পর্যটন হোটেলগুলোতে সরবরাহ করা হতো। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়ার পর ১৯৮২ সাল থেকে কোকাকোলা বেইজিং এর বাজারে বিক্রি শুরু হয়।
এই সময় থেকেই বৈদেশিক সাংবাদিকদের ওপর আরোপিত ভ্রমণ বিধি-নিষেধ শিথিল হতে থাকে। জাপানি সংবাদপত্র নিহন কাইজাই শিমবুন-এর ওকাডা নামের এক সাংবাদিক চীন ভ্রমণে এসে লিখলেন, চীনা বিমানের ফ্লাইট সর্বদাই বাতিল হয়। আরেকজন জাপানি সাংবাদিক চোংকিয়াং এ অবস্থিত একটি ইস্পাত কারখানা পরিদর্শন করে অবাক হয়ে আবিস্কার করলেন যে, এই কারখানায় ১৪০ বছর আগে বৃট্রিশ নির্মিত বাস্পীয় রোলার এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে। ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জে ম্যাথুস গুইলিনে একটি রাষ্টীয় কারখানা পরিদর্শনের অনুমতি পেয়ে হাতে যেন আকাশের চাঁদ পেলেন। তিনি লিখলেন, চীনের অন্যান্য কারখানাগুলোর মতোই, গুইলিনের রেশম কারখানার শ্রমিকরা সামর্থ অনুযায়ী কাজ করে না। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এ দেশ আধুনিকায়নে, কাজ-কর্মে  গা-ছাড়া মনোভাবই হবে সবচেয়ে বড় বাধা।
দূরদর্শী ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকনোমিস্ট ভবিষ্যৎ বাণী করে লিখল, অদূর ভবিষ্যতে চীন বিপুল পরিমান যন্ত্রপাতি আমদানি করবে এবং  এতে করে শিল্পায়নে অগ্রসর দেশগুলোর উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে। দূর ভবিষ্যতে চীনা পণ্যের বিপুল রফতানিই হলো এর পাল্টা পরিণতি।
বিশ বছর পর এই ভবিষ্যত বাণী পরিপূর্ণভাবে ফলে গিয়েছে। জনগণ ও সরকারের প্রত্যাশামত কোনও কিছুই সরল ও সহজ ছিল না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শীঘ্রই উপলদ্ধি করল যে, অস্থিরতা ও সিদ্ধান্ত হীনতার কারণে চীনা শিল্পগুলোর মৌলিক কাঠামো ভয়ানক পিছিয়ে আছে, বিনিয়োগের জন্য চীন উপযুক্ত দেশ নয়।