তিন বছরের সম্পর্ক

মারুফ ইসলাম

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৪, ২০১৮

যা আছে কপালে, আজ একটা এসপার ওসপার করতেই হবে— এমন একটা মনোভঙ্গি নিয়ে রাস্তায় নামল কনক। সূর্য তেতে উঠেছে স্বমহিমায়। ভাদ্রের আকাশ থেকে যেন দোজখের ওম নামছে অবিরল ধারায়। মাথার ওপর ছোট্ট ছাতাটা মেলে দিলো কনক। নীল-সাদা রঙের জামার নিচে চব্বিশ বছরের শরীরটা ঘামতে শুরু করেছে এখনই। কানে পড়েছে অ্যান্টিক ঝুমকো। গলায় পুতির মালা। কপালে ছোট্ট সাদা টিপ। ঠোঁটে হালকা লিপিস্টিক। হাতে শাখা টাইপের চুড়ি। পায়ে স্লিপার। গোড়ালির ওপর নিশ্চুপ শুয়ে আছে একটা পায়েল। খোলা চুলে কনক যেন ঠিক নিমাই ভট্টাচার্যের মেম সাহেব বইয়ের প্রচ্ছদ। এমন অপরূপা কেউ পথে নামলে রাস্তায় জ্যাম বাধতে বাধ্য।

কনক হাঁক ছাড়ে, এই রিকশা... এই, যাবেন?
‘কই যাইবেন আপা?’
‘ধানমন্ডি পনের।’
‘যামু।’
‘ভাড়া কত?’
‘ষাট ট্যাকা দিয়েন আপা।’
কষে একটা থাপ্পর লাগাতে ইচ্ছে করে কনকের। চল্লিশ টাকার ভাড়া চায় ষাট টাকা। কত্ত বড় হারামি! ছোটবেলা থেকে এই এক সমস্যা কনকের। একটু পান থেকে চুন খসলেই যাকে তাকে থাপ্পর দিতে ইচ্ছে করে তার। সকালে মা যখন বলেছিলেন ‘আজ কিন্তু ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে ভুলিস না’ তখনও মাকে থাপ্পর দিতে ইচ্ছে করেছিল কনকের। কিন্তু মাকে তো আর থাপ্পর দেয়া যায় না। তাই ইচ্ছেটা গিলে ফেলেছিল সে। অথচ বাবাটা কত্ত ভালো। মেয়ের বিয়ে শাদি নিয়ে একরত্তি চিন্তা নেই তার। সময় হলে মেয়ে এমনিতেই বিয়ে করবে, এমনই দর্শন পুষে রাখেন তিনি।

এই মুহূর্তে আরেকবার থাপ্পর সংক্রান্ত ইচ্ছেটাকে এক ঢোকে গিলে ফেলতে হলো কনককে। কারণ এখনই মেজাজের লোকসান ঘটাতে চায় না সে। একটু পর তো মেজাজ খারাপ করতেই হবে তাকে। কোনো কারণ না থাকলেও করতে হবে। সে এরকম একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই যাচ্ছে।

রিকশা ধানমন্ডি পনের নম্বরে এসে থামলে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ে কনক। পেছনের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে আকাশের পানে মুখ তুলে রেস্টুরেন্টের নামটা মিলিয়ে নেয় সে। হ্যাঁ, এটা ‘হ্যালো ধানমন্ডি’ই বটে। সতের তলা বিল্ডিংয়ের একবারে শীর্ষে জ্বলজ্বল করছে সাইনবোর্ডটা। ইদানীং কী এক ট্রেন্ড চালু হয়েছে, রুফ টপ রেস্টুরেন্ট! শহরের সব ছাদ দখল হয়ে যাচ্ছে রেস্টুরেন্টে রেস্টুরেন্টে।

কোণার দিকে একটা টেবিলে আগে থেকেই বসেছিল তারেক। চকলেট রঙের স্যুট-প্যান্টে দারুণ সুদর্শন এক যুবক। ক্লিন সেভড। জেলমাখানো ব্যাকব্রাশ করা চুল। মুখে মিষ্টি হাসি। সে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই কনককে আহ্বান জানায় বসতে। সামনের চেয়ারটায় বসতে বসতে কনকের মুখ থেকে বেরোয় ভদ্রতার উচ্চারণ, কেমন আছেন?
‘এই তো আছি।’
স্যুটের পটেক থেকে দুটো গোলাপ বের করে দেয় তারেক। রোমান্টিক আছে ছেলেটা। এই নিয়ে পঞ্চমবার দেখা করছে কনকের সাথে। কোনোবারই গোলাপ নিতে ভুল করেনি সে। কিন্তু এসব রোমান্টিকতায় গলবে না বলে আগে থেকেই মনস্থির করে এসেছে কনক। তাই যথারীতি গাম্ভীর্য লেপ্টে রাখে মুখে।

‘আচ্ছা, আপনি তাহলে বিয়ে করবেনই? ডিসিশন ফাইনাল?’ সরাসরি প্রশ্ন করে কনক। তার চোখ স্থির তারেকের ওপর।
তারেক খানিকটা ভয় পাওয়া গলায় বলে, আমরা কফি টফি একটা কিছু অর্ডার করি আগে। তারপর খেতে খেতে এসব নিয়ে আলাপ করা যাবে।

কনক এবার চোখের দৃষ্টি নরম করে। সাথে কণ্ঠও, ‘ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি তো ভয় পাওয়ার মতো কিছু বলিনি। জাস্ট আপনার সিদ্ধান্তটা জানতে চাইছি।’
‘হ্যাঁ, বিয়ে তো করতেই চাই, তোমার যদি আপত্তি না থাকে।’
‘আমার আপত্তি নেই।’ বলে কনক। ‘তার আগে একটা কাজ করতে চাই।’
‘কী কাজ?’
‘আমার সঙ্গে এখনই হোটেল সানফ্লাওয়ারে যেতে হবে আপনাকে। চলুন।’

সানফ্লাওয়ার একটি আবাসিক হোটেল। সেখানে যাওয়ার হেতু খুঁজে পায় না তারেক। জিজ্ঞাসার দৃষ্টি মেলে তাকায় কনকের দিকে। ঠিক তখনই রেস্টুরেন্ট ওয়েটার এসে নিঃশব্দে দাঁড়ায় টেবিলটার পাশে। ‘ও হ্যাঁ, দুইটা কোল্ড কফি।’ অর্ডার করে তারেক।

ওয়েটার চলে যাওয়ার পর কনক অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে বলে, দেখুন তারেক সাহেব, আমি এখন যে কথাটা বলব সেটা খুবই সিরিয়াস একটা কথা। দয়া করে হালকাভাবে নেবেন না। আমি হোটেল সানফ্লাওয়ারে একটা সিঙ্গেল রুম বুকড করে রেখেছি আমার আর আপনার জন্য। আমি মূলত আপনার বেড পারফর্মমেন্স দেখতে চাই। বিয়ের পর কোনো হ্যাপা নিতে চাই না আমি। আগেই কনফার্ম হওয়া ভালো।

তারেকের কান তপ্ত হয়ে ওঠে কনকের কথা শুনে। কি শুনছে সে এসব! তার সামনে বসে থাকা অতিশয় সুশ্রী মেয়ের মুখ থেকেই কি এসব অশ্লীল বাক্য নির্গত হচ্ছে? বিস্ময়ে হা হয়ে যাওয়া তারেকের মুখ দিয়ে শুধু একটি কথাই বের হয়, ‘আর ইউ সিরিয়াস?’ বিরক্ত কণ্ঠে কনক উত্তর দেয়, শুরুতেই তো বললাম, কথাটা সিরিয়াস। তারপরও বিশ্বাস করছেন না কেন?

সেদিন আর কথা হয় না তারেক-কনকের মধ্যে। বাড়ি ফিরে কনক দেখে থমথমে মুখে সোফায় বসে আছেন মা। বাবা হয়ত বাজারে গেছেন। ছোট ভাইটা নিশ্চয় কলেজে। কনক গুটি গুটি পায়ে নিজের ঘরে ঢুকছিল। তখনই গোখরোর মতো ফোঁস করে ওঠেন মা, তুই কী বলেছিস তারেককে?
‘কী আর বলব। ভদ্রলোক জানতে চাইল, বিয়েতে আমার আপত্তি আছে কি না। আমি বললাম, না, কোনো আপত্তি নেই। এই তো।’
‘তাহলে ফোন করে কেন বলল, তোকে সে বিয়ে করতে চায় না?’
‘তা আমি কি জানি!’ বলে গটগট করে নিজের ঘরে ঢুকে গেল কণক। দরজাটা ভিড়িয়ে দিলেও ড্রয়িং রুম থেকে তখনো ভেসে আসছিল মায়ের কণ্ঠ, এত অহংকার ভালো না, এত অহংকার ভালো না। দেখেছিস তো ফাতেমার মেয়েরে, বাছতে বাছতে শেষে গু-তে গিয়া হাত পড়ছে! তুইও সেই ঢং শুরু করেছিস, না? এই ছেলে শর্ট ওই ছেলে কালো। এর ভাইবোন বেশি ওর মাথায় চুল কম। নিজে যেন কোন রাজার কন্যা! অপেক্ষা করতে থাক, তোর জন্য পঙ্খিরাজে চইড়া ডালিম কুমার আসব!

মায়ের এসব কথা কানে তোলে না কনক। ড্রেস না পাল্টেই বিছানার ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়ে। নরম বিছানা স্প্রিংয়ের মতো খানিক দুলে ওঠে। এবং দুলতেই থাকে। কনকের মনজুড়ে খুশির হাওয়া। যাক বাবা! বিয়েটা তাহলে ভাঙা গেছে শেষঅব্দি। সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেই নিজের প্রশংসা করে, আপনি তো ক্রমশ এক্সপার্ট হয়ে উঠছেন মিস কনক! এ দিয়ে আট নম্বর বিয়ে ভাঙলেন আপনি। কংগ্রাচুলেশন!

খুশির খবরটা শিশিরকে এক্ষণি জানানো দরকার। ফাজিলটা প্রায়ই বলত, দুঃখ ভাগাভাগি করলে কমে, আর আনন্দ ভাগাভাগি করলে বাড়ে। প্রাচীন কথা, তবু ওর মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগে। আনন্দটা ওর সঙ্গে এখন ভাগাভাগি করা যাক তাহলে। কনক মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নেয়। শিশিরের নম্বরে ডায়াল করতে করতে বিড়বিড় করে, ফাজিলের বাচ্চা ফাজিল, কাল থেকে বাড়িতে গিয়ে বসে আছে। অথচ একটা ফোনও করেনি। ঠিকমতো পৌঁছালি কি না, জানাবি না? ন্যূনতম কমনসেন্স যদি থাকত!

আপনার ডায়ালকৃত নম্বরে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা... হা হয়ে যায় কনকের মুখ। কপালে ভাঁজ পড়ে। তিন বছরের সম্পর্কের মধ্যে কোনোদিন ফোন বন্ধ পায়নি তো শিশিরের। কী হলো আজ?