অঙ্কনঃ রিফাহ সানজিদা

অঙ্কনঃ রিফাহ সানজিদা

তুরুপের তাস

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০১৮

বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। জানালার একটু খোলা অংশ দিয়ে যেটুকু বাতাস আসছে, তাতে মরিয়মের ঘিয়া রঙের নামাজের শাড়ির আঁচল উড়ছে। ফ্যানের বাতাস বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘরটা আরেকটু শীতল করছে যেন। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে কাছেই কোথাও ওয়াজ মহফিল হয়। জিকির-আজকার হয়। সেখান থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন আসে এদিকে বাতাসে ভেসে।

ঘরের কোণায় আগরবাতি জ্বলছে। তার মৃদু পবিত্র গন্ধ ঝিরঝিরে হাওয়ায় এক ধরণের আধ্যাত্মিক মাদকতা তৈরি করে। বৃষ্টির কোনো আভাস ছিল না এতক্ষণ। মরিয়ম মোনাজাত ধরতেই হঠাৎ মেঘ ডাকতে শুরু করলো। তার মনে পড়লো,  নিজের হাফেজ নানার কথা। সবসময় সুরমা চোখে তসবিহ হাতে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। তার ঘরে জ্বলতো নানা রকম সুগন্ধি আগরবাতি। কত সময় তার কেটেছে এর মধ্যে!

নানার কবর এখন ভেঙে গেছে। সেখানে নতুন আরেকটি কবর হয়েছে কারো। কার কবর, এখন সেটা ঠিক মনে পড়ছে না। এটা চট্টগ্রামের একটা স্থানীয় পাড়া। এখানে কবরের জায়গা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে হয় না। স্থানীয়দের জায়গা হয়ে যায় একটা না একটা স্থানীয় কবরখানায়। বৃষ্টির বেগ একটু বাড়ছে যেন। আজ কেউ তাবিজ নিতে আসেনি মরিয়মের কাছে। রোজ কেউ না কেউ আসে পাড়া থেকে, কিংবা লোকমুখে শুনে। এটাই ব্যাবসা বলতে গেলে মরিয়মের, পারিবারিক সূত্রে পেয়েছে সে। 

মরিয়মের আলাদা দোতলার ঘরে আসে মানুষজন সমস্যা নিয়ে। কারো রাতে স্বপ্ন দেখা, কারো ভয় পাওয়ার সমস্যা, কারো কারো আবার ঘরের ভেতরকার কথাও শুনতে হয় মরিয়মকে। না হলে ঘরের অশান্তি দূর করার তাবিজ দেবে কী করে! পরশুর ঠিক আগের দিন অনেক দূর থেকে এক বোরখাঅলী এসেছিল। মুখ তার নেকাবে বাঁধা। মরিয়মের ভাইপোর বউ নিচের ঘর থেকে এসে  তাকে জানালো। মেয়েটাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসতে বললো মরিয়ম। আমেনা মেয়েটাকে মরিয়মের ঘরে দিয়ে গেলো । বোরখাঅলী মেয়েটা নেকাব খুলছে না। মরিয়ম তখন আশ্বাস দিলো, এ ঘরে পুরুষ মানুষ আসবে না। নেকাব খুলতে পারে সে। কিছুক্ষণ পর নেকাব খুললে দেখা গেল, মেয়েটা অল্প বয়স্ক। বয়েস হবে ১৯ কী ২০ বড়জোর। গায়ের রঙ একেবারে ফর্সা। অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটির মুখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। নাকে আর কানে ভারি স্বর্ণের গয়নায় বোঝা গেল, সে বিবাহিতা।

এবার মরিয়ম তাকে আরেকবার লক্ষ্য করলো, মেয়েটির চেহারায় আভিজাত্য আছে। তার মানে টাকাঅলার বাড়ির বউ। আর এরপর, মেয়েটির সমস্যা অনুমান করতে বেশ বেগ পেতে হলো না মরিয়মকে। তবু মরিয়ম এসব ক্ষমতা যে অলৌকিকভাবে পায়নি, বরং বুদ্ধি খাটিয়ে পেয়েছে সে কথার আন্দাজ আছে বলেই, তার অহংকারও নেই। সে মেয়েটিকে বললো, তোর ঘরে অশান্তি? বল, মানুষটা কে?

মেয়েটা এক দৃষ্টিতে মরিয়মের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মরিয়মের অস্বস্তি হলো যেন একটু। বল, সমস্যা খুলে বল- চাটগাইয়্যা ভাষায় আবার বললো মরিয়ম। মেয়েটি যা বললো তা নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার একেবারে, মেয়েটির স্বামী ঘরে থাকে না। ব্যবসার কাজে বাহানা করে পড়ে থাকে অন্য কোথাও। শুনে মরিয়ম হাসে একটু। চিন্তার কোনো কারণ নেই। এ সমস্যা এক মাসেই সমাধানযোগ্য। জানায় সে।

শুনে মেয়েটি সেদিনের মতো বিদেয় নেয়। আবার আসতে হবে তাকে পাঁচদিন পর। এ পাঁচদিন মরিয়মের কথামতো দেখিয়ে দেয়া কাজগুলো সে করবে। সালাম করে বিদায় নেয় মেয়েটি।

এসব ভাবতে ভাবতে মরিয়ম দেখে, বৃষ্টির বেগ কমে না, বরং আরও বাড়ে। ভাবতে ভাবতে মরিয়মের চোখে ঘোর লাগে, ঘুম পায় তার। স্বপ্ন দেখে সে। এক আজব স্বপ্ন।
একটা অন্ধকার গলি ধরে হাঁটছে সে। তাকে কেউ একজন অনুসরণ করছে। বারবার চেষ্টা করেও সে মুখ দেখতে পায় না। অন্ধকারে তার মনে হয় কেবল, মানুষটা তার নানাজান। হঠাৎ মানুষটা গম্ভীর কণ্ঠে তাকে এসব করতে বারণ করে। কীসব করতে বারণ করে সে তা বুঝতে পারে না। মরিয়ম তখন জিজ্ঞেস করে, কীসব? নানাজান?  বলেন?

তখনি মানুষটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে তার পাশের দু’বাড়ি পরের দুই জায়ের ঝগড়ায়। এসব ঝগড়াঝাটি এ পাড়ায় প্রত্যেক ঘরে কখনো না কখনো বাঁধেই। কখনো ছোট-খাটো বিষয়ে। আর কখনো অনেক বড় বড় বিষয়ে। প্রায় সবার জায়গা-সম্পত্তি প্রচুর এখানে। উঠে ভাইপোর বউয়ের কাছে মরিয়ম জানতে চায়, বিষয় কি। আমেনা উত্তর দেয়, একজনের নতুন ঘর উঠছে। তার দেয়ালের সীমা নাকি একটু বেশিই রেখা অতিক্রম করেছে অন্যজনের। তাই নিয়ে ঝগড়া করছে ওরা।

ঝগড়ার বিষয় শুনে মরিয়মের ধারণা হয়, শীঘ্রই এ ঝগড়া পুরুষদের মধ্যে, এরপর দু`পক্ষের বাকি আত্মীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি একপক্ষ তার কাছে অন্যপক্ষ বশ করার তাবিজ চাইতেও আসতে পারে। মরিয়মের এমন সব চিন্তা নেই জায়গা সম্পত্তি নিয়ে। বিয়ে করেনি সে, যা পাবার মৃত্যুর পর অর্ধেক পাবে এই ভাইপো, তারও অনেক দেরি আছে।

ওর বাবার কাছে ঋণী সে। যদিও ঋণের পরিমাণটা টাকায় হিসেব করা যাচ্ছে না। তবে এসব নিয়ে এই সাতসকালে সে ভাবতেও চায় না। সম্পত্তি জিনিসটা টাকায় হোক আর নাম-ডাকে হোক, কোনোটা নিয়েই ঝগড়া-কলহ তার পছন্দ নয়। সম্পত্তি দখল যদি করতেই হয়, তবে তা অন্যভাবে করতে হয়, বিবাদে নয়। যদিও সবাই সেটা বোঝে না।

মাথাটা ধরে আছে ওর। উজ্জ্বল কড়া রোদ উঠেছে আকাশে। রাতের বৃষ্টির পর। একটু পর মেয়েটা আসে বোরখাঅলী। যথারীতি আমেনা তাকে বসিয়ে দিয়ে যায় দোতলার ঘরে। আমেনাকে চা দিতে বলে মরিয়ম। মেয়েটা আজ নিজেই নেকাব খুলে বসে। সকালের উদ্দাম হাওয়ায় জানালায় লাগানো সবুজ জরিতে সাদা চাঁদ আঁকানো ঝরকা গুলো উড়ছে। রোদ লেগে সেগুলো ঘরের ভেতর ঝিকিমিকি ছায়া তৈরি করেছে। মেয়েটা সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

মরিয়ম জানতে চায় তার অবস্থার কথা, কোনো পরিবর্তন কি সে লক্ষ্য করেছে তার স্বামীর মধ্যে? যেভাবে তাবিজ দিয়েছে সেগুলোর ঠিকঠাক ব্যাবহার হয়েছে তো? মেয়েটা মরিয়মের দিকে তাকিয়ে প্রথমবারের মতো হাসে। চোখ দুটো আগের মতোই বিষণ্ণ। মেয়েটাকে এখন অপূর্ব দেখাচ্ছে না। অন্য রকম লাগছে। মরিয়মের দিকে আরো ঝুঁকে বসে মেয়েটা। তারপর ধীরে ধীরে বলে, ওই মেয়েমানুষটার খোঁজ পেয়েছে সে।

মরিয়ম খুশি হয়, এখন তাবিজের ব্যবহার দ্বিগুণ মাত্রায় করা যাবে। কে সে, জানতে চায় মরিয়ম। তার নাম-ঠিকানা দরকার। তারপরই সে তাবিজ দিতে পারবে এবার কাজের যোগ্য। মেয়েটা হুট করেই তখন বোরখার তলায় লুকিয়ে রাখা হাতটা বের করে, একটা চকচকে ধারালো ছুরি সে চালায় মরিয়মের গলা বরাবর। মেয়েটার হাতে ধরা রক্তাক্ত ধারালো সে ছুরি ঘরের ভেতর আসা রোদের অনেকটাই এখন প্রতিফলিত করছে সাদা দেয়ালজুড়ে। ঝিকিমিকি ছুরি আর রোদের ছায়া নেচে বেড়াচ্ছে সারা ঘর। বোরখাওয়ালী দ্রুত নেকাবে মুখ ঢেকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে, যেনো কোথাও কিছু হয়নি আজ। 

আর, মৃত্যুর আগে খানিকটা সময়জুড়ে মরিয়ম হিসেব মিলিয়ে নেয়, তুরুপের তাস এবার চাল দিয়েছে, শক্ত চাল। সে হেরে যাচ্ছে এখন খেলায়।