তৃষ্ণাকুমারী

উপন্যাস পর্ব ৯

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮

মন্ত্রী মাথা নত করে জবাব দিল, যথার্থ বলেছেন মহারাজ। রাজউৎসবে এধরনের ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। এ কারণে সকলেই শঙ্কিত। কিন্তু এ শঙ্কা নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। আপনি সত্যিই বিচক্ষণ মহারাজ।
রাজা বললেন, ঠিকাছে মন্ত্রীমশাই, আপনি এখন আসুন। রাজসভার প্রস্তুতি নিন।
মন্ত্রী বিশ্বনাথ বেরিয়ে গেলেন।
ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে আছে রাজকুমারী। ভোরের ঝলমলে সূর্য উঠছে জানলার ওপাশে। নরম আলোয় ভরে যাচ্ছে ঘরটা। মেঝেতে বিমলা নেই। উঠে গেছে। ঝিরঝির আনন্দ বয়ে গেল রাজকুমারীর ভেতর। গতদিনের ঘটনায় তার মনটা কালো একটা শ্লেট হয়ে ছিল। সূর্যের রক্তাভা শ্লেটটি উজ্জ্বল ঝকঝকে করে দিল। পাখি ডাকছে বাগানের গাছপালা থেকে। তাদের ডানা ঝটপটানির শব্দও শোনা যাচ্ছে।
রানিমা কী যেন নাম বলেছিল ফুলটির! গর্ভকুসুম... এতই তো মনে পড়েছে। কিন্তু এ ফুলটির ঘ্রাণ নেয়া কী এমন অপরাধ? রানিমা অমন করলেন কেন? ভাবনার কোনও থই পায় না সে।      
বিমলা এলো। তার মুখ বিষণ্ন। বিষণ্ন হলো রাজকুমারীও। সে জিগেশ করল, বিমলা, রানিমা কি উঠেছেন?
বিমলা জবাব দিল, হ্যাঁ। বারান্দায় বসে আছেন। রাজামশাই আরেকটু পরেই সভাতে যাবেন। তুমি যাবে রানিমার কাছে?
হ্যাঁ, যাব। বিমলার সাথে রাজকুমারী এলো বারান্দায়। রানিমা তাকে জড়িয়ে ধরলেন। জিগেশ করলেন, ঘুম হয়েছে মা?
তৃষ্ণা ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।
রানি ডাকলেন, বিমলা?
বিমলা জবাব দিল, বলেন রানিমা।
রানিমা বললেন, রাজকুমারীকে নিয়ে আমি আজ নদীতে স্নান করতে যাব। তুই দুজন সৈন্যকে বল আমাদের সঙ্গে যেতে।
আজ্ঞে রানিমা, আমি এখুনি যাচ্ছি। বিমলা বেরিয়ে গেল।
রাজকুমারী খুশি হলো। বলল, বেশ হবে রানিমা। অনেকদিন নদীতে যাই না। নদীর জলে চান করতে আমার তো ভালো লাগে।
হাসি ফুটল রানির মুখে, তাই?
টলটলে মুখে হাসল রাজকুমারীও। আর বলল, হুম।
রানি এবার বললেন, তুমি তাহলে একটু বোসো এখানটায়। আমি তৈরি হয়ে নিই। এই বলে ঘরে গেলেন রানি। চাবি নিয়ে এরপর গেলেন সাজঘরে। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার তালা খুলে ঢুকলেন ভেতরে। ওই তো কার্পেটের ওপর পড়ে রয়েছে ফুলটি। কী টকটকে লাল! আর সতেজ! কী এক ভয়ের শিরশিরানি রানি টের পেলেন ভেতরে। সোনার গয়নাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পাথরের বাকসোগুলোও। কিন্তু সেসব গুছিয়ে রাখার প্রতি কোনও ঝোঁক নেই রানি। সাবধানে তিনি তুলে নিলেন ফুলটি। কাপড়ের নিচে সেটি ঢেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন।
ফিরে এসে দ্যাখেন, তৃষ্ণা আর বিমলা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। বিমলাকে তিনি বললেন, তুই থাক বিমলা। তোর আর গিয়ে কাজ নেই। তুই বরং রাজামশাইয়ের একটু খোঁজ নে। সভা থেকে ফিরলে বলিস, আমরা নদীতে স্নানে গেছি। এই ফিরলাম বলে।  
বিমলা একটু অবাক হলো। এরকম তো কখনও হয়নি। এর আগেও তো রাজকুমারীকে নিয়ে রানি নদীতে গেছেন। সঙ্গে সেও গেছে। রানি তো তাকে কোনোবার নিষেধ করেননি। তবে এ ভাবনা মুহূর্তের। এরপরই বিমলা মাথা নেড়ে জবাব দেই, ঠিকাছে রানিমা, আপনি ভাববেন না।
রানি বললেন, দুজন সৈন্যকে বল আমার সাথে নদীতে যেতে। ফটকের সামনে থাকতে বল। আমরা এখুনই বের হবো।
কথা না বলে বেরিয়ে গেল বিমলা। রানিমা বললেন, চল রে মা তৃষ্ণা। আর দাঁড়া, কাপড়ের ঝুলিটা আমি নিচ্ছি।
নদীর ওপর সূর্য। টলটল করছে জল। ছোট ছোট ঢেউ ভাঙছে। ঢেউ উঠছে। আর শাদা শাদা মেঘের ছায়া ভাসছে। তীরে দাঁড়িয়ে আছে দুই সৈন্য। তৃষ্ণাকে নিয়ে রানি নামলেন হাঁটুজলে। তৃষ্ণার চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল। দু’হাতের আঁজলা ভরে সে ছড়িয়ে দিল জল। কাপড়ের তলা থেকে গর্ভকুসুম বের করে রানি ভাসিয়ে দিলেন জলে। ঢেউয়ের দোলায় সেটি ভেসে যেতে থাকল। ভারি অবাক হয়ে গেল রাজকুমারী। সে বলে উঠল, মা মা ফুলটি ফেলে দিলে কেন? ওই যে ভেসে চলে যাচ্ছে...
রানির মুখ থমথমে। ফ্যাসফেসে স্বরে তিনি বললেন, যাক মা। ওই ফুল রাজপরিবারের জন্য কলঙ্ক। চলে যাক ভেসে।
আর কিছু বলল না তৃষ্ণা। শুধু কাতর চোখে দেখল, ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলে যাচ্ছে ফুলটি। রাজপরিবারের সম্পদ।

দিনের পরে দিন এলো। রাতের পরে রাত। পেরিয়ে গেল কয়েকটি মাস। রাজা নিয়ম করে সভায় বসছেন। চলছে রাজকাজ। তৃষ্ণাকে নিয়ে কেটে যাচ্ছে রানির সময়। সঙ্গে আছে বিমলা। রাজপরিবারের দীর্ঘদিনের সুখ-দুঃখের বন্ধু। সেদিনের সে ভয়াল ছবি ঝাপসা হয়ে এসেছে প্রায়, এমনই এক সময়ে রানি লক্ষ্য করলেন, রাজকুমারীর পেট একটু উঁচু উঁচু।
অশনি সংকেত পেলেন রানি। ভাবনায় পড়লেন। ভেতরে ভেতরে এই ভয়টাই তিনি পাচ্ছিলেন। এখন কী করবেন? বিষয়টি প্রথমে গোপন রাখতে হবে। এরপর যা ভাবার, ভাবা যাবে। রানি ঠিক করলেন, বিমলাকে তার বাবার বাড়ি কেষ্টনগরে পাঠিয়ে দেবেন। এতদিন বিমলাই রাজকুমারীকে স্নান করিয়ে এসেছে। খাবার-দাবারের ব্যাপারেও ছিল বিমলার দেখভাল। এখন থেকে এসব কাজকর্ম রানি তার হাতে তুলে নেবেন। কয়েক মাসের জন্যে বিমলার ছুটি। সেই কবে থেকে বিমলা রয়েছে তাদের সঙ্গে। হঠাৎ যখন সে দেখবে, রাজকুমারী সন্তানসম্ভবা, কী যে ভয়ানক হোঁচট সে খাবে। রানি তখন কী বলবে তাকে? বিমলা ছাড়া আর কারও অন্দরমহলে ঢোকার অধিকার নেই। এ ঘটনা পাঁচকান হলেই রাজপরিবারের কলঙ্ক। সুতরাং কলঙ্ক লোকচক্ষুর আড়ালেই থাক। কিন্তু এরপর কী হবে? সে ভাবনা আর রানি ভাবতে পারছেন না। তবে বুঝতে পারছেন, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
বিকেলবেলা তৃষ্ণাকে নিয়ে ফুলবাগানে এলেন রানি। সঙ্গে বিমলা। রঙ-বেরঙের ডানা মেলে ফুলে ফুলে প্রজাপতি উড়ছে। আর ডাকছে পাখি। রোদের রঙ ম্লান হয়ে এসেছে। হাওয়া বইছে ঝিরঝির। একটা ঝাউগাছের নিচে সিমেন্ট বাঁধানো বেদিতে বসে আছেন রানি। একটু দূরে ঘাসের ওপর বসে বিমলা গাঁদাফুল দিয়ে মালা গাঁথছে। তৃষ্ণা ঘুরে ঘুরে ফুল ছিড়ছে।
রানি জিগেশ করলেন, মালা কি করবি রে বিমলা?
বিমলা হাসল, কী আবার করব, রাজকুমারীর শখের যোগান দিচ্ছি। ওই যে দেখুন না, ফুল ছিড়ছে। এরপর আমাকে ধরবে, মালা বনিয়ে দ্যাও। তার কী আবদারের আর শেষ আছে!
কী একটু ভাবলেন রানি। এরপর বললেন, তুই কয়েক মাস আমার বাবার বাড়ি কেষ্টনগরে গিয়ে থাক বিমলা। খবর পেয়েছি, দাদা প্রতাপচন্দ্রের পুত্রসন্তান লাভ হয়েছে। তা আমরা তো এখন যেতে পারছি না, তুই-ই গিয়ে বরং থেকে আয়। দাদাকে আমি চিঠি লিখে দেব।
ঘাড় নাড়ল বিমলা। এরপর বলল, কবে যেতে হবে রানিমা?

চলবে...