দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ১

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক।

সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী পর্ব ১

একটা সময় ছিল, সাক্ষাৎকার পেলেই গোগ্রাসে গিলতাম। দৈনিকের সাময়িকী অথবা শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারগুলোই ছিল আমার প্রথম আকর্ষণ। ওটা পড়ে তারপর বাদবাকি অন্যসব! সাক্ষাৎকারধর্মী বই পেলেও লুফে নিতাম। তা কবিরই হোক বা সাহিত্যিকের অথবা চিন্তাবিদ কিংবা ফিল্মস্টারের— সেটা কোনো দেখার বিষয় নয়, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে একজন অন্তরঙ্গ মানুষকে, যেখানে সে নিজেকে অনেকটাই মেলে দেয়, অনুষঙ্গ থাকে ব্যক্তিগত একান্ত ভাবনা অথবা জীবনের চড়াই উৎরাইয়ের অনেক গোপন রহস্য!

আমার প্রিয় অনুষঙ্গ সেই সাক্ষাৎকার যে একদিন আমাকেই গ্রহণ করতে হবে, সেটা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। ভাবিনি এ-কারণে, আমি মানুষটা বরাবরই মুখচোরা। সবার কাছ থেকে একটু আড়ালে থাকতে পারলেই যেন বুক ছেড়ে নিঃশ্বাস নিতে পারি। সেই আমাকে কিনা বড় বড় মানুষের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে হবে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে আনতে হবে উদ্দিষ্ট কথা, সেটা তো বেশ কী বলব একটা সাহসিক বা চটপটে ব্যাপার! আমার চরিত্রের সঙ্গে যা একেবারেই যায় না। অথচ সেটাই ঘটে গেল একদিন আকস্মিকভাবেই— ১৯৯০ সালে। হঠাৎ করেই ঘটনাচক্রে তৎকালীন বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা সচিত্র সন্ধানীতে জড়িয়ে পড়ার পর।

তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ বি.এ অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। থাকি সলিমুল্লাহ হলে। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সেই উত্তুঙ্গ-কালে, যখন আমিও মিছিল-মিটিং করে বেড়াই আর বিকেলে এসে আড্ডা দেই টিএসসিতে; সে-সময়েই একদিন কবি ও সংস্কৃতিকর্মী জাহিদ মুস্তাফা এসে বললেন, ‘নতুনভাবে সন্ধানী বেরুচ্ছে। ওদের গল্পের ক্রাইসিস। মফিদুল ভাইকে আপনার কথা বলেছি। শিগ্রি একটা গল্প দিয়ে আসেন।’ গল্প তৈরি করতে করতে দিন পনেরো লেগে গেল। মধ্য জুলাইয়ের এক সকালে গল্প নিয়ে মফিদুল হক ভাইয়ের কাছে হাজির হলাম। তখন সচিত্র সন্ধানীর অফিস ছিল পল্টন মোড়ের বাসস গলির কথাকলি প্রিন্টার্সে। মফিদুল হকই দেখাশোনা করছেন, তাকে সহযোগিতা দিচ্ছেন আবুল হাসনাত। এছাড়া প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রয়েছেন আজকের সব প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক যেমন সৈয়দ শহীদ, আহমেদ ফারুক হাসান, স্বদেশ রায়, ব্যাংকার ফারুক মঈনউদ্দিনের মতো প্রতিভাবান মানুষ। আর, সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদ তো মাথার ওপর রয়েছেনই। নেপথ্যে আছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এবং আতাউস সামাদ।

তো, মফিদুল হক ভাই গল্প তো রাখলেনই, আমাকে সচিত্র সন্ধানীতে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করারও প্রস্তাব দিলেন। যা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত তো বটেই, অভাবনীয়ও ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, মনে মনে এ ধরনেরই একটা কাজ খুঁজছিলাম। তার জন্য ভেতরে ভেতরে চেষ্টাও করে যাচ্ছিলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার অফিসে যাই আর সমানে নাজেহাল আর নাস্তানুবাদ হই। সেসব নিয়ে আরেকটা সাতকাণ্ড রামায়ণ লেখা যাবে। সামনের মাসে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। তবুও সঙ্গতকারণেই মফিদুল ভাইয়ের প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গেই রাজী হয়ে গেলাম। সুযোগ কিন্তু সহজে এলো না। তখন সচিত্র সন্ধানীতে প্রতিবেদক হিসেবে অনেক প্রতিভাবান তরুণই জড়িয়ে পড়েছে— আসিফ মুনীর, নির্মাতা জাকির হোসেন রাজু, অলোক বসু, সৈয়দ সাবাব আলী, ইয়াসির রাহুল, আনন্দ জামান প্রমুখ। এর ভেতরে আমি কোন্ জায়গার মফস্বলের কে— ঢুকে পড়েছি, কী বিষয়ে লিখবো, কোন ক্ষেত্রে কাজ করব, একটা ভজঘট অবস্থা। অবশেষে একদিন মফিদুল হক ভাই আমাকে প্রথম অ্যাসাইন্টমেন্টটা দিয়েই দিলেন। ভারত থেকে আসা কুমিল্লার প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিবারের যোগ্য উত্তরসুরী ধ্যানেশ খাঁ ও কীরিট খাঁ শিল্পকলা একাডেমির অডিটরিয়ামে যুগল সেতার ও সরোদ পরিবেশন করবেন। তিনি অনুষ্ঠানটি কভার করতে বললেন আমাকে। সেই সঙ্গে দায়িত্ব দিলেন ধ্যানেশ খাঁর একটা ছোটখাটো সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে যেন রিভিউটির সঙ্গে জুড়ে দিই। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ক্লাসিকেল মিউজিকের অনুষ্ঠান কভার করার কথা শুনে তখন আমি একটুও ঘাবড়াইনি। তখন সত্যিই আমি ছিলাম এক তরুণতুর্কি এবং যে কোনো মূল্যে আমার একটা কাজ দরকার। বাঘের চোখ এনে দিতে বললেও বুঝি পারতাম! সেই তোড়েই কোথায় ইতি হয়ে গেল আমার সাক্ষাৎকার নেয়ার সেইসব ভীতি!

নির্দিষ্ট দিনে শিল্পকলা একাডেমিতে যাই। মিডিয়ার লোকরা যেখানে বসে, সেখানেই বসি। নিজেকে কেমন অন্যরকম লাগে। একটু কেউকেটা গোছের। তারপর যখন ওস্তাদ ধ্যানেশ খাঁ এবং কীরিট খাঁর সরোদ ও সেতার বাদন শুরু হয়, খুব মনোযোগ দিয়েই অনুষ্ঠানটি দেখতে থাকি, শুনতেও। উপভোগ যে করা হয়নি, সে কথাতো বলাই বাহুল্য। যা মনে আসছিল নোট নিচ্ছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে ধ্যানেশ খাঁর সঙ্গে ড্রেসিং রুমে কথা বলে, সাক্ষাৎকারের জন্য পরের শুক্রবার সকালটাও নেয়া গেল। শিল্পীদ্বয় উঠেছিলেন মতিঝিল অফিস কলোনি পাড়ায় ওস্তাদ আবেদ হোসেন খাঁর বাসায়। পরের শুক্রবার সাতসকালেই শিডিউল অনুযায়ী আবেদ হোসেন খাঁর বাসায় যাই এবং ধ্যানেশ খাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি, কাগজে-কলমে।

এই হলো আমার প্রথম সাক্ষাৎকার নেয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কাহিনি। তবে, এরপর সচিত্র সন্ধানীতে সাক্ষাৎকার গ্রহণের আর কোনো দায়িত্ব না পড়লেও, ধ্যানেশ খাঁর অনুষ্ঠানটি কভারের সুবাদে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেটা হলো, সন্ধানীর প্রতিসংখ্যায় ঢাকায় ক্ল্যাসিকেল মিউজিকের কোন্ কোন্ রেকর্ড বা ক্যাসেট এলো, তার সংবাদ জানানো এবং রিভিউ করা। এলিফ্যান্ট রোডের গানের ডালির সহযোগিতা নিয়ে সে দায়িত্বও আমি ভালোভাবে পালন করতে পেরেছিলাম। আমার ছদ্মনাম ছিল সুরসন্ধানী।

আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি ও তাঁর মর্যাদা রক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক

ধ্যানেশ খাঁ

ধ্যানমৌলি যুগল ধ্যানেশ ও কিরীট
স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়ে ধ্যানেশ খাঁর সরোদের মূর্ছনা বেজে উঠলো শিল্পকলা একাডেমীর মিলনায়তনে ১৩ জুলাই সন্ধ্যা সাতটায়। রাগ পুরিয়া কল্যাণ ও গৎ তিনতালে পরিবেশন শুরু করলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সেতার বাজালেন কিরীট খাঁ। দুজনের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত হলো যুগলবন্দির একটি স্মরণীয় অনুষ্ঠান।

সরোদের ওপর ধ্যানেশ খাঁর দখল অসাধারণ। সুর যেন তাঁর হাতের মুঠোয়, আঙুলের ভাঁজে। সরোদের তারে তাঁর নিপুণ আঙুলের শৃঙ্গারে সৃষ্ট সুর অপূর্ব ধ্বনিব্যঞ্জনা পাচ্ছিল। বৈচিত্র্যময় ভাবসম্পদে পূর্ণ এই রাগের ধ্বনিব্যঞ্জনা একেবারে সঙ্গীতে অজ্ঞ শ্রোতাটিকেও সংগীতজ্ঞের মতো সমানভাবে আকৃষ্ট করে রেখেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শক-শ্রোতা এই মনোমুগ্ধকর সরোদ ও সেতারের যুগলবন্দী সন্ধ্যাটি উপভোগ করেন।

রাগ পুরিয়া কল্যাণ আলাপ ও গৎ-এর পর সামান্য বিরতি দিয়ে তাঁরা মিশ্র কাফিতে ধূন পরিবেশন করলেন। প্রায় পৌনে দু’ঘণ্টা যাবৎ ক্লান্তিহীনভাবে ধ্যানেশ খাঁ সরোদ বাজিয়ে গেলেন। যতই সময় গড়াচ্ছিল সুর যেন তাঁর হাতে নতুন ছন্দ পেয়ে মহত্তম গভীর তাৎপর্যে শিল্পোত্তীর্ণ হচ্ছিল। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিরীট খাঁও সেতার বাদনে নিপুণ সৃজনী দক্ষতার পরিচয় দিলেন। দুজনের মধ্যে চমৎকার সমঝোতা, সরোদ ও সেতারের রাগের সুরে সুরে দুজন যেন ভাববিনিময় করছিলেন; কখনো আনন্দের ঝংকার তোলে, কখনো বিষাদের পরশ ছড়িয়ে। আর তাদেরকে তাল দিচ্ছিলেন তবলাবাদক মনজুর হোসেন খাঁ। অসাধারণ দক্ষ ও বিদ্যুৎগতির মতো চঞ্চল হাতে তিনি সরোদ ও সেতারের সুরকে একটি ঐক্যছন্দে গেঁথে দিচ্ছিলেন। তাঁর সংযমী ও চিত্তাকর্ষক তবলা সহযোগিতা অনুষ্ঠানটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। উল্লেখ্য, মনজুর হোসেন খাঁ বাংলাদেশেরই ছেলে। ভারতের রেঠোফিন তানপুরা বাজিয়েছেন শিল্পীদ্বয়ের সঙ্গে।

মাইকে শব্দ প্রক্ষেপণে সামান্য ত্রুটি ছাড়া সবদিকেই অনুষ্ঠানটি ছিল নিখুঁত। অত্যন্ত সাদামাটা ও আড়ম্বরবিহীনভাবে আয়োজিত এ সরোদ ও সেতারের যুগলবন্দি অনুষ্ঠান যথাযথভাবে প্রচার পেলে দর্শকসংখ্যা আরো বাড়তো। এটা দুঃখজনক ব্যাপার, যাদের হাতে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে তারা শিল্পরসিক নন, আর প্রকৃত শিল্পরসিকেরা আমন্ত্রণপত্র পান না, এমনকি খবরও পান না অনুষ্ঠানের। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে ধ্যানেশ খাঁ ও কিরীট খাঁ বাংলাদেশে আসেন। এর আগে ধ্যানেশ খাঁ ‘৭৯ সালে এবং ’৮১ সালে এ দেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালে ধ্যানেশ খাঁ কিরীট খাঁর সঙ্গে ঢাকা ছাড়াও ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় সরোদ ও সেতারের যুগলবন্দি পরিবেশন করেন। ধ্যানেশ খাঁ ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পৌত্র এবং ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর পুত্র। বর্তমানে তিনি রবীন্দভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত। ভারতীয় চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনাও তিনি করে থাকেন। সঙ্গীতে হাতেখড়ি পান পিতার কাছেই। কিরীট খাঁ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর পৌত্র এবং ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁর ছেলে। সেতারের দক্ষ বাদক কিরীট খাঁ বর্তমানে দিল্লীতে পিতার নামে ‘ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ সঙ্গীত একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করে সেখানেই অবস্থান করছেন।

পারিবারিক পরিমণ্ডল এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই ধ্যানেশ খাঁ ও কিরীট খাঁকে উঁচু মানের শিল্পী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। সুমহান ঐতিহ্যের তাঁরা যোগ্য উত্তরাধিকারী— শিল্পকলা একাডেমীর অনুষ্ঠানে তাঁদের সরোদ ও সেতার শ্রুত দর্শকমাত্রেই তা স্বীকার করবেন। ঢাকা অবস্থানকালে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপচারিতা চলে শিল্পী আবেদ হোসেন খানের বাসায়।

হামিদ কায়সার: বাংলাদেশে অনুষ্ঠান করে কেমন লাগছে?
ধ্যানেশ খাঁ    : ভালো। ভালো লাগছে। এখানকার শ্রোতারা সঙ্গীতের সত্যিকারের সমঝদার।
হামিদ কায়সার: কিভাবে সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হলেন?
ধ্যানেশ খাঁ    :  শৈশবে দাদুকে সঙ্গীতচর্চায় সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকতে দেখতাম। সঙ্গীত বাবারও ছিল একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। তাঁদের দেখে দেখে ও সরোদ সেতার ইত্যাদি শুনে শুনে আমি শৈশব হতেই সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠি। বাবার উৎসাহে ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতচর্চায় জড়িয়ে যাই।

হামিদ কায়সার: ভারতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এখন কি অবস্থা?
ধ্যানেশ খাঁ    : দিন দিন ভারতে ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছর ক্ল্যাসিকেল সঙ্গীতের সম্মেলন হয়। সেখানে প্রচুর দর্শকের উপস্থিতিই ক্লাসিক সঙ্গীতের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়। ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে এদেশেও এরকম সম্মেলন করা যায়। তাতে ক্ল্যাসিক সঙ্গীতের প্রতি এ দেশের মানুষের আগ্রহ বাড়বে।
হামিদ কায়সার: বাংলাদেশের সঙ্গীত সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করেন?
ধ্যানেশ খাঁ    : ছেলেমেয়েরা ক্ল্যাসিক্যাল কম করলেও, যারা করছে তাদের মান ভালো। ’৭৯ সালে এসে যা দেখেছি তার চেয়ে পরিস্থিতির এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব আছে। স্কলারশীপের মাধ্যমে সঙ্গীত বিষয়ে উচ্চতর চর্চার ব্যবস্থা করা উচিত। তাতে সঙ্গীতের অনেক কল্যাণ হতো। কিছু কিছু তবলাবাদককে ভারতে পাঠানো উচিত— যে দু’একজন ভালোভাবে শিখে এসেছিল তারাও তো নেই এখন, লন্ডনে— প্রতিভাবানদের দেশের ভেতরেই ধরে রাখতে হবে।

হামিদ কায়সার: সরোদ ও সেতারের সঙ্গে তবলার গুরুত্ব কতটুকু?
ধ্যানেশ খাঁ    : সমান সমান। তবলাকে কোনভাবেই অবহেলা করার উপায় নেই। একটি ছাড়া অন্যটি অচল। তানপুরারও নিজস্ব অবস্থান আছে।
হামিদ কায়সার: বাংলা সঙ্গীতে পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারকে কি দৃষ্টিতে দেখেন?
ধ্যানেশ খাঁ    : পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আমাদের সঙ্গীতের জন্য ক্ষতিকর নয়, প্রয়োজনীয়ই। বিশেষ করে ফোকের জন্য ওটির দরকার আছে।

হামিদ কায়সার: আপনিতো অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সেসব স্থানে বাংলা গানের কেমন কদর?
ধ্যানেশ খাঁ    : পৃথিবীতে আমাদের ক্ল্যাসিক্যাল গানের কদর আছে। পৃথিবীর সব দেশেই ক্ল্যাসিক্যাল গানের শ্রোতা তৈরি হয়ে গেছে।
হামিদ কায়সার: আপনার ঘরানা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
ধ্যানেশ খাঁ    : আমরা তিনপুরুষ ধরে যে ঘরানায় বাজিয়ে আসছি তা সেনী ঘরানা হিসেবেই পরিচিত। সেনী ঘরানা প্রকৃতপক্ষে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর হাতেই পূর্ণাঙ্গতা ও সমৃদ্ধি লাভ করে এবং উপয্ক্তু মর্যাদা পায়। আলী আকবর খাঁ সাহেব, রবিশংকর এ ঘরানাটিকে বিশ্বব্যাপী প্রচার এবং জনপ্রিয় করে তোলে। এখন এটাকে আলাউদ্দিন খাঁর ঘরানাও বলা যেতে পারে। বর্তমানে এ ঘরানাটিই বিশ্বের এক নম্বর ঘরানা। শুধুমাত্র এ অবদানের জন্যই নজরুল-রবীন্দ্রের মতো আলাউদ্দিন খাঁর জয়ন্তীও পালিত হওয়া উচিত।

হামিদ কায়সার: আপনার কোনো স্মরণীয় ঘটনার কথা বলবেন কি?
ধ্যানেশ খাঁ   : তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো স্মরণীয় ঘটনা নেই। তবে একটি ক্ষোভের কথা বলি। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বাড়িতে যে স্কুল চালু করা হয়েছে সেখানে ওর কোনো কিছুই শেখানো হচ্ছে না। আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ে সুরিয়া বেগমের প্রতিও অবহেলা করা হচ্ছে। যারা বাড়িটি সঙ্গীত স্কুলের জন্য ব্যবহার করছেন, তারা সুরিয়া বেগমের দেখাশোনা করছেন না, স্কুলেরও উন্নতি করছেন না। তারা বাড়িটি দখল করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছেন। আলাউদ্দিন খাঁ-র স্মৃতি ও তাঁর মর্যাদা রক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক।

সচিত্র সন্ধানী, ২৯ জুলাই ১৯৯০ সংখ্যা