দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ৯

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : নভেম্বর ০২, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক।

হামিদ কায়সার: দেশের বাইরে ভিনভাষী আর কার কার লেখা আপনি নিয়মিত পড়েন?
আবুল হোসেন: মার্কেজ, কুন্ডেরা, রুশদি... সবই পড়ি। বই পড়ার ব্যাপারে আমি আসলে সর্বভূক। দুটো জিনিসই আমার খুব প্রিয়, বই পড়া আর  খেলাধুলা দেখা। ক্রিকেট, টেনিস হলে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সারারাত জেগেও ক্রিকেট কমেন্টরি শুনেছি। তিরিশ বছর পর্যন্ত নিয়মিত ক্রিকেট আর টেনিস খেলতাম। এটা পেয়েছি আমি আমার বাবার কাছ থেকে, বাবা খুব ভালো অ্যাথলেট ছিলেন, ভালো ফুটবল খেলতেন। আর বই পড়ার ব্যাপারটা পেয়েছি মা-র কাছ থেকে।

হামিদ কায়সার: তিনি বুঝি খুব বই পড়তেন?
আবুল হোসেন: হ্যাঁ, ছেলেবেলায় মাকে দেখেছি ‘আনোয়ারা’, ‘মনোয়ারা’, পড়তে ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়তে। তিনি গল্প উপন্যাস নিয়মিত পড়তেন।
হামিদ কায়সার: তাহলে আপনার বই পড়ার আগ্রহটা গড়ে উঠেছে মায়ের প্রেরণাতেই...
আবুল হোসেন: সেটাতো আছেই, এমনিতেও ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজের ভেতর থেকেও বইপড়ার আগ্রহ অনুভব করতাম। বই পড়ার জন্য যেমন তৃষ্ণা হতো, পড়ে তেমনি গভীর আনন্দও পেতাম। আমি নিয়মিত বই পড়া শুরু করি স্কুলে, লাইব্রেরিতে বইয়ের সংগ্রহ ছিল বিপুল। ওখান থেকে বাড়িতে এনেও বই পড়তাম। তাছাড়া, আমার কিছু হিন্দু বন্ধুবান্ধব ছিল। তাদের সঙ্গেও বইয়ের আদান প্রদান করতাম। এভাবে, ক্লাস থ্রি ফোরে পড়ার সময়েই পড়ে ফেলি রামায়ণ, মহাভারত, কথা সরিৎসাগর, বিষাদ সিন্ধু। শিশুদের পত্রিকা ‘মৌচাক’ পড়তাম নিয়মিত। আর, ‘মৌচাক’-এর প্রতি সংখ্যাতেই থাকতো সুনির্মল বসুর কবিতা। ছোটদের জন্য লেখা, কিন্তু কি সব আশ্চর্য সুন্দর কবিতা। সে লেখা পেলে এখনও আমি খুশি হয়ে পড়বো। ছোটদের জন্য অতো ভালো কবিতা সুনির্মল বসু ছাড়া আর কেউ লিখতে পেরেছে বলে জানা নেই। তিনি অজস্র কবিতা লিখেছেন।

হামিদ কায়সার: আপনার কবি মানস গঠনে কি ছেলেবেলায় এই বই পড়ার কোনো অবদান আছে?
আবুল হোসেন: অবশ্যই। বই পড়তে পড়তেই একদিন নিজের ভেতরে লেখার আগ্রহটা টের পেলাম। শৈশবেই, যখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি, তখন আমার বড় বোনের বিয়েতে একটি কবিতা লিখে ফেললাম। যতদূর মনে হয়, সেই আমার প্রথম কবিতা। সে-কালের বিয়েতে উপহার হিসেবে কবিতা ছাপা হতো। কখনো বরপক্ষ, কখনো কনেপক্ষ, আবার কখনো কখনো উভয়পক্ষই বিয়ে উপলক্ষে কবিতা ছাপাতো, সেই ছাপানো কবিতা মজলিসে বিতরণ করা হতো, পঠিতও হতো। আমার কবিতাটি মজলিসে পড়া হয়েছিল। তো, যে ঘটনাটি আমাকে কবিতা লেখার জন্যে প্রচণ্ডভাবে মনকে তৈরি করে দিয়েছিল, সেটা বলি। সেই সময় স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষাশেষে নতুন ক্লাসে উঠার সময় ‘প্রাইজ’ দেয়া হতো। যারা পরীক্ষায় ভাল করতো, তাদেরকেই দেয়া হতো এই ‘প্রাইজ’। তখন খেলাধুলার ক্ষেত্র ছাড়া সবক্ষেত্রেই প্রাইজ দেয়া হতো বই। তো, ক্লাস থ্রি থেকে ফোর-এ যখন উঠলাম, তখন আমি পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম এক সঙ্গে অনেকগুলো বই।

হামিদ কায়সার: কি কি বই পেয়েছিলেন, মনে আছে?
আবুল হোসেন: সব বইয়ের নাম মনে নেই, তবে কয়েকটির নাম মনে পড়ছে ‘লালকালো’, ‘যখের ধন’, ‘বনে জঙ্গলে’, সেই সঙ্গে ‘সোনার তরী’। সোনার তরী-র মলাট ছিল একেবারেই সাদামাটা। একটি রঙিন কাগজের মলাটের উপরে লাল কালিতে লেখা ছিল সোনার তরী, নিচে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্যসব বইয়ের মলাট ছিল ঝকঝকে, উজ্জ্বল। তাই, ‘সোনার তরী’ পড়ে রইল। একে একে সব বই যখন পড়া শেষ হয়ে গেল, যখন পড়ার মতো আর নতুন কোনো বই নেই, তখন ভাবলাম, দেখি না বইটা খুলে কি আছে ভেতরে। বই খুলে আরো নিরাশ হলাম। এটাতো দেখছি গল্পের বই নয়, ছবি নেই, কাহিনী নেই, কবিতার বই। নিরাশ মন নিয়েই পড়তে শুরু করলাম। সত্যি কথা বলতে কি, প্রথম কবিতার লাইন পড়েই ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’ এ কবিতার ছন্দ আর শব্দ ব্যবহার আমাকে একটি অন্য জগতে নিয়ে গেল। আমি বারবার আবৃত্তি করি আর ভাবি, এ রকম লেখা যায় না? এটাই আমার লেখার আসল প্রেরণা।

হামিদ কায়সার: এরপর নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়লেন?
আবুল হোসেন: হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আকণ্ঠ ডুবে গেলাম এবং এতটাই ডুবে গেলাম যে প্রথম যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, রবীন্দ্রনাথের ধাচেই লিখেছি। শুধু আমি কেন, সবাই। রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে তখন কবিতা লেখা সম্ভব ছিল না। রবীন্দ্রনাথ এতবড় প্রতিভা ছিলেন যে, তার সময়ে যে যা-ই লিখেছেন, তার উপরে রবীন্দ্রপ্রভাব পড়েছে। এমনকি আধুনিক বাংলা কবিতার তিন দিকপাল- বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং অমিয় চক্রবর্তীও রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত ছিলেন না। অবশ্য জীবনানন্দ দাশ এবং বিষ্ণু দে রবীন্দ্রপ্রভাব এড়াতে পেরেছেন। জীবনানন্দের উপর খানিকটা প্রভাব পড়েছিল নজরুলের।

হামিদ কায়সার: তো, আপনি রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্ত হলেন কিভাবে? এখানে কি পঠন পাঠনের ভূমিকা রয়েছে?
আবুল হোসেন: আমার প্রথম যৌবনটা কেটেছে আধুনিক কবিতার সংস্পর্শে। তখন আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছি, একটু ভালো করে কবিতা পড়তে শিখেছি, তখন বুঝতে পারলাম যে, রবীন্দ্রনাথের মতো করে লিখে কবি হওয়া যাবে না। আসলে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম কথাটাই ছিল, রবীন্দ্রনাথ যা কিছু করেছেন, তা থেকে ভিন্ন ধরনের কিছু করতে হবে, ভিন্ন ধরনের কিছু লিখতে হবে? এক কথায়, রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা। আমি কখনো ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’ পড়িনি। তবে, বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘নিরুক্ত’ পড়তাম এবং এসব কাগজে নিজেও লিখতে শুরু করলাম। লেখার এই পর্বে আমি প্রথম থেকেই ধরতে পেরেছিলাম যে, ভালো লিখতে হলে নিজের মনের মতো করে বলতে হবে। সুতরাং, প্রথম থেকেই আমি আমার নিজের একটি শৈলী তৈরি করতে চেয়েছিলাম। তারপর ষাট বছর পার হয়ে গেল তো কতটা কি পেয়েছি কি হয়েছি, সেতো আমার বলবার কথা নয়। পাঠকরা তা বলবেন।

হামিদ কায়সার: আপনি সম্ভবত বিদেশি সাহিত্যই বেশি পড়ছেন?
আবুল হোসেন: বাংলা গল্প উপন্যাসও আমি সমানভাবেই পড়ি। যারা লিখছেন সবাইতো আমার চেনাজানা ঘনিষ্ঠ— আবু রুশদ, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, পরবর্তীকালের রশীদ করীম, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সবার লেখাই আমি পড়েছি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’। তার আরেকটি উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ অবশ্য আমি পড়িনি। ইলিয়াস আমাকে তার চারটি গল্পের বই উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলো পড়ে আমার ভালো লেগেছিল। কিন্তু ‘খোয়াবনামা’ পড়ে যেমনভাবে উল্লসিত হয়েছি সেসব পড়ে তেমনটা নয়। আমাদের সমাজে উপন্যাসে যে কাজ হয়েছে তার মধ্যে ‘খোয়াবনামা’ই শ্রেষ্ঠ। বাংলা সাহিত্যে এ বইটি একটি অনন্য-সাধারণ সংযোজন। এরকম বই আর দ্বিতীয়টি নেই। ‘বিষাদ সিন্ধু’ যেমন ক্ল্যাসিক হয়েছে, এখনো সবাই পড়ে। ‘খোয়াবনামা’ও তেমনি অনেক অনেকদিন বেঁচে থাকবে। ‘আনোয়ারা’ আবদুল্লাহ’ বহুদিন বেঁচে থাকলেও ‘খোয়াবনামা’র পর্যায়ের নয়।

হামিদ কায়সার: অন্যান্য লেখক সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাচ্ছি।
আবুল হোসেন: ইলিয়াসের কথা বলছি বলে, অন্যদেরকে তুচ্ছ করছি না। বিশেষ করে যারা আমাদের উপন্যাসের কাঠামো তৈরি করে দিলেন, যেমন: আবু রুশদ, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তারাও আমাদের সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ। আবু রুশদ-ই প্রথম শহুরে মুসলমান মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। তবে আমি বলবো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিয়ে একটু বাড়াবাড়িই হয়। ওয়ালীউল্লাহ ‘চাঁদের অমাবস্যা’ এবং কাঁদো নদী কাঁদো’, উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহ রীতিকে ধরার চেষ্টা করলেন, এটা তিনি বিদেশে ছিলেন বলে করতে পেরেছিলেন। এটা সম্পূর্ণ পশ্চিম থেকে ধার করা জিনিস। এসব লেখাকে অনেকেই প্রচুর প্রশংসা করেছেন, কিন্তু আমার কাছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’-কেই মনে হয় তার সেরা কাজ। আমি মনে করি, ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে কোনো চরিত্রই শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস্য হয়ে উঠেনি। যখন কোনো উপন্যাসের চরিত্র ও আখ্যান বিশ্বস্ত বলে মনে হয় না, সে লেখা তখন আমাকে আর টানে না। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের একজন অর্ধশিক্ষিত স্কুলটিচার যেভাবে নিজের আত্মবিশ্লেষেণ করে তা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। ওরকম আত্মবিশ্লেষণ করা কোনো সুশিক্ষিত জনের পক্ষেও সম্ভব নয়। আসল কথা হলো, উপন্যাসের আখ্যান এবং চরিত্র প্রথমে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক-এর লেখাও পড়ি। হাসান আজিজুল হক বেশ কয়েকটি অসাধারণ ছোটগল্প লিখেছেন। সম্প্রতি দুজন লেখকের লেখা আমার বেশ ভালো লাগছে— হাসনাত আবদুল হাই এবং অন্যজন এক নতুন লেখিকা, নাসরীন জাহান। হাসনাত আবদুল হাইয়ের গল্প-উপন্যাস ভালো, কিন্তু তার জর্নাল ও ভ্রমণকাহিনি আরো অনেক ভালো। নাসরীন জাহান নতুন লিখছেন, কিন্তু খুবই ভালো লিখছেন। তার লেখা খুবই সাহসী। মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লেখেন বললে কিছুই বলা হয় না। লেখক লেখকই। তার মধ্যে পুরুষ-নারীর বিভেদ আমি করি না।

হামিদ কায়সার: ওপার বাংলার লেখকদের মধ্যে আপনার প্রিয় কে?
আবুল হোসেন: তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায় এবং বিভুতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। এদের পরে ভালো লাগে সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখা। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ এবং ‘ঢোড়াই চরিতমানস’ দুটি অসামান্য উপন্যাস। তার কয়েকটি খুব ভাল ছোটগল্পও আছে।
হামিদ কায়সার: এবার কবিতার কথা বলুন। কবিতা আপনি কেমন পড়েন?
আবুল হোসেন: কবিতা আমি গোগ্রাসে গিলি। যখন যেখানে পাই, নতুন কিংবা পুরনো, কবিতা একবার অন্তত পড়ে দেখি। স্বাধীনতার পরে আমাদের দেশে লেখকের সংখ্যা বেড়েছে, কবির সংখ্যা বেড়েছে, তারা প্রচুর লিখছেন। সেই তুলনায় লেখা যে ভালো হচ্ছে, তা বলতে পারলে খুশি হতাম। কবিতার কথাই ধরুন, কবিতার ক্ষেত্রে আমাদের বেশ ভাটা চলছে। পঞ্চাশের দশকে যারা লিখেছিলেন, তাদের চেয়ে ভালো লেখা অথবা ভিন্নধর্মী লেখা আর বেশি চোখে পড়ছে না। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এদের পর তেমন কিছু হয়নি। নতুন কিছু হচ্ছে না। বেশির ভাগ কবিরা ছন্দ জানেন না, শব্দ ব্যবহারে দুর্বল, বক্তব্যেও তেমন কিছু নেই। যারা বলেন যে, কবিতায় অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই বা বলার কথাও থাকার দরকার নেই তাদের সঙ্গে আমি কোনোভাবেই একমত নই।

হামিদ কায়সার: ওপার বাংলার কবিতার সঙ্গে আমাদের কবিতার যদি তুলনা করি?
আবুল হোসেন: আমরা পিছিয়ে আছি, শুধু কবিতায় কেন, উপন্যাসেও। হয়েছে কি, স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে আর কোনো দেশ তো দুবার স্বাধীন হয়নি, আমরা হয়েছি। বিগত ৩০০ বছরে হিন্দুরা যা করেছে, আমরা তা অনেকটা করেছি ৫০ বছরে। সেই তুলনায় বলতে গেলে আমরা একদিক থেকে পিছিয়ে নেই। স্বাধীনতা আমাদের অনেক এনে দিয়েছে। আমরা যখন লিখতে শুরু করি, সেই সময়ে আমাদের সমাজের লেখকদের প্রায় আঙুলেই গোনা যেত। এখন সেখানে লেখকের সংখ্যা গুনে শেষ করা যায় না। শিল্পী ছিলেন ৩/৪ জন, মোহাম্মদ মঈন, তিনি খুব অল্প বয়সেই মারা যান, জয়নুল আবেদীন, শফিউদ্দীন আহমদ, কমার্শিয়াল আর্টের ক্ষেত্রে ছিলেন কাজী আবুল কাশেম। কামরুল হাসান তখনো শিল্পী হয়ে উঠেননি। গায়ক ছিলেন হাতেগোনা। আব্বাসউদ্দিন, হোসনাবানু খানম, লায়লা আর্জুমান্দ বানু। আজ দেখুন আমাদের চারুশিল্পী, কণ্ঠশিল্পীদের সংখ্যা। শুধু সংখ্যাই বাড়েনিÑ চিত্রশিল্পে আমাদের সুনাম আজ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু সে তুলনায় কবি-লেখকের সংখ্যা প্রচুর বাড়লেও ভালো কিছু সে রকম সৃষ্টি হয়নি। তবে হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। আমাদের পথচলার বয়স তো মাত্র ৫০ বছর। সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের যে ঘাটতি আছে, তা পূরণ হলেই ওদের সামনে চলে যেতে পারব। কল্পনা করতে পারেন, আমি যখন ভার্সিটিতে পড়তাম, দশটা মুসলমান মেয়েও ছিল না সারা কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে, সেখানে আজ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে দেখুন মেয়ের সংখ্যা কত। কাজেই ৫০ বছরে আমরা অনেক এগিয়েছি কল্পনার অতীত এগিয়েছি। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হতাশাব্যঞ্জকভাবে পশ্চাদমুখীও হয়েছি।

হামিদ কায়সার: যেমন?
আবুল হোসেন:  যেমন? ধর্মীয় গোড়ামির দিক থেকে। সহনশীলতার দিক থেকে। ৫০ বছর আগে আবুল মনসুর আহমদ যা লিখেছেনÑ এটা এখন কেউ সাহস করে লিখতে পারবে? বা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে যা লিখে গেলেনÑ ওই ধরনের প্রগ্রেসিভ লেখা আজকের দিনে কারো লেখার সাহস হবে? অথচ রোকেয়া সাখাওয়াত যখন লিখেছেন তখন পুরো ভাবতবর্ষ এতটা প্রগ্রেসিভ অবস্থায় ছিল না। আমরা ‘উইমেন্স লিব’ বলে যে জিনিসটার কথা বলছি, এটা সর্বপ্রথম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনই শিখিয়ে গেছেন। ভারতবর্ষে তো বটেই, অন্যান্য দেশের মেয়েদের বেলাতেও। এর আগে শুধু এক মার্কিন মহিলা এ বিষয়ে লিখেছিলেন। কিন্তু রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তা জানতেন না। আবুল মনসুর আহমদ, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনদের মতো মানুষদেরকে কিন্তু আমরা আজও সঠিক মর্যাদা দিইনি।

হামিদ কায়সার: এখন তো ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার যুগ— বই পড়ার যুগ কি শেষ হয়ে এলো?
আবুল হোসেন: বইকে কোনো কিছুই ‘রিপ্লেস’ করতে পারবে না। এক সময় যখন রেডিও হলো, সিনেমা হলো— তখন কথা হতো— কে আর বই পড়বে? কিন্তু তাতে তো বই পড়া কমেনি। আমাদের দেশে তো আধুনিক ইলেকট্রনিক্স উপাদান সবে আসতে শুরু করেছে— কম্পিউটার, ইন্টারনেট যাই বলুন না কেন, ইউরোপ-আমেরিকায়তো এসব অনেক আগে থেকেই আছে— সেখানেই বইয়ের কাটতি একটুকুও কমেনি। কারণ বই পড়ার আনন্দ আর অন্য কোনো কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। একা বসে বসে আনমনে নিবিড় মগ্নতায় ডুবে থাকা, এটা চোখে দেখে আর কানে শুনে হয় না। আমি যখন বই পড়ি, অনেক সময় একটা লাইন পড়ে তিন মিনিট মনে মনে ভাবছি— ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতে এ সুযোগ আমার কখনোই নেই। বইয়ের রিপ্লেসমেন্ট অসম্ভব। সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেয়ার পর এখন বই পড়াই আমার একমাত্র কাজ। এখন যেন আমি ফিরে গেছি, সেই ছেলেবেলাকার দিনগুলোতে, সারাদিন পড়ছি আর লিখছি— এই আনন্দের স্বাদ বড় গভীর আর সুমধুর।  

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭, দৈনিক সংবাদ