দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ১২

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৯, ২০১৮

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক।

সাহিত্য-বিষয়ক বই বেশি পড়ি, তারপর ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের বই— শওকত আলী

শওকত আলী বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। বেশ কয়েকটি অসাধারণ উপন্যাস এবং ছোটগল্পের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সমালোচকদের প্রশংসা যেমন বহুলভাবে অর্জন করেছেন, তেমনি দেশের সব ক’টি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পুরস্কারও লাভ করেছেন। তবু যেন কিসের অতৃপ্তিতে তিনি ভোগেন। মানুষ হিসেবে বরাবরই প্রচারবিমুখ, সিরিয়াস স্বভাবের বন্ধুবৎসল অথচ স্পষ্টবক্তা। যারা তাকে চেনেন সবাই জানেন যে, তিনি কী রকম পরার্থপর, অন্যের শুভাকাঙ্ক্ষি ও প্রসন্নচিত্ত। অবসরজীবনে একাকিত্ব ঘিরেছে তাকে: স্ত্রী অকালে চলে গেলেন, সুহৃদ প্রতিবেশী লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চলে গেলেন, এক পুত্র বিদেশে। সাক্ষাৎকারের জন্য ফোন করলে উষ্মা প্রকাশ করলেন প্রথমে, তারপরে বললেন, ‘প্রশ্ন লিখে নিয়ে আসবেন, লিখে উত্তর দেব।’ যথারীতি যাওয়া হলো তার কাছে। প্রশ্ন রেখে দরজা থেকেই বিদেয় করে দিলেন, পাঁচদিন পর উত্তর আনতে গিয়ে উত্তর পাওয়া গেল বটে, খোদ শওকত আলীকেই পাওয়া গেল না। এবারও ফিরে আসতে হলো দরজা থেকেই, কিন্তু ঘোর অতৃপ্তি রয়ে গেল। দরজার ওপাশে আর যাওয়া হলো না এ যাত্রায়। জানা গেল না নানা প্রশ্ন খুঁড়ে খুঁড়ে লেখকের অন্তর্জগৎকে। যে জগৎকে তিনি ঋব্ধ করেছেন বই পড়ে, জীবন দেখে। তার খণ্ড অনুভূতির প্রকাশ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে—
 
হামিদ কায়সার: সম্প্রতি আপনি কি বই পড়েছেন?
শওকত আলী: সম্প্রতি পড়েছি মার্কেজের Of Love and Other Demons, ডেনিশ লেখক PETER HOEG এর নতুন ‍উপন্যাস BORDER LINERS. এই লেখকের Smillas sense of Snow ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকায় বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে বইয়ের ফ্ল্যাপ-এ। টাইম ম্যাগাজিনে ওই বছরের সেরা উপন্যাস বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল বইখানিকে।

হামিদ কায়সার: এমন কোনো বই রয়েছে, যা আপনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী?
শওকত আলী: না, সার্বক্ষণিক সঙ্গী কোনো বই নেই। তবে অভিধানের সাহায্য প্রয়োজন হয় প্রায় রোজই, আর দেবনাগরী হরফে ছাপা একখানি হিন্দুস্থানী রুবাঈ-এর সংকলন কাছে থাকে, মাঝে মাঝে ওই বইখানি খুলে দেখি।

হামিদ কায়সার: কোন ধরনের বই পড়তে আপনার ভালো লাগে?
শওকত আলী: সব ধরনের। তবে গণিত এবং টেকনোলজি-বিষয়ক বই বুঝতে পারি না বলে পড়তে পারি না, সেজন্য আক্ষেপ হয়। সাহিত্য-বিষয়ক বই বেশি পড়া হয়, তারপর ইতিহাস এবং নৃতত্ত্বের বই।

হামিদ কায়সার: বইয়ের সঙ্গে আপনার সম্বন্ধটা কবে থেকে? এ প্রসঙ্গে আপনার প্রথম বই পড়ার অভিজ্ঞতা এবং সেই সময়কার প্রেক্ষাপট জানালে বাধিত হবো।
শওকত আলী: ছেলেবেলা থেকে। প্রথম বই কোনখানি ভাল লেগেছিল মনে নেই। বাড়িতে প্রচুর বই ছিল এবং আসতো, বাবা-মা দুজনই বই পড়তে ভালোবাসতেন। মনে হয়, বই পড়ার ঝোঁক বাড়ির পরিবেশের কারণেই আমার মধ্যে জেগে ওঠে।

হামিদ কায়সার: আপনার লেখকমানস গঠনে কি বই পাঠের ভূমিকা আছে?
শওকত আলী: লেখকের মানস গঠনে বইয়ের একটি ভূমিকা অবশ্যই আছে। কিন্তু মনে হয় না ওটা প্রধান। হলে, সব পাঠকই লেখক হতেন। আমার মানস গঠনে আমার পরিবার, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, জীবনযাপন, প্রকৃতি, নানান সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ঘটনা নানানভাবে ক্রিয়াশীল ছিল বলে আমার ধারণা। বই থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি এবং এখনো পাই একথা অস্বীকার করতে পারব না।

হামিদ কায়সার: জীবনের সবসময় কি মনের মতো করে বই পড়তে পেরেছেন?
শওকত আলী: তাই কি পারা যায়? কত রকমের ঘটনা ঘটে— তখন জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে ওঠে— তারপর যেটা আমার দেশ সেখানে কি নির্বিঘ্নে শান্ত জীবনযাপন করা গেছে? দাঙ্গার সময় পালাও পালাও করতে হয়েছে, দেশভাগ হলেও এই একই রকম অস্থির থাকতে হয়েছে, ঠাঁই বদল করতে হয়েছে— তারপর ছাত্রজীবনে পুলিশের নজর এড়িয়ে লুকিয়ে থাকা কিংবা জেলখানায় থাকা— এমন পরিস্থিতিতে মনের মতো করে কে বই পড়তে পারে?

হামিদ কায়সার: আপনার প্রিয় লেখক প্রিয় বই সম্বন্ধে জানতে চাচ্ছি।
শওকত আলী: প্রিয় লেখক তো অনেক, যখন সবে বই পড়তে শুরু করেছি তখনকার পড়া দুর্গেশনন্দিনীকে কি ভুলতে পেরেছি? কিংবা শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ কিংবা প্রথম যৌবনে পড়া ‘শেষের কবিতা’— যখন ইংরেজি ভাষায় লেখা অথবা অনুদিত বই পড়তে শিখলাম তখনকার কথাই বা ভুলি কেমন করে? ন্যুট হ্যামসুন, যোহান বোয়ার, ফবেয়ার, জোলা, ফ্রাসেঁ, জিদ, রমা রলাঁ, কাফকা, রেমার্ক, তুর্গেনিয়েফ, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়— কতো নাম মনে আসে— যখন স্মরণ করি সবাইকে তো প্রিয় মনে হয়। হেমিংওয়ে পড়তে ধরলে কি ছাড়া যায়, কিংবা জয়েস? আমার পক্ষে নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব, কে প্রিয় লেখক বা কোন বইখানি প্রিয়? থ্রি কমরেডস যেমন ভালো, তেমনি ভালো তো অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্ট-ও কিংবা ওয়ার এন্ড পিস যেমন মহৎ তো আনা ক্যারেনিনা-ও।

হামিদ কায়সার: বাংলা ভাষায় আপনার পূর্বসূরি লেখকদের কথা বলুন— যারা আপনার প্রিয়।
শওকত আলী: বাংলা ভাষায় প্রিয় লেখক কি কম? রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস না পড়লে তো বোঝাই সম্ভব ছিল না উপন্যাস আসলে কী জিনিস। যেমন বোঝা যেত না উপন্যাস আর রোমান্স-এ পার্থক্য কেমন যদি বঙ্কিম পড়া না থাকতো— তেমনি তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ আর মানিক এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস এক সময় দারুণভাবে আকর্ষণ করেছিল। সমরেশ বসু পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের একটি সময় গেছে— মনে হয় বাংলা উপন্যাসের ওই সময়টাই ছিল খুব সৃজনশীল। ওই সময়েই আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকেও পাচ্ছি। পূর্বসূরিদের কাজ প্রিয় না হলে তার উত্তরাধিকারী কি দাবী করা যায়?

হামিদ কায়সার: আপনার সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে কার কার লেখা পড়েন এবং ভালো লাগে?
শওকত আলী: সবার লেখাই পড়ি, যখনই হাতের কাছের পাই— কমবেশি সবার লেখাই ভালো লাগে।

হামিদ কায়সার: আপনার পরবর্তী-প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা পড়েছেন? তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাচ্ছি।
শওকত আলী: সবার লেখা হাতের কাছে পাই না— একেবারে তরুণতম যারা, তাদের মধ্যে একাধিক লেখকের নতুন কিছু করার আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। এটা ভালো কিন্তু তারা যদি একটু খোঁজ-টোজ নিতেন যে, তাদের পূর্বসূরিদের কেউ কেউ একই ধরনের আগ্রহ মনে পোষণ করতেন কি না বা অমন নতুন কিছু লেখার চেষ্টা তারাও করেছেন কি না তাহলে বড় ভালো হতো।

হামিদ কায়সার: ইদানীং কবিতাও লিখছেন— কোন অনুভূতি থেকে?
শওকত আলী: আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করি লেখালেখির শুরু থেকেই। কেউ বলে আমার কবিতা হয়— আবার কেউ বলে, হয় না। হোক বা না হোক লিখতে ভালো লাগে তাই লিখি। ছবি আঁকা কিংবা মূর্তিগড়ার কৌশলটা জানা থাকলে ওসব কাজও করতাম আর গান শুনতে কার না ভালো লাগে? গান অপছন্দ করেন এমন পাঠক কি আছেন পৃথিবীতে? সবই তো একটার সঙ্গে একটা জড়ানো এবং মেলে না।

হামিদ কায়সার: একজন লেখকের জন্য বইপড়া কতটুকু জরুরি?
শওকত আলী: বই পড়েন না, এমন লেখক কি পাওয়া যায়? আমার মনে হয় না। যদি কোন লেখক বই পড়া বাদ দেন— তাহলে বুঝতে হবে তিনি স্বাভাবিক নেই, পাগল হয়ে গেছেন।

হামিদ কায়সার: আপনার ফেলে আসা দিনগুলোর সঙ্গে যদি এখনকার বইপড়ার সাংস্কৃতিক পরিবেশের তুলনা করেন, তাহলে কি আপনি আশাবাদী হন? না কি—
শওকত আলী: আমার বাল্যকালে কিংবা কিশোরকালে, টিভি ছিল না, ঘরে ঘরে রেডিও-ও ছিল না— সংস্কৃতি চর্চা হতো মূলত বইপড়া দিয়ে এবং যাদের সামর্থ ও সুযোগ থাকত তারা হয়তো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইত অথবা বিশেষ কোনো উপলক্ষে নাটকাভিনয় করতেন— তবে সবকিছুর মূলে ছিল বইপড়া। যথেষ্ট বই পাওয়া যেত না— তবু যা পাওয়া যেত তরুণরা পড়ত। এখন অমন পরিবেশ কি আছে? আমার মনে হয় না। আমি শিক্ষক ছিলাম— শিক্ষক জীবনের প্রথম দিকে ছাত্রদের মধ্যে যে বিদ্যানুরাগ দেখেছি, সে তুলনায় শেষ বেলাতে বলতে গেলে তার কিছুই দেখিনি। আমার মনে হয় না লেখাপড়ার চলটা উঠে গেলে সেটা কারুর জন্য ভালো হবে।

১৬ অক্টোবর ১৯৯৭, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ