দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ২২

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

যতদূর মনে পড়ে, আমার বাবার দেয়া ‘নীতিগল্পগুচ্ছ’ আমার পড়া প্রথম গল্পের বই। তারপরই পড়া শুরু হয় দেব সাহিত্য কুটিরের বই দিয়ে —জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

সেই পঞ্চাশ দশকের শেষদিকে গল্প লেখা শুরু করেছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, অদ্যাবধি লিখে চলেছেন। ষাট দশকটি যেমন বাংলা ছোটগল্পের জন্য এক বিশেষ দশক, তেমনি জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সৃজনশীলতারও এক উতুঙ্গকাল। ষাট দশকে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তসহ বেশ ক’জন রাগী তরুণ মেধাবী কথাশিল্পীর আগমনে বাংলা ছোটগল্পের মেজাজ আমূল বদলে যায়। বিষয়, আঙ্গিক, ভাষা-প্রয়োগে বাংলাদেশের ছোটগল্প একদিকে যেমন আধুনিকতার নতুন মাত্রা স্পর্শ করল, তেমনি শিল্প সার্থকতারও পেল নবরূপ। বলা বাহুল্য, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এই আধুনিক গদ্যশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম এবং বিশিষ্ট একজন। ষাট দশকে প্রকাশিত ‘দুর্বিনীত কাল’, ‘বহে না সুবাতাস’, ‘সিতাংশু, তোর সমস্ত কথা’ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত ‘পুনরুদ্ধার’, ‘উড়িয়ে নিয়ে যা কালো মেঘ’, ‘ফিরে যাও জ্যোৎস্নায়’— এই ছয়টি গল্পগ্রন্থের নামকরণের মধ্যেই পরিচয় পাওয়া যায় তার সময় সচেতনতার। তার ছোটগল্পসমূহ সমকালীন রাজনীতির যে অন্তর্গত প্রস্রবণ, জনমানুষের ক্রোধ, বিষণ্ণতার অনুভূতি যেভাবে প্রতীকের আশ্রয়ে অভিনব চিত্রকল্প এবং ইঙ্গিতের মাধ্যমে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় প্রকাশ পেয়েছে— আধুনিক বাংলা ছোটগল্পে তার তুলনা বিরল। আমেরিকায় দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে বর্তমানে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন।

জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের বিশাল গ্রন্থ সংগ্রহের দিকে তাকিয়েই আঁচ করা যায়, এ মানুষটি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। বিশাল বিশাল শেলফ জুড়ে যে সমস্ত বই শোভা পাচ্ছিল, তার চারভাগের তিনভাগই ভিন্ন দেশীয় সাহিত্য— ইংরেজি ভাষার গ্রন্থ। আর এক ভাগ মাটির ভাষার বই, সে পরিমাণও কম নয়, ওসব বই ঘেঁটেই একজীবন বেশ স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দেয়া যাবে। বইয়ের এই বিশাল সংগ্রহ কিন্তু কেবল জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের নয়, এখানে উল্লেখের প্রয়োজন আরেক গদ্যশিল্পী পূরবী বসু তার জীবনসঙ্গিনী। বিদেশে সুদীর্ঘকাল থাকার প্রভাবটিই পড়েছে লাইব্রেরির উপর— এক দু’বছর তো আর নয়, গুণে গুণে আটাশ বছর তিনি কাটিয়েছেন আমেরিকায়। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম, আমেরিকায় নাকি জীবনটা প্রায় যান্ত্রিক হয়ে ওঠে, সেখানে কি বই পড়ার তেমন সময় পাওয়া যায়?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের জবাব, বই যারা পড়ে, তারা কিন্তু সব জায়গাতেই পড়ে। বই পড়ার সুযোগটুকু অন্তত তৈরি করে নেয়। টেলিভিশন-ভিডিও মিডিয়ার জন্য বই পড়ার প্রবণতা আমেরিকায় হয়তো কিছুটা কমেছে, কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলবো, এখনো সেখানে প্রচুর লোক বই পড়ে। শিক্ষক ছাত্ররাতো পড়ে-ই, সাধারণ লোকেরাও পড়ে।
 
হামিদ কায়সার: আপনি কোন শহরে ছিলেন?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: শেষ পনের বছর নিউইয়র্ক শহরে। এ শহরেই দেখেছি, যারা শহরে থাকে তারা ট্রেনে-বাসে চলার সময় বই পড়ে। অবশ্য অল্পবয়েসী অনেকেই কানে ওয়াকম্যান দিয়ে যাতায়াত করে। বড় বড় বইয়ের দোকানগুলো উঠে গেছে ঠিক-ই, তার বদলে শপিং সেন্টারগুলোতে বইয়ের দোকান হয়েছে ছোট পরিসরে। নিউইয়র্কে বার্নস্ এ্যান্ড নোবলস্-এর বেশ কটি দোকানে কফি শপ-ও আছে। যে কেউ সেখানে নতুন বই-পত্রিকা শেলফ থেকে নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে, আড্ডা দিতে পারে— এসব বইয়ের দোকান থেকে লক্ষ লক্ষ কপি বই বিক্রিও হচ্ছে।

হামিদ কায়সার: এসব কার বই, কিসের বই?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: বেস্ট সেলারস্ তালিকার বইই বেশি। তবু তো, বই বিক্রি হচ্ছে। এটাই বড় কথা। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আগ্রাসন বই পড়ার আগ্রহ এবং উপযোগিতার জন্য হুমকি নয়, এটা তো প্রমাণ হয়ে গেছে। টিভি আসার ফলে তো রেডিও-র অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। উল্টো, আমেরিকায় দেখেছি, রেডিও নতুন করে আরো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে।

হামিদ কায়সার: সেটা কিভাবে?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: আমেরিকায় গাড়িতে রেডিও শোনার প্রবণতা বেড়েছে। রেডিওকে ঘিরে অনেককাল ধরেই অল নিউজ, টকশো খুব হচ্ছে। টেলিভিশন এবং বর্তমানে কেব্ল-এ, লোকাল কেবল্— শতাধিক চ্যানেল আসার পরও তো মুভি থিয়েটারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বড় সিনেমা হল উঠে গেছে, কিন্তু গড়ে উঠেছে এক জায়গায় ছোট ছোট অনেক থিয়েটার। একটি কমপ্লেক্সের ভেতরেই এখন দশটি কি তারও বেশি ছবি দেখার আলাদা ব্যবস্থা আছে— কাজেই মিডিয়ার কোনটিরই এখন মন্দা অবস্থা নেই, বই-এর ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারটি হয়েছে। বই পড়ার আগ্রহ এবং চর্চা ঠিকই আছে। তবে, মার্কেটিং পদ্ধতিটা বদলে গেছে। এখন নানারকম পাল্প ফিকশন, পেপারব্যাক পড়ার প্রবণতাটাই বেশি— ফিকশনের বই-ই বেশি চলে, তবে, প্র্যাকটিক্যাল ওরিয়েন্টেড বই-ও বেশ বিক্রি হয়।

হামিদ কায়সার: প্র্যাকটিক্যাল ওরিয়েন্টেড মানে?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: বাস্তব জীবনে প্রয়োজন হয়, বর্তমান জীবনের সমস্যা—এসব বিষয়ের উপর তথ্য, আলোচনাভিত্তিক বই— এসব বই নানা বিষয়ের ওপর আছে। সেখানে পত্র-পত্রিকাও কিন্তু স্পেশালাইজড হয়ে যাচ্ছে। Life, Look এর মতো জেনারেল সার্কুলেশন ম্যাগাজিনগুলোর এখন চাহিদা নেই। নানা বিষয়ের উপর প্রচুর স্পেশালাইজড ম্যাগাজিন বেরুচ্ছে— আর জেনারেল ম্যাগাজিন একটির পর একটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে।

হামিদ কায়সার: কবিতার বই, সাহিত্যের বইয়ের কি অবস্থা?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: সাধারণ পাঠক কবিতার বই একেবারেই পড়ে না। আমাদের দেশে কবিতা নিয়ে যে রকম হৈ চৈ হয়, ওদেশে ওটা একেবারেই অকল্পনীয়।

হামিদ কায়সার: তাহলে কি ওদেশে কবিতার চর্চা এখন নেই?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: কবিতার চর্চা কি কখনো উঠে যেতে পারে? কবিতা তো শাশ্বত শিল্প। তবে মূলত সাহিত্য-চর্চার সঙ্গে যারা যুক্ত, সাহিত্যের শিক্ষক কি ছাত্র কবিতা পড়েন, কবিতার চর্চা করেন— এর বাইরে খুব একটা কবিতার চর্চা নেই। সাধারণ একজন পাঠককে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘প্রিয় কবি কে?’ তাহলে সে তার পাঠ্য বইয়ে পড়া কবির কথাই বলবে। ছোটগল্প পড়ার প্রবণতাও কমেছে— আসলে, ছোটগল্প সেখানে একটি নতুন আদল নিয়েছে। যাকে Factionalized news story বলে। এতে গল্পের মতন করেই বাস্তবভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। Atlanitic, New Yorker অবশ্য এখনও গল্প ছাপে। তবে ট্র্যাডিশনাল ছোটগল্পের পাঠক কম। ছোটগল্পের আরেকটি নতুন ধারাও গড়ে উঠেছে, যাকে বলা হয়ে থাকে short short story- sudden fiction।

হামিদ কায়সার: তো, আমেরিকায়, সম্পূর্ণ একটি নতুন পরিবেশে আপনার পড়াশোনার অভিজ্ঞতাটা কেমন হয়েছে?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: প্রথম দশ বছর বাংলা সাহিত্য খুব একটা পড়া হয় নি। পড়েছি ম্যাকলুহান অথবা বুরস্টিন কি লারনার। ওখানে গিয়ে আমি প্রথমে মাস্টার্স পিএইচডি করেছি। এর জন্য লেগে গেছে দশ বছর। তাছাড়া ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ছিল, পরে সেখানে বাংলা বই পাওয়ার তো কথাই ওঠে না।

হামিদ কায়সার: তাহলে বাংলা বই তেমন পড়া হয়নি?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: গত কয়েক বছর হলো, তা এই সাত-আট বছর আগে থেকে হবে, বাংলা বই ভালোভাবে পেতে শুরু করি। এখন তো নিউইয়র্কে বাংলা বই পাওয়া কোনো সমস্যাই না। এই একুশের মেলায় যেসব বই বেরোল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সব নিউইয়র্কে পাওয়া যাবে। বিশ্বজিৎ সাহা ‘মুক্তধারা’ নামে, সৈয়দ শহীদ ‘অনন্যা’ নামে বইয়ের দোকান দিয়েছেন। সেসব দোকানে পশ্চিমবাংলা ও এখান থেকে নিয়মিত বই যাচ্ছে, বিশেষ করে এদেশের বড় বড় প্রকাশনা সংস্থার নতুন বই অতি দ্রুত চলে যাচ্ছে। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বজিৎ ওখানে বইমেলা করেন। রবীন্দ্রজয়ন্তী, বাংলাদেশ সম্মেলনসহ বড় বড় অনুষ্ঠানেও বিশ্বজিৎসহ আরও কয়েকজন বইয়ের দোকান নিয়ে যান। এভাবে বই পেতাম। তাছাড়া, নিজেরা এলে বই নিয়ে যেতাম।

হামিদ কায়সার: বই নেয়ার সুযোগটা যেহেতু সীমিত ছিল, তাই, সাধারণত কি কি বই নিয়ে যেতেন এবং অন্যদেরকে দিয়ে সেখানে নিয়ে গেছেন?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ সব শ্রেণির বই-ই নিয়েছি। যখন যে বই বেরিয়েছে, পরিচিতি লাভ করেছে কিংবা আলোচিত হয়েছে- মূলত: সেসব বই-ই নিয়েছি।

হামিদ কায়সার: লেখকদের নাম জানতে পারি?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: সৈয়দ হক, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরীন, মাহমুদুল হক, কায়েস আহমেদ প্রমুখ সকলের বই-ই নিয়েছি। সব কবিদের নতুন কবিতার বই-ও নিতাম। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বইয়ের সম্পূর্ণ সংগ্রহ সম্ভবত ওদেশে একমাত্র আমাদের কাছেই ছিল। আর সাম্প্রতিককালে পশ্চিম বাংলার লেখকদের মধ্যে নাম করতে পারি দেবেশ রায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আবুল বাশার, বুদ্ধদেব গুহ, জয় গোস্বামীর।

হামিদ কায়সার: বিদেশী লেখকদের সাহিত্যও তো পড়েছেন, একই সঙ্গে?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: হ্যাঁ, আফ্রিকান লিটারেচারের প্রতি আমার দেশে থাকতেই দুর্বলতা ছিল। ওখানে আফ্রিকান লিটারেচারের পাশাপাশি ল্যাটিন আমেরিকার লেখাও পড়েছি। কোর্তার্জার, মার্কেজ, চিনুয়া আচেবে, নাগিব মাহফুজ প্রমুখদের লেখা। তবে পেশার প্রয়োজনে পড়তে হয়েছে প্রচুর পরিমাণে কম্যুনিকেশনস-এর অ্যাকাডেমিক গ্রন্থাদি।

হামিদ কায়সার: এই বই পড়ার অভ্যাসটা তো আপনার শৈশব থেকেই গড়ে উঠেছিল?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: হ্যাঁ, শৈশব থেকেই।

হামিদ কায়সার: প্রথম বই পড়ার অভিজ্ঞতা কি মনে পড়ে?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: যতদূর মনে পড়ে, আমার বাবার দেওয়া ‘নীতিগল্পগুচ্ছ’ আমার পড়া প্রথম গল্পের বই। তারপরই পড়া শুরু হয় দেব সাহিত্য কুটিরের বই দিয়ে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘প্রহেলিকা’ ‘রহস্য-রোমাঞ্চ’ সিরিজের বই, তখন আমি কুষ্টিয়ার এক গ্রামে মামাবাড়িতে থাকি, সম্ভবত, ক্লাশ টু থ্রিতে পড়ি, এক মামা কোলকাতা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের বইগুলো নিয়ে আসতেন। এরপর, বগুড়া চলে আসার পর, বই পড়ার স্মৃতির মধ্যে যতটুকু মনে আছে, বড়দার আলমারি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়তাম।

হামিদ কায়সার: কি জাতীয় বই সেগুলো?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: শশধর দত্তের ‘দস্যু মোহন’, নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘কালো ভ্রমর’ ক্লাস নাইন অব্দি এসবই চলতো। ক্লাস নাইনেই প্রথমবারের মতো হাতে আসে উপন্যাস, তখনকার চলতি কথায় নভেল। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘প্রথম প্রেম’। এ সময়ে পুরনো বসুমতী, ভারতবর্ষ পত্রিকা লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করে করে পড়তাম। কিছুকাল পরে বগুড়ায় উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি থেকে একসময় দিনে ২/৩টি বই নিয়েও পড়েছি। উডবার্ন ছিল তখন খুব ভালো লাইব্রেরি। এ সময়ে আমি হাঁটতে হাঁটতেও বই পড়েছি। এ পর্বটা একেবারে কলেজ পর্যন্ত চললো।

হামিদ কায়সার: কাদের কাদের লেখা পড়তেন?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: সমকালীন দেশি এবং বিদেশি লেখকের টলস্টয়, শলোকভ, দস্তয়ভস্কি— তখন প্রগতিপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ায় উদ্দীপ্ত ছিলাম। ঐ-জাতীয় রচনাও অনেক পড়েছি। আর পড়েছি শ্রেষ্ঠ গল্প সিরিজ— সুবোধ ঘোষ, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, গজেন্দ্র কুমার মিত্র, মনোজ বসু প্রমুখের সব শ্রেষ্ঠ গল্প তখনই পড়েছি। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সমরেশ বসু, সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু এসব আধুনিক লেখকদের উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে পড়েছি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস।  

হামিদ কায়সার: শরৎ, বঙ্কিম— এদের লেখা?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: ওহ, শরৎ-বঙ্কিম তো স্কুলে থাকতে থাকতেই অনেক পড়ে ফেলেছিলাম। সেই ‘প্রথম প্রেম’ পড়ার পরপরই। শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’, ‘মেজদিদি’, ‘চন্দ্রনাথ’ স্কুলেই পড়ে ফেলেছিলাম। কলেজে এসে পড়েছি ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’, ‘শেষ প্রশ্ন’ ইত্যাদি। সম্পূর্ণ বঙ্কিম রচনাবলী আমি তখনই পড়েছি। সাংঘাতিক কষ্টের কিশোরকালে যেমন পড়েছি, গভীরভাবে জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত থাকার সময়েও পড়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর পড়েছি বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর, সমরেশ বসু, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা। অবশ্য কলেজে থাকতেই আমি পূর্ব বাংলার সাহিত্যের প্রতিও অনুরক্ত হই। আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবুল ফজল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম প্রমুখের রচনা।

হামিদ কায়সার: বিদেশি সাহিত্যের স্বাদ কখন থেকে পেতে শুরু করেন?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: এই ভার্সিটি থেকেই। এর আগে বিদেশি সাহিত্য যা পড়েছি, তা সবই বাংলা অনুবাদ থেকে। নাইনে ওঠার পর একবার হেডমাস্টার সতীশ নন্দীর উপদেশে লাইব্রেরি থেকে ইংরেজি বই নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের সব সময়ই ইংরেজি বই পড়তে বলতেন। সেকারণেই রবীন্দ্রনাথের গল্প সংগ্রহের ইংরেজি অনুবাদ নিয়েছিলাম, কিন্তু দুই এক পৃষ্ঠার পর আর এগোনো সম্ভব হয় নি। ভার্সিটিতে আসার পর-ই ইংরেজিতে পড়া শুরু করি। এক সহপাঠিনী পড়তে দিয়েছিলেন ব্রন্টির ‘উইদারিং হাইট্স’— নাওয়া-খাওয়া ভুলে বইটি পড়ে শেষ করেছিলাম। এই প্রসঙ্গে বলি, ঢাকায় আসার পর আমি কখনো লাইব্রেরি থেকে নিয়ে বই পড়ি নি, পড়তে পারিনি— কিনে পড়েছি, বন্ধুদের কাছ থেকে এনে পড়েছি, অথচ বগুড়া থাকতে লাইব্রেরি থেকেই বই আনতাম সবসময়।

হামিদ কায়সার: এই যে এত বই পড়েছেন, তার মধ্যে কোন বই আপনাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে, অথবা এত ভালো লেগেছে যে, আপনি সেই বই বারবার পড়েন।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: ডিএইচ লরেন্সের ‘সান্স্ এন্ড লাভারস’, দস্তয়ভস্কির ‘ব্রাদার্স কারামাজভ’, ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, টলস্টয়ের ‘ওয়্যার এন্ড পিস’— আমাকে দারুণভাবে সম্মোহিত করেছে। তৎকালীন ইটালিয়ান নতুন লেখিকা দাসিয়া মারাইনির ‘লুক ব্যাক ইন এংগার’-ও আমাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। জয়েস, হেমিংওয়ে, নবোকভ কাফকা, কামু, সার্ত্রও আমাকে সমানভাবে আচ্ছন্ন করেছে। পরবর্তীকালে করেছে মার্কেজের ‘ওয়ান হানড্রেড ইর্য়াস্ অফ সলিচুড’। আর লেখার জন্যে প্রেরণা পেয়েছি ডিএইচ লরেন্স, দস্তয়ভস্কির কাছ থেকে মডার্ণ ইউরোপিয়ান-আমেরিকান লেখক যাদের পড়েছি, তাদের কাছ থেকে। বুদ্ধদেব বসু, অমিয়ভূষণ, কমলকুমার মজুমদারের কাছ থেকে।

হামিদ কায়সার: সম্প্রতি আপনি কি বই পড়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: কার্ল স্যাগান-এর ‘কনট্যাক্ট’ অরুন্ধতি রায়ের ‘গড অফ স্মল থিংস’। পড়েছি নগীব মাহফুজের উপন্যাস ‘সুগারস্ট্রিট’ আর পড়লাম আরজ আলী মাতুব্বর।

হামিদ কায়সার: সমগ্র?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: ঐ যে পাঠক সমাবেশ যেটা বের করেছে, তারই দু’খণ্ড। কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করছি ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ পড়বার—এটি অনেককাল আগের বই।

হামিদ কায়সার: আপনি পুরনো পড়া বই আবারো পড়েন?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত: বঙ্কিম, শরৎ, বিভূতি, মানিকের জগত দিয়ে যাই প্রায়ই, এক রকম প্যাশনের মতো। ইংরেজিতে লরেন্স, আপডাইক, চার্লস ওয়েব, হেমিংওয়ে, মার্কেজ।

৫ মার্চ ১৯৯৮, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ