নিপীড়িত হৃদয়ের স্পন্দনে কমরেড স্তালিন

মঞ্জুরুল হক

প্রকাশিত : মার্চ ০৬, ২০১৮

১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ মস্কোর উপকণ্ঠে রাষ্ট্রীয় খামার বাড়িতে জোসেফ স্তালিন মারা যান। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, ৭৪ বছর বয়সী স্তালিনের মৃত্যুর কারণ ছিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। কিন্তু খুব শিগগিরই তার মৃত্যুর সাথে সোভিয়েত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের জড়িত থাকার গুজব ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর পরবর্তীকালে নবনিযুক্ত শাসক কর্তৃপক্ষ খোলাখুলি ঘোষণা করে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইনটেলিজেন্স দফতরের তৎকালীন মুখ্য পদাধিকারী লাভ্রেন্তি বেরিয়ার চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন স্তালিন। আসলে কী ঘটেছিল?

২৮ ফেব্রুয়ারি স্তালিন তার খামার বাড়িতে বেরিয়া ও নিকিতা ক্রুশ্চভ কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর কয়েকজন সদস্যকে জড়ো করেছিলেন। কী নিয়ে সেখানে কথাবার্তা হয়েছিল জানা না গেলেও, এটুকু জানা আছে যে, বাক্যালাপ চলেছিল ভোর ৪টা পর্যন্ত। তারপর যে যার গন্তব্যে রওনা দেন আর স্তালিন যান শয্যাকক্ষে। ১ মার্চ মধ্যাহ্নের পর স্তালিনের প্রহরীরা উদ্বিগ্ন হতে শুরু করে। স্তালিন তার মহল থেকে বেরোননি বা কাউকে ডেকেও পাঠাননি। নির্দেশ মতো, না ডাকলে প্রহরীদের স্তালিনের কাছে যাওয়ার অধিকার ছিল না। অবশেষে রাত ১১টার সময় একজন দেহরক্ষী সাহস করে স্তালিনের কাছে গিয়ে তাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। তখনো তার দেহে প্রাণ ছিল কিন্তু বাকশক্তি লোপ পেয়েছিল। সন্ত্রস্ত প্রহরীরা তাকে ডিভানে শুইয়ে বেরিয়াকে ফোন করতে শুরু করল। বেরিয়ার অনুমতি ছাড়া স্তালিনের জন্য ডাক্তারদের কল করা ছিল নিষিদ্ধ। বেরিয়াকে দীর্ঘক্ষণ ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা দফতরের প্রধানকে অতি কষ্টে খুঁজে পাওয়া গেল। তিনি এলেন ও গটগট করে ঢুকলেন সেই ঘরে, যেখানে অচৈতন্য অবস্থায় শায়িত ছিলেন স্তালিন।

স্তালিনের কন্যা স্ভেতলানা আলুলায়েভা তার পিতার জীবনের অন্তিম মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণা করেছেন। মৃত্যুর ঠিক পূর্বক্ষণে স্তালিন হঠাৎ চোখ মেললেন, তাকালেন তাকে ঘিরে থাকা মুখগুলোর দিকে, তারপর বাঁ হাতটা তুললেন, উপরের দিকে অঙুলিনির্দেশ করলেন, নাকি কোনো সঙ্কেত দিলেন! যাই হোক, তার কয়েক মুহূর্ত পরেই স্তালিন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেরিয়ার পক্ষে ক্ষমতা জবরদখল করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৩ সালেরই ২৬ জুন তাকে গ্রেফতার করা হয় ও অনতিবিলম্বে গুলি করে হত্যা করা হয়। কে-জি-বিতে তার ঘনিষ্ঠ সহকারীদেরও খতম করা হয়। দেশের শাসন ক্ষমতায় জোসেফ স্তালিনের উত্তরসূরি হন নিকিতা ক্রুশ্চভ। তিনিই বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সমূলে উৎপাটিত করার পরে বেরিয়া ও তার ঘনিষ্ঠদের স্তালিনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে তাকে হত্যা করার জন্য দোষারোপ করেছিলেন। ততদিনে কে-জি-বির শিখণ্ডী ও তার সাকরেদরা কেউ আর জীবিত ছিল না। সুতরাং তাদের যে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা যেতে পারত।

খুব সম্ভবত আজ আমরা সুনিশ্চিত করে বলতে পারব না, স্তালিন গত হয়েছিলেন বেরিয়ার চক্রান্তের ফলে নাকি তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। অথবা হয়তো বা চক্রান্ত হয়েছিল, কিন্তু তার সংগঠক আদৌ বেরিয়া ছিলেন না। সমাজতান্ত্রিক শিল্পায়নে লেনিনের কর্মসূচি বাস্তবায়িত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেকে একটি পশ্চাৎপদ কৃষিপ্রধান দেশ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শিল্প-সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করেছিল। এমন এক শিল্প-শক্তি অর্জন করেছিল যার দ্বারা নিঃস্বার্থ সাহায্য দেয়া সম্ভব হয়েছিল ইউরোপের জনগণতান্ত্রিক দেশগুলো ও চীনের অর্থনীতি পুনর্গঠিত করতে। এমন এক শিল্প-শক্তি যা ভারত ও অন্যান্য প্রাচ্য দেশকে পূর্বতন সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের দ্বারা চাপানো ঔপনিবেশিক পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছড়িয়ে থাকা কৃষকদের একক জমিজমাকে বৃহৎ যন্ত্রচালিত সমাজতান্ত্রিক খামারে ঐক্যবদ্ধ করার লেনিনের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা হয়েছিল। এসব পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নের জন্য সেগুলোকে নির্দিষ্ট রূপ দেয়ার ও আরও ব্যাপ্ত করার কার্যকরী নেতৃত্বদানে জে ভি স্তালিন এক বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিকাশে স্তালিনের অনেকগুলো তাত্ত্বিক রচনা খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল। এসব রচনায় তার চিন্তার-পাণ্ডিত্যের তুলনাহীন সহজ সরল প্রকাশ, অগ্রণী শ্রমিকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা সঞ্চারে এবং সমগ্র কমিউনিস্ট প্রজন্মকে গড়ে তোলার কাজে বিপুল অবদান রেখেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে মানবসমাজের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল সমস্যার অন্যতম, জাতি সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানকল্পে অবিচ্ছেদ্যভাবে স্তালিনের নাম জড়িয়ে আছে। জাতি-সম্পর্কিত সমস্যা প্রসঙ্গে লেনিনের শিক্ষাকে স্তালিন আরও ব্যাপক ও উন্নত করেছিলেন। জার শাসনে নিপীড়িত জাতিসমূহ নবজীবনে জেগে উঠেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটিয়েছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে জাতিসমূহের একটি পরিবারে পরিণত করেছে।

স্তালিন ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন প্রাচ্যের দেশগুলোর জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি, যে আন্দোলনগুলো ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া সংগ্রামে এক বিপুল বিপ্লবী তাৎপর্যপূর্ণ। সেই ১৯১৮ সালেই এক বিশেষ তত্ত্ব সূত্রায়িত করেছিলেন যার যথার্থতা বিগত ৩৮ বছরের ইতিহাস বহন করে যে অক্টোবর বিপ্লব সৃষ্টি অমর হয়ে থাকবে তার নাম। স্তালিনের শিক্ষা বলে, শান্তি তখনই সুরক্ষিত হতে পারে যদি বিশ্বের জনগণ শান্তির স্বার্থ নিজেদের হাতে তুলে নেয় ও তার জন্য লড়াই করে এবং সারা বিশ্বজোড়া লক্ষ লক্ষ শান্তিকর্মীদের এক নতুন যুদ্ধের প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চালিত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নই হলো আজ শান্তি ও জনগণের মধ্যে মৈত্রীর দৃঢ় রক্ষক।

১ মে, ১৯৪৫ কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লালফৌজ বার্লিনের রাইখ্স্ট্যাগে রক্তপতাকা উড়িয়ে মানবজাতির চরমতম শত্রু ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘোষণা করেছিলেন। এর পরের ইতিহাস পৃথিবীকে বারে বারে চমকে দেয়ার ইতিহাস। গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখল, এক অকুতোভয় যোদ্ধা জাতি কী বিপুল বিক্রমে পৃথিবীকে রক্ষা করল। গোটা পৃথিবীকে এক রক্তপিপাসু জাতির দাসত্ব করা থেকে বাঁচাল রেড আর্মি, বিশেষত কমরেড স্তালিনের ক্ষুরধার বুদ্ধি, অকপট দেশপ্রেম আর জনগণের ওপর অগাধ বিশ্বাস। জানা যায়, যুদ্ধে তার প্রিয় পুত্রকে বন্দি করে জার্মানরা। বন্দি বিনিময় করতে চায় তাদের ফিল্ড মার্শাল ফ্রেডরিখ পউলাসের সাথে। তিনি রাজি হননি। এ একটি ঘটনাই প্রমাণ করে দেয়, স্তালিনের কাছে দেশ আর নিজের সন্তানের মধ্যে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ। লাল ফৌজের সর্বাধিনায়ক স্তালিন বললেন, I will not trade a Marshal for a Lieutenant! যারা গড় চিন্তাধারায় তার ‘স্বজনপোষণ’ নিয়ে কুৎসা করে তারা অবশ্য কল্পনাও করতে পারেনি যে, দেশের জন্য স্তালিন উৎসর্গ করে দেবেন নিজের ছেলেকেই।

দুনিয়ায় শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের সংগ্রাম যতদিন ধরে চলবে, নিপীড়িত হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনে অনুপ্রেরণার স্ফুলিঙ্গ হয়ে রইবেন কমরেড স্তালিন।