নিরুদ্দেশ

উপন্যাস পর্ব ২

সজীব দে

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০১৮

কাকা বলে, সে জানি। সারা জীবন এইসব কথা আমাকে শুনতে হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছিল মরে যাই। তুই বল, এক একটা লোক আলাদা নয়? তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনও মূল্য নেই?
আমি বলি, না।
তোর বাবার কারণে আজ অব্দি বেঁচে আছি।
কাকা একটা প্রশ্ন করবো?
বল
তুমি যুদ্ধে যাওনি কেন?
যুদ্ধে আমার যেতে ইচ্ছে করেনি। আমার অনেক বন্ধু যে সময় যুদ্ধে গিয়েছিল, আমাকেও বলেছিল, কিন্তু মন চায়নি। মন না চাইলে কী করে যাই? যুদ্ধ আমার কাছে বিভীষিকার মতো। এমন ভয়ংকর কিছু তো পৃথিবীতে আর নেই। যুদ্ধকে সমর্থন যারা করে তারা দানব। তাদের প্রধান কাজ হলো পৃথিবীতে যুদ্ধ বাঁচিয়ে রাখা। কারণ এ যুদ্ধের মাধ্যমে তারা অস্ত্র বিক্রি করে। পৃথিবীতে অস্ত্রের ব্যবসার ওপর আর কোনও ব্যবসা নেই। আমেরিকা দানব।
আমি বলি, আমাদের স্বাধীনতা, স্বাধিকার আদায়ের জন্য ৭১ এর যুদ্ধ প্রয়োজন ছিল।
হ্যাঁ। ঠিক তোর কথা। আমি একজন যুদ্ধে যায়নি বলে কি দেশ স্বাধীন হয়নি? হয়েছে। তাহলে?
কাকা, তোমার মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতির নেই?
কাকা চুপ করে থাকে।
বলো?
কাকা তবু চুপ করে থাকে।
আমি উঠে পড়ি। উঠতে উঠতে দেখি, কাকা তার আলমারি থেকে একটা রেডিও বের করছে। পেছন থেকে কাকা ডাক দ্যায়, তরুণ...
আমি ঘুরে তাকাই।
কাছে আয়। বোস।
আমি কাকার মুখোমুখি বসি।
কাকা বলে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঘরে বসে এ রেডিওতে মুক্তিযোদ্ধের রণাঙ্গনের খবর শুনতাম, প্রায় চবিশ ঘণ্টা। ওইসব খবর শুনে রক্ত জ্বলে উঠত। মনে হতো, এখনি চলে যাই। কিন্তু আমি ভীতু ছিলাম। এখনও যেমন। নে, এটা তোর কাছে রেখে দে।
কাকা রেডিওটা আমার হাতে দেয়। সিলভার রঙের রেডিওটা। অনেক ভারি। আমি বলি, এটা দিয়ে কী করবো?
রেখে দে।
বাবা বলেছিল, তুমি নাকি পিকিংপন্থী ছিলে। এটা কি ঠিক?
হ্যাঁ।
তবে কি এটাই তোমার না যাওয়ার প্রধান কারণ?
না।
তবে?
সে কথা আমি বলতে চাই না।
বলো। আমার জানতে ইচ্ছে করছে।
জেনে আর কী হবে?
না, বলো।
আরেকদিন বলবো। তার আগে তোকে আমি একটা গল্প বলি, এটা আমার জীবনের নয়। তবে অন্য অনেকের জীবনের ভয়ংকর সত্যি গল্প। কাকা বলতে শুরু করে, মার্চ মাসের শেষে ভোররাতে যখন অল্প অল্প কুয়াশা মাঠে মাঠে ঝরে পড়ে, গাছের পাতাগুলোতে কুয়াশার আস্তরণ পড়ে শীতের ঝরাপাতাগুলোকে কিছুটা মসৃণ করে তোলে তেমনই এক ভোর। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ। ইলিয়াসের হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায়। কাঁথাটা ভালো করে জড়িয়ে নাকমুখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুম আসে না। তার মনে পড়ে যায়, ২৫ মার্চ রাতের কথা। তার সামনে প্রিয় বন্ধু সুপ্রিয়কে পাকিস্তানি আর্মিরা গুলি করে মেরে ফেলে। ক্রাক ডাউনের রাতে তারা হল ছেড়ে বের হয়ে আসছিল। এলোপাথারি গুলি বর্ষণ চলছিল তখন। কে কোথায় পালাবে বুঝতে না পেরে অনেকে দিশেহারা হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সুপ্রিয়ও দাঁড়িয়ে যায়। একটা গুলি এসে তার ঘাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ে। সুপ্রিয় ঘাড়ে হাত রাখে। ইলিয়াস চিৎকার দিয়ে সুপ্রিয়কে ডাকতে থাকে। সুপ্রিয়র কানে আর সে শব্দ পৌঁছায় না। ঘাড়ে হাত রেখেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ইলিয়াস দৌড়ে আমগাছের এক কোণে বসে পড়ে। এখানে থাকলে সে বাঁচবে না মরবে সে চিন্তাও তার মাথায় আর নেই। দুই হাঁটুর মাঝে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে। আর সুপ্রিয় সুপ্রিয় বলে বিড়বিড় করতে থাকে। ভোর হয়। ইলিয়াস গাছের কোণায় কখন ঘুমিয়ে পড়ে, তার আর মনে পড়ে না। আলো ফোটে। চোখে আলোর রশ্মি পড়লে ইলিয়াসের ঘুম ভাঙে। তার শরীরে কোনো শক্তি নেই যে, সে উঠে এখান থেকে বাসায় যাবে। বেশ কয়েকবার চেষ্ট করে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে। চোখ মেলে চারদিকে তাকায়। এখানে বারুদের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে গেছে। সে ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না। এখানে ওখানে কয়েকশো লাশ পড়ে আছে। সে এত লাশের মাঝে কোথাও কি সুপ্রিয়কে খুঁজে পাবে? বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলে ইলিয়াস উঠে দাঁড়ায়। আগুল দিয়ে চোখের পিঁচুটি মোছে। হলের মাঠের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। যেদিকে পা রাখে, সেদিকেই লাশ। এক একেটা লাশ পেরিয়ে যায় কিন্তু সে সুপ্রিয়র লাশ দেখতে পায় না। ইলিয়াস মনে মনে ভাবে, এই জামরুল গাছটার কাছেই তো বন্ধুটি তার দাঁড়িয়ে ছিল? গাছটি আছে কিন্তু সুপ্রিয়! ইলিয়াস বন্ধুকে না পেয়ে কোনো রকম প্রাণ বাঁচিয়ে বাসায় এসে পৌছায়। বাসায় এসে দেখে সবাই জড়োসড়ো হয়ে এখানে ওখানে বসে আছে। তার মা তসবিহ গুনছে। বাবার মাথায় কালো রঙের টুপি। ইলিয়াস বাবাকে এমন টুপি কখনও পড়তে দেখেনি। তিনিও বার বার সুরা ইয়াসিন পড়ছেন। ছোট ভাই খাটের এক পাশে ঘুমিয়ে আছে। তখনও তার বোন হয়নি। ইলিয়াসের মা মাজেদা বেগম ছেলে জীবিত দেখে আল্লাহর কাছে শুকর আদায় করে জায়নামাজ বিছিয়ে নামজ পড়তে বসে যান। আর ইলিয়াস পাশের ঘরে গিয়ে খাটে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর আজ ২৯ তারিখ। ৪টা দিন সে বিছানা থেকে নামেনি।
মাজেদা বেগম ইলিয়াসের ঘরে আসেন। খাটের উপর ইলিয়াসের মাথার পাশে এসে বসেন।
ইলিয়াস মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে। মাজেদা বেগম মুখ খোলেন। বলেন, বাবাজান এবার ওঠ। শরীর খারাপ করবো। চাইট্টা খাইয়া ল।
ইলিয়াস বলে, মা, সুপ্রিয় নাই।
মা বলেন, তুই যে বাঁইচা ফিরা আইছস আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। আমার বুকের মানিক। আয় বুকে আয়।
মা, সুপ্রিয়র মা কী করবেন?
মাজেদা বেগম কিছু বলেন না। ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। ইলিয়াস হাত সরিয়ে দেয়।
ইলিয়াস বলে,তুমি এখন যাও।
তুই খাবি না?
মা তুমি যাও।
মাজেদা বেগম মন খারাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। নিজের ঘরে আসেন। তিনি দেখেন আজগর শেখ বেশ আয়েশ করে খাটে বসে পান চিবুচ্ছে।
তাকে দেখে বলেন, আসো ইলিয়াসের মা। আমার পাশে বসো।
মাজেদা বেগম আজগর শেখের পাশে এসে বসে। আজগর বলেন, নাও পান খাও। আজগর শেখ পান বাড়িয়ে দেন স্ত্রীর মুখে।
মুখ কালা কইর‌্যা আছো ক্যান?
পোলাডা চাইরদিন ধইর‌্যা কিছু খাইতাছে না।
খিদা লাগলে খাইবো।
হাসতে হাসতে আজগর শেখ মাজেদার বেগমের হাত ধরে। মাজেদা বেগমের মনে হয় বাসর রাইত্যে যেমুন কইর‌্যা হাত ধর ছিল তেমন। কিন্তু মাজেদা বেগম হাত সরাতে ইচ্ছা হলেও সরায় না। মাজেদা বেগম বুঝতে পারে না আজগর শেখের এত খুশির কারণ কী?

চলবে...