অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

নিরুদ্দেশ

উপন্যাস পর্ব ৪

সজীব দে

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২১, ২০১৮

জুনের মাঝামাঝি। আজগর শেখ অর্থাৎ ইলিয়াসের বাবা আর তার রাজাকার বাহিনী হঠাৎ করেই তৎপর হয়ে ওঠে। খুঁজে খুঁজে হিন্দুদের বাড়িতে হানা দেয়। বলে যে, তারা যদি এ দেশ ছেড়ে না যায় তবে সে বাধ্য হবে তার বাহিনী দিয়ে ধরে ধরে জোয়ান মেয়েদের পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতে। সে আরও বলে, তার ওপর নির্দেশ আছে, যেসব পরিবারে জোয়ান যুবক আছে তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলার। আশ্চর্যের বিষয়, একটা সময় ছিল এই শশিমোহন বসাক লেনে, যখন হিন্দু-মুসলাম মিলেমিশে ছিল। আর হিন্দুরাই ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। আজ হিন্দুরা যেন নিজ দেশে পরবাসী। তাদের কোনো ঠিকানা নেই। তারা কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, তা অজানা।
আজগর শেখ চলে গেলে কেউ কেউ ভাবে, আজগরের বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। কেউ কেউ একমত হলেও বেশির ভাগ পরিবার শশিমোহন বসাক লেনের পৈতৃক নিবাস ছেড়ে অজানা গন্তব্যে রওনা দেয়। যারা থেকে যায়, কোনো একরাতে আজগর শেখ হঠাৎ তার বাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে হিন্দু বাড়িগুলোতে লুণ্ঠন ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেসব পরিবারকে একেবারে নিঃশ্চিহ্ন করে দেয়। অবশেষে আজগর শেখ সেসব বাড়ির দখলদারিত্ব নিয়ে নেয়। আর ওখানে গড়ে তোলে পাকিস্তানি ক্যাম্প, টর্চার সেল আর রাজাকার বাহিনীর আমোদফুর্তির খোলামেলা আস্তানা। এভাবে রাজাকার বিহারী মুসলমান পুরান ঢাকার ঠাটারি বাজার,বংশাল, মাহুৎটুলি ও লালবাগসহ আরও অনেক জায়গা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।

ছোটনের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। শোনা যায়, সে যুদ্ধে গেছে ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। সুরনাথের মনে হয়, শশিমোহন বসাক লেন যেন এক মৃত্যুপুরী। তার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই। সে মরে গেলেই বা কি। মেয়েটার কী হবে! তিনি নিজেও জানেন না। স্ত্রী লক্ষ্মীরানি বিছানায় শয্যাশায়ী। তার বাড়িটাও যেন শ্মাশানের মতো নিস্তব্ধতায় ঘিরে আছে। সুরনাথ দিনের প্রায় সময় বারান্দায় বসে কাটিয়ে দেয়। এদিক ওদিক আর তাকায় না। পাহারাদারের মতো একটা চেয়ার নিয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে ঝিঁমুনি আসে, তবুও বসে থাকে।
অগাস্টের মাঝামাঝি সময় আজগর শেখ সিদ্ধান্ত নেয়, সুরনাথকেও এ এলাকা থেকে বিতাড়িত করতে হবে। না হলে মেজর সাবের কাছে সে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারবে না। অনেকের কাছেই তার শুনতে হচ্ছে, তিনি কেন সুরনাথের বাসায় আক্রমণ চালাচ্ছেন না। ছেলের বন্ধুর বাড়ি দেখে মাফ পাবে, তা রাজাকার নীতির মধ্যে পড়ে না। এতে রাজাকারের মহত্বই নষ্ট হয়ে যায়। রাজাকার উপাধি তার জীবন বদলে দিয়েছে। তিনি মনে করেন, তিনি আল্লাহর হুকুম পালন করছেন। তার মধ্যে এক ধরনের আত্মতৃপ্তির ভাব এসে পড়েছে। শশিমোহন বসাক লেনের রাজা এখন তিনি। এও আল্লাহর মেহেরবানি।
আজগর শেখ অগাস্টের ২৪ তারিখ ভোরে সুরনাথের বাসায় আসেন। তিনি দেখেন সুরনাথ বারান্দায় চেয়ারে বসে পুরানো খবরের কাগজ পড়ছে। তিনিই এতদিন সুরনাথকে দেখে রেখেছেন কারণ সুরনাথের ছেলে তার ছেলে ইলিয়াসের বাল্যবন্ধু। কিন্তু এখন আর সময় নাই। তাকে এলাকা ছেড়ে যেতেই হবে। তা না হলে রাজাকার হিসেবে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। নানা জন নানা কথা বলবে। তা তো হতে দেয়া যায় না।
আজগর শেখ ডাকেন, সুরনাথ?
সুরনাথ চোখ তুলে তাকায়।
কী খবর তোমার? শোনলাম তোমার ছোড পোলাডা মুক্তি অইছে। তা ভালা কতা।
সুরনাথ চুপ করে থাকে। মায়া আজগর শেখের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। আজগর শেখ মায়ার দিকে এক পলক তাকায়।
মাশাল্লা, তোমার মাইয়া তো বড় ডাঙর হইছে। বিয়াশাদি দিয়া দাও। তো তোমার শরীলডা ভালা তো? ভাবিসাব কই, দেহি না যে?
বসো আজগর।
না বইতে আহি নাই। বহুতদিন তোমাগো দেখভাল করছি। এহন আর সম্ভব না। দুই চাইর দিনের মইধ্যে এ বাড়ি খালি করবার লাগব। মেজর সাবের হুকুম। উনি নিজে এই বাড়িতে থাকবো। ওনার কতা ফালা তো গুনাহর কাজ। আল্লাহর কাছে আমি কী জবাব দিমু?
সুরনাথ চুপ করে শুনছিল। মায়া দরজার পাশ থেকে শুনছিল সব কথা। কিন্তু কোনো উত্তর দেয়নি।
আজগর শেখ বলে, কী কও?
সুরনাথ এবার মুখ খোলে। বলে, তোমার যা করবার ইচ্ছা হয় কর মাগার আমার বাড়ি ছাইড়্যা আমি কোনোখানে যামু না। ইডা আমার শেষ কতা।
আজগর শেখ হাসে। আজগর শেখের পিছনের তার চ্যালা চামুণ্ডারাও হেসে ওঠে।
বাহ্ ভালা কইছ! আমার কতা শুইনা রাখো আল্লাহর পাকিস্তানে কোনো হিন্দু থাকবার পারব না। বুঝবার পারছ?
এমন সময় ইলিয়াস সুরনাথের বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায়। আজগর শেখ একটু থতমথ খায়।
ইলিয়াস বলে, আব্বা তুমি? কী অইছে?
না কিছু না। কইলাম আর কি জোয়ান মাইয়্যা ঘরে, এহানে থাকা নিরাপদ অইব না। মেজর সাবের চোখ পড়ছে। ইডা কইতে আইলাম।
ইলিয়াস বলে, এহানে থাকবার না পারলে আমাগো বাসায় আইয়া থাকবো।
সুরনাথ বলে, ইডা কী কও বাবা নিজের বাড়ি থুইয়্যা তোমাগো বাড়ি থাকমু?
হ কাকা।
না বাবা তা অয় না।
কাকা চিন্তা কইরেন না সময় একদিন আইবো। নিজের বাড়িতে আবার আইসা থাকবেন।
আজগর শেখ আর কোনো কথা না বলে সুরনাথের বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সুরনাথ বিড়বিড় করে বলতে থাকে না আমার বাড়ি ছাইড়্যা আমি কোনখানে যামু না। ইলিয়াস এই বিড়বিড় করা কথা কানে না নিয়ে বলে, এহানে থাকলে কাকা বাঁচতে পারবেন না। তার চাইতে আমাগো বাড়ি লন।
এই বলে ইলিয়াস কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। চেয়ে দেখে মায়া দরজায় হেলান দিয়ে দঁড়িয়ে আছে। ইলিয়াস মায়ার দিকে এগিয়ে যায়।
ইলিয়াস বলে, তোর লগে কথা আছে। ছাদে চল। মায়ার হাত ধরে ইলিয়াস তাকে ছাদে নিয়ে আসে।
ইলিয়াসকে খুব অস্থির লাগছে। এমন অস্থিরতা কখনও মায়া ইলিয়াসের মাঝে দেখেনি। যা আজ সে দেখছে।
মায়া বলে, কী বলবেন?
বাবার চোখ পড়ছে তোর দিকে? বুঝছস?
তার ছেলের পড়ে নাই? বলে হাসতে থাকে মায়া।
এটা হাসির কথা না মায়া। আজ হোক কাল হোক এ বাড়িতে তারা হামলা করবো। তখন তোরা কেউ বাঁচতে পারবি না। তুই আমার সাথে চল।
না। আমি বাবা মাকে রেখে একলা যেতে পারবো না। যা হবার হবে।
এইসব ছেলেমানুসি কথা রাখ মায়া। এখন এগুলা বলার সময় না।
বল্লাম তো আমি যামু না।
ইলিয়াস হাল ছেড়ে দেয়। বলে, আচ্ছা তোদের যা ভালো লাগে কর। এই এলাকায় কিন্তু আর হিন্দু পরিবার নাই।
বলে, দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়ে ইলিয়াস।

চলবে...