‘পথের পাঁচালী’ অনন্য জীবনের প্রতিচ্ছবি

খালিদ সাইফুল্লাহ ফয়সল

প্রকাশিত : আগস্ট ১৪, ২০১৮

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস হলেও পড়ার সময় একটিবারের জন্যও মনে হয় না, এটা উপন্যাস। বরং লেখকের স্বচ্ছ-সাবলীল ভাষায় গ্রাম-বাংলার বাস্তব ও জীবন্ত ছবিটিরই একটি সহজ-স্বাভাবিক রূপ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

যখন একজন পরিচারিকা তার জীবনের শেষদিনে চলে আসে, তখন তার সামাজিক পরিস্থিতি কেমন হয়? যখন কোনো নারী অল্পবয়সে স্বামীহারা হয় এবং সমাজ তাকে আবার বিয়ে করার অনুমতি দেয় না, তখন সেই নারীর সামাজিক অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়? এসব প্রশ্নের উত্তর অত্যান্ত নিখুঁতভাবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে রয়েছে।

এ উপন্যাসের প্রথম অংশে আমরা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি বাল্যবিবাহ ও যৌতুককে দানবীয় আকার ধারণ করতে দেখি। ইন্দির ঠাকুরনের বিয়ে অল্পবয়সে এমনই এক লোকের সাথে দেয়া হয়, যে বেশি যৌতুকের লোভে অন্যত্র বিয়ে করে এবং আর কখনও ফিরে আসে না। তখন আয়হীন ইন্দির ঠাকুরনের আবাসস্থল হয় তার পিতার বাড়িতে, এবং তাদের ও তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হরিহরের বাড়িই তার স্থান হয়।

সেখানে প্রতিমুহূর্তে তাকে মনে করিয়ে দেয়া হয়, সে একজন আশ্রিত। করুণার পাত্রী। সে প্রায়শই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত। কিন্তু দিনশেষে তার পথ এসে শেষ হতো হরিহরের বাড়িতেই। একবার ঘটনাক্রমে বাড়ি থেকে তাকে একেবারে বের করে দেয়া হয় এবং মর্মান্তিকভাবে তার জীবনের ইতি ঘটে। মৃত্যু হয় অসহায়ত্বের।

এ উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ ‘আম আঁটির ভেঁপু’-এ অত্যন্ত সুচারুভাবে হরিহরের সন্তানদ্বয়, বড়মেয়ে দূর্গা ও ছোট ছেলে অপুর টক-মিষ্টি সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়া বলতে গেলে অনেকটা অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়বো। কারণ, বইটির প্রতিটি অংশের মাঝে মানবজীবনের উপখ্যানকে লেখক এক অনন্যরূপ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। এমনকি, উপন্যাসের শেষ অংশ ‘অক্রুর সংবাদে’ চিরাচরিত বাংলার বড়লোক-গরিবের বৈষম্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

লেখক সাফল্যের সাথে দেখিয়েছেন, একজন ব্রাক্ষ্মণ নারীর (সর্বজয়া) কী অবস্থা হয়, যখন অর্থের জন্য তাকে কাজের লোকের কাজ করতে হয়। দূর্গার মৃত্যুর পর তারা গ্রামত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। সেখানে এক পর্যায়ে জ্বরে স্বামী হরিহরও মারা যায়। তার চোখের অশ্রু মোছার জন্যও কেউ ছিল না। সবাই তার কষ্টের সুযোগ নিতে চায়। সাহায্যের হাত কেউ বাড়ায় না। অবশেষে সে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ছেলে অপুকে নিয়ে তার নিজ গ্রাম নিশ্চিন্দিপুরের পথে রওনা হয়। কিন্তু সে তার সঠিক পথ খুঁজে পায় না।

বলা বাহুল্য, এই সামাজিক বৈষম্য আজকের একবিংশ শতাব্দীতে এই উন্নত সমাজেও পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত এ উপন্যাস আদি ও বর্তমান সামাজিক উত্থান-পতন ও সামাজিক কুসংস্কারের প্রতিচ্ছবি। সাহিত্যপ্রেমীদের এই অনবদ্য উপন্যাসটি পড়ার সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

একুশে বইমেলা ২০১৮