পাকিস্তানিরা খুঁজছে মাওলানা কোথায়, মাওলানা জনতার মাঝে

ফিরোজ আহমেদ

প্রকাশিত : মার্চ ২৬, ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকল্প বলতেই মনে আসে, ঢাকায় গণহত্যা আর গ্রেফতারের কথা শোনা মাত্র বয়োবৃদ্ধ মাওলানা ভাসানীর পায়ে হেঁটে আসামের উদ্দেশে যাত্রা। যেন তিনি পাকিস্তানিদের হাতে ধরা না পড়েন। যেন মানুষের মনোবল ভেঙে না যায়। তার বয়স তখন ৭০ কিংবা আশি। ঠিক-ঠিকানা নেই...

এই দৃশ্যটা এঁকেছিলেন সৈয়দ ইরফানুল বারী, তার যাত্রাসঙ্গী। ক্রুদ্ধ পাকিস্তানি সেনারা সন্তোষে মাওলানার কুড়েঘরটা ছাই করে দিয়ে তাকে খুঁজতে নেমেছে গ্রেফতার করার জন্য। পথে পথে দগ্ধ গ্রাম, পলায়নপর অসংখ্য মানুষ। একবার দুবার মাওলানার দেখাও পেল হানাদাররা, কিন্তু অতিচেনা মুখটাকে আলাদা করতে পারলো না আরও বহু গ্রামীণ বৃদ্ধের চেহারার সাথে। সেই তালপাতার টুপি, সেই ঢোলা পাঞ্জাবি তো আরও বহু মানুষেরই পরিধান। কেউ চিনিয়েও দিল না, ধরিয়ে দিল না তাকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা খুঁজছে মাওলানা কোথায়, আর জনতার মাঝে মিশে পায়ে হেঁটে মাওলানা চলেছেন আসামের পানে।

পথে এক দরিদ্র চাষি অনুনয় করলেন তার বাড়িতে একবেলা দাওয়াত নিতে। সামান্য ভাত আর সালুন তিনি আয়োজন করতে পেরেছেন, তাই তৃপ্তির সাথে খেতে খেতে তিনি সঙ্গী ইরফানুল বারীকে বলছেন, ‘সৈয়দের বেটা, ভাত কম চিবায়ে খাও। পেটে বেশিক্ষণ থাকবে।’

এই হলো মুক্তিযুদ্ধের গল্প, আর উত্তর দিগন্তে যমুনা নদী ধরে মিলিয়ে যেতে থাকা মাওলানা ভাসানীর মুক্তিযুদ্ধের চিত্রপট। মাওলানাকে বিদায় দিয়েছেন, সঙ্গী হতে পারেননি সৈয়দ ইরফানুল বারী, ভারতে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল, যেমন যেতে পারেননি হায়দার আনোয়ার খান জুনোরা। নরসিংদীতে তারা পুরোটা সময়জুড়ে এক অকুতোভয় প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়েছিলেন, কোনও স্বীকৃতির পরোয়া না করে। ভারতে যাবার আগে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তাদেরকেই ব্যবহারের জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত গাড়িটি। ভারতে পুরোটা সময়ই ব্যাপক প্রতিকূলতার মাঝে কাটিয়েছিলেন জহির রায়হান, তার অমর কীর্তি স্টপ জেনোসাইড যে বিরূপতার মুখে পড়েছিলে খোদ কোলকাতায়, তার বিবরণ মিলবে মুশতারী শফির স্মৃতিকথায়। জুনোদের সাথেকার আর যারা প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে গিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ খুন হয়েছেন কিংবা আটক হয়েছেন। দেশের বহু অঞ্চলে এরাই গঠন করেছিলেন মুক্তাঞ্চল, পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নিয়েই। এই হলো মুক্তিযুদ্ধ নামের আখ্যানটির জটিলতা। কোনো উপন্যাসে আছে এই সংঘাতের ছাপ? জহির রায়হানকে নিয়ে কত কত লেখা, প্রায় সকলেই এড়িয়ে যান তার মতাদর্শিক পরিচয়। মাওলানা ভাষানীও যে পুরোটা সময় ভারতে অন্তরীণ ছিলেন, সেই জটিলতাকে ধারণ না করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা অসম্ভব।

মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে ভালো চলচ্চিত্র কেন হয় না, কেন হয় না মহৎ উপন্যাস, তার কারণ আসলে এই্খানে। কতগুলো গৎবাঁধা মোটাদাগের গল্পকাঠামো। বহু সত্য, বহু বাঁক এড়িয়ে একতরফা ইতিহাসের সরল এবং একরৈখিক একটা বর্ণনায় যে ফাঁক থাকে, অসত্য আর অতিরঞ্জন দিয়ে তা পূরণ করতে হয়। এই সব অক্ষম সাহিত্যের সমাপ্তি হয় জীবনযুদ্ধে পরাজিত মুক্তিযোদ্ধার দৃশ্য এঁকে তাকে দিয়ে কি পাইলাম, তার আক্ষেপ দিয়ে। আর এই আক্ষেপকে পুঁজি করে লুটেরাদের মুক্তিযুদ্ধ বাণিজ্য চলে, চলে চাকরি-বাকরির সংরক্ষণের রাজনীতি।

খুলনা শহরের যে তরুণকে হাসান আজিজুল হকও `গুরু` নামে ডাকতেন, অসম সাহসী পা-বাঁকা সেই রাজনৈতিক কর্মীর বাহিনীতে সরাসরি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করা বহু নারী যোদ্ধা ছিলেন। লুঙিতে কাছা মেরে যারা পুরুষের সমকাতারেই থেকে জলাভূমিতে গলা ডুবিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যভর্তি নৌযানের জন্য ফাঁদ পেতে অপেক্ষায় থেকেছেন। শিল্পী কৃষ্ণকলি ইসলামের মা তেমন একজন নারী। হাসান আজিজুল হকের বিবরণে `গুরু` কেমন কাটখোট্টা ছিলেন, তার বিবরণ আছে, কিন্তু কিসের গুনে `গুরু` অজস্র তরুণ-বৃদ্ধ নারী-পুরুষ রাজনৈতিক কর্মীকে আকৃষ্ট করেছিলেন, তার বিবরণ ঠিক মেলে না। তাদের যে অজস্র গল্প খুলনা-যশোহর-সাতক্ষীরায় লোকমুখে শুনি, কোনো নাটকে তার প্রতিফলন তো দেখিনি।

এই কারণেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বেশ অনেকখানি পেরেছিলেন। এই কারণেই আসছে যারা, তাদের লিখবার অপেক্ষায় আছে সত্যিকারের গণযুদ্ধের ইতিহাস। মালমশলা সকলই থরে থরে সাজানো আছে, পুরস্কার আর অনুদানের মোহমুক্ত সাহিত্যকর্মীরা যখন সেই ভাণ্ডারের দিকে ফিরে তাকাবেন, মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য আর চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের আক্ষেপ ঘুচবার দিন তখন নিশ্চয়ই আসবে। তার আগপর্যন্ত অনুদান, এবং প্রতিদানে মোসাহেবির রাজত্ব চলবে শিল্পসাহিত্যে।

(পুনঃপ্রকাশ)