অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

পাপিয়া জেরীনের গল্প ‘অসংবৃতা’

প্রকাশিত : অক্টোবর ০১, ২০১৮

পিয়ার্সিংয়ের জন্য আমরা যে দোকানের সামনে দাঁড়ায়ে আছি তার নাম হেমলক। আমরা বলতে আমি আর ধ্রুব। আম্মু ভিতরে গেছে, সে নাভিতে দুল পরবে। গত সন্ধ্যায় আমরা বসুন্ধরা থেকে দুল কিনে আনছি, সেই দোকানটার ভেতরেই আবার পিয়ার্সিংয়ের জন্য ছোট্ট একটা স্পেস দেখলাম। কিন্তু আম্মু এ্যালিফ্যান্ট রোডের এই দোকানেই আসবে। আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করতেছিল ভিতরে গিয়ে। কিন্তু আম্মু ঢুকতে দিল না। ধ্রুব একের পর এক সিগারেট ধরায় যাইতেছে, চাইলে আমিও দুইটা টান দিতে পারি। কিন্তু আম্মুর নাক সরস। সে কিছুই বলবে না, কিন্তু কুকুরের মতো হুসহুস করে গা শুঁকবে। বলবে, মায়ের বন্ধুর থেকে সিগারেট শেয়ার নিছো, যেটা আমি আমার জীবনেও করতে পারতাম না। দ্যাখো কতো স্বাধীনতা আমি দিই তোমাকে। এক্চিলি আমি তোমার বন্ধুই, পপ্সি! তুমি যখন আমার পেটে, তখন আমার বয়স পনের। চিন্তা করো, তোমার চেয়ে দুই বছরের ছোটো যখন, তখন আমি বিশাল এক পেট নিয়ে ঘুরতেছি। ভাবো!

...এই হলো আমার মা। সব সময় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং। আচ্ছা, সে যদি কিশোরী অবস্থায় বাপের বয়সী কারো সাথে পলায়ে বিয়ে করে, তারপর যদি কনসিভ করে, সেইটা কার দোষ! আমার খুবই হাসি পায়, যখন আম্মু বলে, তুমি আমার থেকে কত বছরের ছোটো হবা? ধরো পনের বা ষোলো! আচ্ছা, কেন বলে আম্মু এইগুলা? অথচ আজকে যখন বললাম, দেখো আম্মু, আমার বয়সে তোমার দুইবছরের একটা বাচ্চা ছিল। আর এইদিকে আমি একটা ট্যাটু করতে চাই, তুমি পারমিশন দিলা না। এইটা কেমন কথা, তখন সে মুখ কালো করে ফেললো।

আর এইদিকে ধ্রু সকাল থেকে জ্বালায়ে মারতেছে। সে খিক্খিক্ করে হাসে আর বলে, ওয়াও দারুণ! নোরা ফাতেহির মতো লাগবে তোমাদের দুইজনকে। মা আর মেয়ে দুজনেই বেলী ড্যান্স করবা। পপ্সি, তুমিও দুল পরো। যাও!

আরে কী বলো তুমি! মা-মেয়ে দুজনেই নাভিতে দুল পরে ঘুরতেছি, এইটা হইলো কিছু?
তুমি দেখি মান্ধাতার আমলের চাচিদের মতো কথা বললা। ওকে পিয়ার্সিং না হোক ট্যাটু করো। ঘাড়ে বা কোমরে।
ধ্রু কী সব বলো তুমি? হাহ্!
ঠিকই বলি, তুমি কি এখনও ছোট্ট বেইবি?

ধ্রুব ঠিকই বলে। আসলে আমারও খুবই ইচ্ছা করতেছে নাভি ফুটা করতে। কিন্তু কিচ্ছু করার নাই। আর আমি দুল পরলে দেখবে কে? সবসময় টিশার্ট আর জিন্স পরি। চুল ছোটো, স্পাইকি। এই লুকের সাথে নাভির দুল? অবশ্য লুক কোনো বিষয় না, এই যে ধ্রুব, ফাটা জিন্স, গলায় পু্তির মালা আর হাতে শাখা নিয়ে ঘোরে। সে যখন তানপুরা নিয়ে বসে খুব হাসি পায় আমার, কিন্তু গাইতে শুরু করলে ওর পোশাকটা তখন ম্যাটার করে না।

আচ্ছা,এতক্ষণ লাগবে কেন? টুশ্ করে একটা ফুটা করে দেবে, এইতো! বিরক্ত লাগতেছে আমার। ধ্রুবর পাশ ঘেষে বসলে ভালো লাগতো। সারাক্ষণ স্মোক করে যারা তাদের শরীরের ঘাম আর ধুঁয়া মিলে একটা দারুণ গন্ধ হয়। কিন্তু ওর পাশে গিয়া বসলেই আঙুলে সিগার ধরায়ে দিবে। আমার কেমন জানি টেনশন হইতেছে। আচ্ছা আব্বু কী সিন ক্রিয়েট করতে পারে সেইটা নিয়ে ভাবা যাক। ধ্রুব প্রতি শুক্রবার বাসায় এসে গান করে, আমার সাথে তবলা সঙ্গত করে, এইটার জন্য বাবা একদিন আম্মুকে বলেই ফেললো, আচ্ছা বুঝলাম ধ্রুব আমাদের বাড়ির ছেলের মতোই, তোমার ও সাজ্জাদের ছোটবেলার বন্ধু, মানলাম। ওর সামনে তোমার ওড়না থাকে গলায়, নয়তো শাড়ির আঁচল ঢইলা পরে। আর মেয়ে তো বড় হইছে, ওহ্ সে তো মেয়ে না। তারে তো ছেলে বইলা ভ্রম হয়। তার চুলের এই দশা ক্যান? দেখলে তো মনে হয় বটি দিয়া চুল কাটছে।

বাবা খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে হাস্যকর আর অশ্লীল কথা বলতে পারে। আমি সেদিন হাসতে হাসতে মরি। বাবা বলে, পপ্সি, তোমার সমস্যাটা কী, মা! মেশিনে চুল আটকায়ে গেছিলো?

আমি বুঝি না, এই লোকটার কাছ থেকে আম্মু কেমন করে তার নাভির দুল লুকাবে। বাসায় দারুণ ঝামেলা হবে মনে হইতেছে। খুব ঘুম পাইতেছে আমার। গত তিন রাত ধরে ঘুমটুম নাই। বাবা নয়দিনের জন্য থাইল্যান্ড। বাসায় আমরা তিনজন, আমি-আম্মু-ধ্রুব। অবশ্য ধ্রুবর বিষয়টা বাবাকে জানানো হয় নাই। রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত আমরা মুভি দেখি, তারপর যার যার রুমে। ধ্রুব আমাদের বাসায়, এই এক্সাইটমেন্টেই ঘুম আসে না আমার। এখন ইচ্ছা করতেছে ধ্রুবর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমায় যেতে।

দুই.
ধ্রুব প্যাসেজে বসা, ওর হাত জড়ায়ে ধরে পপ্সি হা করে ঘুমাইতেছে। ধ্রুবর খুব অস্বস্তি, পপ্সির বুবস্ ওর হাতে ঠেস্ দেওয়া। এই দৃশ্য যদি নীলা এসে দেখে তাইলে ওর খবরই আছে। তাছাড়া পপ্সির আচরণেও কোনো ঝামেলা আছে মনে হয়। ও কি প্রেমে পড়লো নাকি! নীলাকে বিষয়টা জানানো জরুরি। ধ্রুব আর নীলার যে রিলেশন তা পপ্সি আঁচ করতে পারে নাই। ধ্রুব এই বিষয়ে খুবই সতর্ক। কিন্তু নীলাই প্রতিনিয়ত উল্টাপাল্টা কাজ করতেছে। গতকাল যখন ও পপ্সির সাথে তবলায় সঙ্গত করতেছিল, তখন নীলা পেট বের করে সোফায় শুয়ে বারবার ইশারা করতেছিল। নীলার বুক থেকে নাভি ক্রস করে নিচের দিকে সরু লোমের একটা রেখা দেখা যায়। ধ্রুবর চোখ বারবার আটকায়ে যাইতেছিল সেখানেই। তখন পপ্সি বললো, আম্মু ঠিক হয়ে শোও।

পপ্সি! ওঠো! চলো গাড়িতে দিয়ে আসি তোমারে।
হু।
হু হু করো পরে। চলো। এই পপ্সি, গতরাতেও মনে হলো ঘুমাও না তুমি। আগের রাতেও তো! এই পপ্সি!

তিন.
আমি কী করবো এখন? আম্মুর রুম ভেতর থেকে লক করা। রুমের সামনে ধ্রুবর স্লিপার। ধ্রুব আম্মুর রুমে। বিশ্বাস হইতেছিল না, তাই বারবার গেস্টরুমের বাথরুম আর বারান্দা চেক করে আসছি। সেখানে কেউ নাই। ভোর চারটা, আমি কি রেয়াজ করতে বসবো? কী গাইবো? ভীমপলশ্রী? কালকেই শিখছি, মানে ধ্রুব তুলে দিছিলো। বললো কতো সুন্দর করে, নিসা গারেসা, পানিসা... এইটা দিয়েই নাকি এই করুণ রাগটার আসল পরিচয় মেলে। পানি-সা এর মধ্যে `নি-পা` `নি-পা`র যে ঢেউ, এইটা পৃথিবী থেকে আত্মারে উপরে ঠেলে দেয় আর শরীরকে মাটির দিকে।

আচ্ছা আমি এখন কী করবো? আমার বারান্দায় আম্মুর একটা শাড়ি। এই সুন্দর শাড়িটা দিয়ে ফাঁসি দিলে আম্মু খুব কষ্ট পাবে। বাবা বেনারস থেকে এনে দিছিলো আম্মুকে। শাড়িটা তো আর পরা হবে না তার। শাড়িটার জন্য আম্মুর একটা ব্লাউজ আছে কুশিকাঁটার। ওইটা পরলে আম্মুর ধবধবা শরীর উঁকি দেয় ফাঁকে ফাঁকে।

রিডিং টেবিলের উপর চেয়ার দিয়ে দাঁড়ানো আমি। পা হালকা কাঁপতেছে। শাড়িটায় এখনও আম্মুর গন্ধ। আমার কিছু মনে আসতেছে না, মাথার ভেতর শুধু পা-- নি-- সা, পা--নি--সা। একটা তরঙ্গ, একটা তরঙ্গ শুধু।