প্রকাশক ও কবি সৈকত হাবিবের সঙ্গে গপসপ

ওমর সাঈদ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৮

সৈকত হাবিব একজন কবি ও প্রকাশক। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকগুলোতে। এখন প্রকাশনাকেই জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তরুণ কবি ওমর সাঈদ তার সঙ্গে মেতে উঠেছিলেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপে।

সাঈদ: এবার বইমেলায় প্রকৃতি থেকে কতটি বই বের হয়েছে?
সৈকত: সংখ্যার গুরুত্ব আমার কাছে কম। তবুও আমাদের এখানে একটা সংস্কৃতি আছে, কতগুলো বই বের হলো। আমরা বলবো যে, সম্পাদনা করে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পর যখন পরিতৃপ্তি বোধ করবো, সেগুলোই আমরা আনতে চেষ্টা করেছি বইমেলায়। ত্রিশটির মতো বই এবার প্রকৃতি থেকে বের হয়েছে কিংবা হবে। প্রেস জটিলতার কারণে সব বই মেলায় ধরাতে পারিনি। কিছু বই মার্চেও বের হবে। হয়তো দেখা যাবে, শেষপর্যন্ত কিছু বই কমিয়ে দেব। কারণ আমরা কোনোভাবেই বইমেলার জন্য তাড়াহুড়ো করে বই প্রকাশের পক্ষে নয়।

সাঈদ: প্রকৃতি যে বইগুলো এবার নিয়ে আসছে, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো কি কি?
সৈকত: এবার একজন কৃষিবিজ্ঞানীর আত্মজীবনী আমরা এরই মধ্যে প্রকাশ করেছি। বইটির নাম, জীবনের প্রান্তরে। এরপর ‘নীরার সংগ্রাম’ নামে একটা বই আসছে। বইটিতে একজন নারীর সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের বিবরণ খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। একটা অংশ সংক্ষেপে বলা যায়, বাংলাদেশ থেকে পড়াশুনা শেষ না করেই আমেরিকা চলে যেতে হয় তাকে। সেখানে পারিবারিক বেশ কিছু ঝামেলার পরে ২ সন্তান নিয়ে তিনি একটি আশ্রয় কেন্দ্রে নিরাপত্তার জন্য অবস্থান করেন। প্রায় ১৪ বছর পর সে আবার পড়াশুনা শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে এখন সে একজন সফল নারী। আমি এই বইটার ব্যাপারে বলবো, এটা খুবই ভালো এবং অনুপ্রাণিত একটি বই। আমরা আরেকটা কাজ করেছি, আমাদের প্রমিত ভাষা নিয়ে বাংলা একাডেমি ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। বানান নিয়ে যার ফয়সালা এখনো হয়নি। তো এ কাজটি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের বাংলা বিভাগের একজন অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। বইটির নাম হচ্ছে, প্রমিত বাংলার সমাচার। এটি একটি অসাধারণ বই।
এছাড়া রয়েছে হাসান আজিজুল হকের একটা প্রবন্ধের বই। আত্মউন্নয়নমূলক কিছু বই রয়েছে। যেমন, শূন্য দশকের মেধাবী কবি আবু তাহের সরফরাজের কবিতার বই ‘দরবেশি কবিতা’। প্রকৃতি প্রকাশনী প্রতি বছরই চেষ্টা করে এরকম কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করতে।

সাঈদ: আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে বইমেলাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সৈকত: আমি আসলে নানারূপে বইমেলাকে দেখেছি। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে এ মেলার সঙ্গে জড়িত। প্রথমত দেখেছিলাম একজন পাঠক দর্শক এবং ক্রেতা হিসেবে। এরপর সাংবাদিকতা করতে যেয়ে মেলায় অনেক কাজ করেছি। এখন আবার প্রকাশক হিসেবে দেখছি। কিন্তু আমি যেটা বলবো, যে চেতনা থেকে একুশে বইমেলার উৎপত্তি তা এখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, প্রেম, মাতৃভাষার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি আগামী প্রজন্মকে আমরা আগ্রহী করে তুলতে পারিনি। বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারিনি আমাদের সাহিত্য। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আমরা ধীরে ধীরে উৎসব কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছি। যেমন আমরা একদিনের বাঙালি সারাবছর জিন্স টপস ফর্মাল সার্ট প্যান্ট পড়ে থাকি। অথচ বৈশাখ এলে পহেলা বৈশাখে আমরা শাড়ি পাঞ্জাবি পরে পচা পান্তা ইলিশ না খেলে আমাদের বাংলা উদ্ধার হয় না। তো এমনই মেলার ব্যাপারটাও। আমরা সারা বছর টিভি চ্যানেলগুলোতে অথবা পত্রিকাগুলোতে বই নিয়ে কোনও আলোচনা দেখতে পাই না। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সবাই মিলে ঝাপিয়ে পড়ছে। বড় ছোট মানহীন কোনো কিছুরই বাছাই নেই। এটা কিন্তু বাংলা ভাষা, বইমেলা অথবা পাঠকের জন্য কোনও কাজের কাজ নয়। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, বইমেলার স্থান নিয়ে সমস্যা। বাংলা একাডেমী প্রান্তে যখন জায়গা হচ্ছিল না, অনেক লেখালেখির পরে সেখান থেকে কিছু অংশ সোরাওয়ার্দি প্রান্তে আনা হয়। কিন্তু সেইখানেও মেলাকে আরেকটু গুছানো আরেকটু পাঠকবান্ধব করা উচিৎ। অবশ্য উদ্যান প্রাঙ্গণে মেলার একাংশের মাত্র তিন বছর চলছে। এর জন্য চেষ্টা চলছে যে, মেলাকে আরেকটু পাঠকবান্ধব করা যায় কীনা।

সাঈদ: মেলা উপলক্ষে তো হাজার হাজার নতুন বই বের হয়। এক্ষেত্রে পাঠক কিভাবে তার মধ্য থেকে ভালো বই খুঁজে পেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
সৈকত: ভালো বই বোঝার উপায় নেই পাঠকের। একজন নতুন পাঠক যখন মেলায় আসবেন তখন দেখা গেল যে, পত্রপত্রিকায় যাচ্ছেতাই বইয়ের বিজ্ঞাপন হচ্ছে। সেই বিজ্ঞাপনের উপরে নির্ভর করে তারা ঝাপিয়ে পড়ছে। কিন্তু তারা নিজেরা বই দেখে বাছাই করবে যে এ বইটা ভালো... অমুক বইটা পড়া উচিৎ, সেরকম বাজার যেমন খুব কম, তেমনি পাঠকও খুব কম। অথবা পাঠকের সেই জায়গাটা তৈরি হয়ে ওঠেনি। পৃথিবীতে আমাদের একটি মাত্র বইমেলা, যা এক মাস অব্দি হয়ে থাকে... আর এ মেলাকে কেন্দ্র করে এখানে হাজার হাজার বই বের হয়। তার মধ্যে যে সব বই-ই খুব ভালো মানের, তা কিন্তু নয়। যেটা করতে হবে, এই হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে মানসম্মত বই, নির্ভুল বই, সু-সম্পাদিত বই- এসবের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। পাঠকদের উদ্দেশে বলব, বিজ্ঞাপন পড়ে বইমেলায় ঝাপিয়ে পড়ার কিছু নেই। প্রকৃত বইটা আসলে আবর্জনা থেকে খুঁজে বের করে নিতে হয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যা কিছু ভালো তা সবসময়েই থাকে ডামাডোলের বাইরে। পাঠক যদি একটু সচেতন হয় তাহলে হয়তো আমাদের একুশে বইমেলার একটা সুফল পাওয়া যাবে।

সাঈদ: বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে বইমেলা কতটা ভূমিকা রাখে? বইমেলা ছাড়াও পাঠ্যবইয়ের বাইরে তরুণ প্রজন্ম কিভাবে বই পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন?
সৈকত: এটা জটিল প্রশ্ন। আসলে বই পড়ার সংস্কৃতি হচ্ছে প্রথমত পারিবারিক সংস্কৃতি। এরপরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তারপরে নিজের আগ্রহ অথবা অন্যান্য। আমরা এখন এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে ৪-৫ বছরের বাচ্চার ঘারে ১০-১২ তা বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এবং বাবা মায়েদের কোনও অভিযোগও নেই যে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি বিজ্ঞানের বই কেন পড়ানো হয় না। সারাক্ষণ টিউটোরিয়াল লাগিয়ে রাখছে ইংরেজি মাধ্যমে। জিপিয়ে-৫ এর বাণী শোনাচ্ছে। তারা বুঝতেও পারছে না, তাদের সন্তানদেরকে তারা অর্থনৈতিক প্রাণী হিসেবে গড়ে তুলছে। তারা শুধু স্বপ্ন দ্যাখে তার ছেলেটি কিংবা মেয়েটি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে, গ্লামারাস গার্ল হবে, অমুক হবে তমুক হবে। কিন্তু মানুষ বানানোর কথা কেউ চিন্তা করে না। আমাদের তো আগে মানুষ হতে হবে। আর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা এখনো পর্যন্ত কেরানি বানানো। তাদের সর্বচ্চ দৌড় বিসিএস পর্যন্ত। অথবা সেনা কর্মকর্তা কিংবা ডাক্তার বানানো। ঠিক আছে এর মধ্যে তারা অর্থনৈতিকভাবে সফল হবে, কিন্তু মানুষ গড়ার জন্য বিপুল পরিমানে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও তাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি বিজ্ঞান জানতে হবে, জানাতে হবে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, আজকের তরুণ প্রজন্ম ৫০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকার মোবাইল ফোন কম্পিউটার ট্যাব ইত্যাদি ব্যবহার করছে। অথচ আমরা কিন্তু এখনো ৫ হাজার টাকার একটি মোবাইল উৎপাদন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। আমরা প্রায় ১৭ কোটি জনগণ। কিন্তু আমাদের একটু লজ্জাও করে না যে, আমরা এত দামি দামি টেকনোলজি ব্যবহার করছি এতে আমাদের কোনও অংশগ্রহণ নেই। আই এম অনলি অ্যা বায়ার। আমি শুধু লেবার হিসেবে কাজ করতেছি। এ শিক্ষা আমাদেরকে কি দিচ্ছে? যে শিক্ষা দেশে শিল্পায়ন ঘটাবে না, চৈতন্য ঘটাবে না, দেশের সম্মান বাড়াবে না, শুধু কেরানিই তৈরি করবে- সে শিক্ষা দিয়ে আমরা কি কবর? খালি কেরানি শিক্ষা দিয়ে তো দেশের কিচ্ছু হবে না। বাংলাদেশে আজকে যে পরিস্থিতির সম্মুখিন আমরা, এই যে গুণ্ডামি চাঁদাবাজি অস্ত্রবাজি দুর্নিতি ব্যাংক লুটপাট অর্থনৈতিক শূন্যতা, এসবের আসল কারণ কি? কারণ হচ্ছে মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও মানবীয় গুলাবলির সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজ তো আর মানবীয় গুণাবলি সমৃদ্ধ করার জায়গা নয়। এটা পরিবার থেকে চর্চা করার বিষয় এবং তাদেরকে সৃজনশীল করে তৈরি করতে হবে। মানুষের মধ্যে যদি কল্পনা শক্তি না থাকে তাহলে কি করে সে বড় হবে? আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার কাছে সবচে গুরুত্বপূর্ণ কি? সে বলেছিল, কল্পনাশক্তি। এটা প্রতিভার চেয়েও বড়। তো, এ কল্পনা শক্তির কারণেই আজকে আমরা একটা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড তৈরি করতে পেরেছি। কল্পনা শক্তির কারণেই আমরা আজ চাঁদে পা রাখছি। প্রথমত ইমাজিনেশন, দেন সাইন্স, দেন টেকনোলজি। সে ক্ষেত্রে আমাদেরকে পারিবারিকভাবেই চর্চা করতে হবে যে, বই পড়া শুধু ভালো চাকরিবাকরি পাওয়ার জন্যই নয়, অবসর সময় কাটানোর জন্যই নয়, বই পড়া হচ্ছে জীবনকে উন্নত করা এবং তাকে উচ্চস্তরে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম। বইমেলা এতে কিছু ভূমিকা রাখছে। আবার বলবো যে, রাখছেও না। যেমন আজকাল বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে তৃতীয় শ্রেণির বই মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। বাছাইয়ের ক্ষমতা খুব কম পাঠকেরই আছে। সুতরাং এই সংস্কৃতিটা একেবারেই পারিবারিক ভাবে তৈরি করার বিষয়।

সাঈদ: আপনি নিজেও তো একজন কবি। প্রাবন্ধিক। চিন্তাশীল মানুষ। এবার মেলায় আপনার নতুন কোনও বই এসেছে?
সৈকত: আমার আসলে বইয়ের ভাগ্য খুব একটা ভালো না। আমার ৩টা বই অনেক আগে বের হয়েছিল। সেই তিনটি বই মিলিয়ে ‘সৈকত হাবিবের কবিতা’ নামে ‘কথা প্রকাশ’ থেকে একটি বই হয়তো বের হতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত কি হবে আমি জানি না। আর আমি আসলে প্রতি বছর বই করার পক্ষে না। ৩-৪ বছর পর পর যখন মনে হয় যে কিছু কাজ করেছি, তখন বই প্রকাশ করার চিন্তা করি।

সাঈদ: লেখালিখির পাশাপাশি প্রকাশনার সাথে নিজেকে যুক্ত করার আগ্রহটা কিভাবে জন্মালো?
সৈকত: প্রকাশনা সংস্থার সাথে যুক্ত আছি অনেকদিন। প্রথমে যখন লিটল ম্যাগাজিন করতাম তখন ছাপাছাপির ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বেশ কিছুদিন সাংবাদিকতা করতে গিয়েও অনেক ছাপাছাপির কাজ করেছি প্রকাশনা সংস্থার সাথে। আর এমনিতেও যারা লেখালিখি করে তাদের মধ্যে ছাপাছাপি ব্যাপারটা একটা আকর্ষণ। একটা পত্রিকা অথবা একটা বই তৈরি করা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় এবং খুব সৃজনশীল কাজ। আমি দেখলাম যে, প্রতি বছর যতগুলো বই বের হচ্ছে নামকরা অথবা নতুন লেখকদের, তার মধ্যে বেশির ভাগ বানান ভুল, মানহীন, রুচিহীন প্রচ্ছদ। কী ছাপছে তারা নিজেরাই জানে না। প্রেসের কাজ হচ্ছে, প্রকাশক তার হাতে যা তুলে দেবে সে তাই ছেপে বের করে দেবে। সে ক্ষেত্রে তার কোনও দায় দায়িত্ব থাকে না। এ দায়িত্বটা একজন প্রকাশকের। সে কি ছাপছে কেন ছাপছে কার জন্য ছাপছে এ চিন্তাগুলো একজন প্রকাশকের। এজন্য প্রকাশকের নিজস্ব পরিকল্পনা থাকতে হবে যে, কেন একটা বই প্রকাশ করবে। সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয়েছে, সঠিক শুদ্ধ নির্ভুল বই করা সম্ভব। মননশীল বই করা সম্ভব। বাংলা ভাষার জন্য আমরা যে রক্ত দিয়েছে সে রক্তদানের রেজাল্ট হবে তখনি যখন আমরা বাংলা ভাষাকে বৈশ্বিক স্তরে নিয়ে যেতে পারবো। সেটা আমাদের লেখা দিয়ে অনুবাদ দিয়ে প্রকাশনার মান দিয়ে... তো, সেই দায়বদ্ধতা থেকে আমার প্রকাশনার দিকে আসা।

সাঈদ: জ্ঞানের বিকাশে ‘প্রকৃতি’ কতটুকু ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
সৈকত: এক্ষেত্রে আমি যা বলবো তা হচ্ছে, আমদের সবেমাত্র শুরু। যদিও আট বছর হয়ে গেছে প্রকাশনীর বয়স। তবু প্রকাশনার ক্ষেত্রে ৮ বছর কিছুই নয়। এ হিসেবটা হয়তো ২৫ থেকে ৩০ বছর হয়ে গেলে করতে পারবো। তবে আমরা আশা করছি ভালো কাজ করার। এবং সেই লক্ষেই কাজ করে যাচ্ছি। কি দিলাম কি অর্জন করলাম আর কি বর্জন করলাম, সে হিসেবটা এখনই করা সম্ভব নয়। আমরা আমাদের মতো কাজ করে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়।

সাঈদ: একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, একজন নতুন লেখক যখন তার বই প্রকাশ করতে চায় তখন প্রকাশনী সংস্থাগুলো তার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। এ ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করবেন?
সৈকত: আসলে এটা নতুন পুরনো খ্যাতিমান অখ্যাত লেখকের ব্যাপার নয়। একজন প্রকাশক হচ্ছে বেসিকেলি একজন ব্যবসায়ী। সে জাতি উদ্ধারের থেকেও বেশি আসছে তার রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে। ফলে যে বই বাজারে বিক্রি হবে না বলে তার ধারণা, তার পিছনে কেন সে সময় মেধা অর্থ ব্যয় করে ছাপবে? এছাড়া আমরা যে সবার বই টাকা নিয়ে ছাপি, এমনটাও কিন্তু নয়। অনেকেই হয়তো লেখে। লেখক হবার ইচ্ছা যাদের আছে তাদের মধ্যে হয়তো অনেকের বাজার নেই। বা তারা অতটা যোগ্য নয়। অথবা লেখার মান খুব একটা ভালো না। এ বিষয়গুলো কিন্তু আছে। ফলে তাদের সাথে আমরা একটা চুক্তিবদ্ধ হই যে, তারা আমাদের সাথে কিছু শেয়ার করবে। অথবা তারা কিছু বই আমাদের কাছ থেকে কিনবে। যাতে লেখক-প্রকাশক কেউই ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। প্রথমত যে লেখক মনে করবে, সে যাচ্ছেতাই লিখবে আর প্রকাশক তা ছাপবে, এটা খুব অন্যায় ধারণা। দ্বিতীয়ত, প্রকাশকেরা কিছু আছে যারা টাকার লোভে মানহীন অখাদ্য কুখাদ্য লেখাকে বাজারে আনছে। সেটাও সমান অন্যায়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, ইউরোপ-আমেরিকায় আমাদের চাইতে অনেক বেশি সেলফ পাবলিশিং বলে একটা ধারণা আছে। এটা হচ্ছে নিজেরাই নিজেদের বই ছাপবে। এটা সারা পৃথিবিতেই আছে।

সাঈদ: আপনারা একসময় লিটলম্যাগ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তো এখন যেমন দেখা যাচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন শুধু সংখ্যায়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু আপনাদের সময়কার মতো প্রতিফলন কিংবা প্রাণ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এ লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য কি করা যায় বলে মনে করেন?
সৈকত: লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো লেখকের মধ্যে সাহস ও ব্যক্তিত্ত্ব তৈরি করা। লিটল ম্যাগাজিন তৈরি হয়েছিল প্রচলিত লেখার বাইরে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাকে উদ্বুদ্ধ করতে। তা ইউরোপে যেমন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে আমাদের এখানেও হয়েছে। এ পর্যন্ত যত সাহিত্য আন্দোলন দেখা যায় তার অধিকাংশ হচ্ছে লিটল ম্যাগাজিনের অবদান। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বর্তমান বাংলাদেশের ছোটকাগজগুলো বড় কাগজের শ্যালক-শ্যালিকা হয়ে উঠেছে। একদল মূর্খ সাহিত্যিক/সম্পাদকরা প্রভাব খাটিয়ে অথবা সম্পর্কের জের ধরে ছোটকাগজে তাদের বস্তাপচা সাহিত্যকর্ম ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর বিজ্ঞাপনের বিজনেস তো আছেই। ফলে ছোটকাগজগুলো নতুন চিন্তার জায়গা থেকে সরে গিয়ে খ্যাতি অর্জনের দিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞাপনের পিছু দৌড়াচ্ছে। ফলে আগের যে প্রাণ তা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া লিটল ম্যাগ তৈরির আরেকটা কারণ ছিল দৈনিক অথবা বড় পত্রিকায় যারা আশ্রয় পায় না তাদের জন্য। কিন্তু এখন তো ভার্চুয়াল জগতেই সবকিছু চলছে। ফেসবুকের এক একটা পেজই এক একটা ছোটকাগজ হয়ে উঠছে। ফলে তার একটা প্রভাবও ছোটকাগজের ওপরে পড়ছে। এজন্য আমাদের যা করা দরকার তা হচ্ছে, খ্যাতির লোভ ছাড়তে হবে। যারা এখন ছোটকাগজ সম্পাদনা করছে বলে দাবি করে, তাদের অধিকাংশই জানে না ছোটকাগজ কি। ছোটকাগজ হলো অল্পের মধ্যে খুব বেশি ভাব-চিন্তাকে তুলে ধরার একটি মাধ্যম। তো সেই জিনিস করার জন্য অই রকম শক্ত জোর সৎ সাহস এবং সুন্দর চিন্তার প্রয়োজন। খালি সুন্দর ছাপা বাঁধাই করে সুন্দর নাম দিলেই সেটা ছোট কাগজ হয় না।