প্রকৃতিকে মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করি

পর্ব ১

প্রকাশিত : মার্চ ১০, ২০১৮

মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:   

সরফরাজ: শৈশবের গল্প বলুন। ধানখেত, নদী, পাখি প্রকৃতির এসব অনুষঙ্গ কীভাবে আপনার স্বপ্ন কল্পনায় একাকার হয়ে গেল।

মেহেদী: প্রকৃতিকে সবসময়েই আমি মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করি। শৈশবেই এমন অনুভূতি ও বোধ প্রাপ্ত হইছিলাম। শৈশব কেটেছে পালাক্রমে মা ও বাবার গ্রামে। আমার মায়ের গ্রাম নোয়াখালির বর্তমান সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা গ্রামে। আর বাবার গ্রাম চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার দহুলিয়া গ্রামে। মায়ের গ্রামে কাটানো শৈশব আমার অতি আনন্দের ছিল। কারণ সেখানকার প্রকৃতি ও মানুষ দুই-ই আমার ভালো লাগত। অন্যদিকে বাবার গ্রাম দহুলিয়ার প্রতি আমার এক ধরনের নস্টালজিয়া থাকলেও সেখানকার প্রকৃতি আমার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। এর কারণ সেখানকার মানুষকে আমি বুঝতে পারতাম না। ফলে মানুষ ছাড়া প্রকৃতি আসলেই অর্থহীন। মায়ের বাড়ি যাওয়ার আগ্রহ নিয়েই বাবার বাড়ির বছর শুরু হতো, বার্ষিক পরীক্ষা শেষে বেড়াতে যেতাম মায়ের সাথে। সেখানে এতটাই ভালো লেগে যেত, নতুন বছর চলে এলেও আসতে চাইতাম না চাঁদপুরে। চরবাটার নানাবাড়ির আঙিনার স্কুলে ভর্তি হয়ে শুরু করে দিতাম নতুন ক্লাসের পড়াশোনা। একপর্যায়ে যেতেই হতো। এভাবে চরবাটার উপকূলীয় মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে কেটেছে আমার শৈশব। আমার নানাবাড়ির পূর্বপুরুষদের বিরাট জমিদারি ছিল। তারা ছিলেন বিশাল সম্পত্তির মালিক। কাঠের দোতলা বাড়িটা ছিল অভিজাত। কাঠ ও টিনের কারুকাজে বানানো। এরকম বাড়ি আমি দেশে দেখেনি তেমন। তবে একবার সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরে গিয়ে দেখলাম হুবহু একই ডিজাইনের বাড়ির নকশা রাখা প্রদর্শনের জন্য। বুঝলাম, এটা ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। নান্দনিকতার বাইরে এধরনের বাড়ির অন্যতম উপযোগিতা হচ্ছে, ঘূর্ণীঝড়ের সময় দোতলায় উঠে গেলে জোয়ার প্রাণের ক্ষতি করতে পারে না। হয়েছেও তাই। ১৯৭০ সনের জলোচ্ছ্বাসে এই বাড়িতে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। উল্টো আশপাশের অনেক মানুষকে আশ্রয় দেয়া গেছিল।

বাড়ির পাশেই ছিল ম্যানগ্রোভ বন। আমরা সেখানে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম। উপকূলীয় শ্বাসমূল আর কেওড়া গাছ, সামুদ্রিক প্রাণী আর মাছ- এসব দেখতে দেখতে কেটেছে শৈশব। সামুদ্রিক মাছের বাজার অন্যতম প্রিয় জায়গা। সাধারণ মাছের বাজারে গিয়ে মাছ কেনাটা এজন্য নিরর্থক মনে হয়। তবুও মাছ লাগে, খেতে হয় যদিও। ১৯৭০ সনের ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাসে আমরা হারিয়েছি আমাদের পরিবারের অধিকাংশ প্রিয় সদস্যদের। যাদের আমি দেখিনি, কিন্তু কল্পনা করতে পারি। দাদি, ফুফু, চাচারা ভেসে গেছেন। বেঁচে ছিলেন আমার বাবা, এক চাচা আর দাদা। তারা নোয়াখালির বাইরে ছিলেন বলে।

বিরল প্রজাতির উপকূলীয় লতা-গুল্ম-গাছ-মাছ-মাটি-মানুষ সমৃদ্ধ শৈশব আমার মধ্যে একটা ঘোর তৈরি করে রেখেছে। বড় হতে হতে সেসবের সাথে নিজের কল্পনা যোগ করে আমি একটা ইউটোপিয়া নির্মাণ করেছি। সে জগৎ এখন আমার মধ্যে বিরাট বড় হয়েছে। এর তুলনা কিছুর সাথে চলে না। দহুলিয়ার শৈশব গুরুত্বপূর্ণ ভিন্ন কারণে। ভালো লাগুক আর না লাগুক, এটাই স্থায়ী ঠিকানা। স্কুল-কলেজের ঠিকানাও এখানকার। যদিও জন্ম চরবাটায়। আমার লেখাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে চরবাটা। একটা সুবর্ণ চর! খুব বর্ণীল। এমন শৈশবের চর যার, হৃদয় আর মস্তিষ্কে, তার লেখালেখি ছাড়া উপায় নাই!

চলবে...