প্রিয় মধুপর্ণাদি

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১১, ২০১৮

অনেক কিছুই গুছিয়ে লেখা হয়ে ওঠে না আর। অনেক কিছুই না। এই যে তোমায় চিঠি লেখার কথা ছিল, অথচ দেখো, বছর কেমন ফুরিয়ে এলো, লিখে উঠতে পারলাম কি? ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায়, জানো? চাঁদর হয়তো নেমে গেছে পায়ের কাছে। পাশে পুটুশটা হাত দুটো বুকের কাছে নিয়ে গুটিসুটি। এমন সময় যদি শব্দগুলো গুলিয়ে উঠতে থাকে ভেতর থেকে , তোলপাড় করে ওঠে যদি, ঠিক এমন সময়, লেখা যায় কি? বলো? যায় হয়তো। কোনো কোনো অপরাহ্নে তেমন আমিও ভাবতে বসি, আরে লেখা হলো না যে! দুম করে গেঁজিয়ে ওঠা শব্দের গেলাস নাড়াচাড়া করে দেখি, কেমন থিতিয়ে গেছে সব। কী অপূর্ব সেই মথিত হতে থাকা বিকেল।

হয়তো তখন তুমি বারান্দায়। গাছে জল দিচ্ছো। ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছো। এলিয়ে যাচ্ছে তোমার খোঁপা। ভিজে যাচ্ছে পাটপাট করা শাড়ির আঁচল। আচ্ছা মধু দিদি, এবার কি চা নিয়ে বসবে ওই চেয়ারটায়? আকাশে কেমন পরাগের দাগ। দেখো, তুমি দেখতে পাচ্ছো?

আমার খুব যেতে ইচ্ছে করে ওই শহরটায়। কোনো এক বিকেলে হয়তো চায়ের নিমন্ত্রণ তোমাদের আলুলায়িত বারান্দায়। আমি পথ খুঁজে খুঁজে যাব। যেতে যেতে দেখবো, কী ভয়ানক সবুজ তার চারপাশ। দুহাত বেঁকে গেলে পথ হয়তো নদীতে নেমে যায়। নুড়িপথ আলগোছে ভিজে থাকে সুশীতল জলে। ওই দূরে পাহাড় দেখা যায়। এখানে এসেছো কি তুমি কখনো? কোনোদিন? নিশ্চয়ই এসেছো। আঁচল পেতে বসেছো ওই নদীর ধারে। তুমি এলেই সূর্যাস্ত হয়। মুখোমুখি তোমার জেগে থাকে আজানুলম্বিত অন্ধকার। হাওয়া বয়। কী ঠাণ্ঠা হাওয়া! তুমি চাঁদরখানা টেনে নাও গায়ে।

এইসব ভাবতে ভাবতে পৌঁছে যাই তোমার বাড়ি। দরজায় টোকা দিতে সাহস হয় না তবু। কিসের এই দ্বিধা? পাতাবাহারের নিচে ঘুমিয়ে আছে যে জোনাকির মালা, তাদের ঘুম ভাঙাতে সাহস হয় না। এক পা দুপা করে সরে আসি তোমার চৌকাঠ থেকে। নিজের ভীরুতায় হেসে উঠি নিজেই। সেই হাসির গান বেজে ওঠে চতুর্দিকে, খলবল করে নড়ে ওঠে গাছের পাতা। চারদিকে এত গাছ কেন, মধুদি?

সে আওয়াজে নড়ে ওঠে তোমার চায়ের পেয়ালা। চিনি দিতে গিয়ে চামচ পড়ে যায় হাত থেকে। কে এলো? কে? বারান্দা থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে খোঁজ এবার তুমি তাকে। কে এলো? কে? কে? কেউ সাড়া দেয় না আর। কোথাও কোনো শব্দ নেই একেবারে। গিয়ে বসো আবার তোমার চেয়ারে। এবার চিনি গোলার শব্দ হয় শুধু টুং টাং।

তোমার বাড়ি যাব আমি একদিন। কথা দিলাম না। কিন্তু যাব। বেশি আয়োজন করোনা মধুদিদি। বেশি ভালোবাসা পেলে অস্বস্তি হয়। কেবল তোমার বারান্দায় ওই চেয়ারের পাশে আরেকখানা চেয়ার পেতে রেখো। আমি গাছ দেখবো। আমি গাছ দেখতে ভালোবাসি। আর বিছানায় গায়ে দেয়ার একখানা রেখো। ভোরবেলা চাঁদর আমার পায়ের কাছে নেমে যায়। ঠাণ্ডা লাগলে টেনে নেব গায়ে।

তারপর আমার ফেরার সময় হবে জানি। তুমি হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে থেকো না যেন। আমায় ট্রেনে তুলে দিতে আসবে তো? আসবে না জানি। বরং বলবে, ‘আরো কটা দিন থেকে যাও।’ রাগ কোরো না মধুদি। আমি কী আর থাকতে পারি বলো? অনেক তো হলো। ওখানে যে অপেক্ষা করে আছে, এবার তার কাছে ফিরতে হবে। সে জানে, এখনো আমার অনেক লেখা বাকি।

বছর ফুরিয়ে এলো, মধুদি। মধুপর্ণা, তুমি ভালো থেকো। তোমায় একবার নাম ধরে ডাকলাম। রাগ করো না যেন। ভালো থেকো। ভালো থেকো অবিরাম।