‘বস্তার’ রাষ্ট্র–কর্পোরেট–হিন্দুত্ববাদের যৌথ সন্ত্রাস

লাবণী মণ্ডল

প্রকাশিত : জুন ১৩, ২০১৮

শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমালোচনা হলো সংগ্রাম ও বিকাশের অন্যতম প্রধান পদ্ধতি। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেই ‘বস্তার’ বইটি নিয়ে দু’চার কথা লিখতে বসলাম। এ আলোচনা বা সমালোচনা কতটুকু সাহিত্যমানসম্পন্ন হবে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নই। সেক্ষেত্রে এটিকে আমার উপলব্ধির বিকাশ ধরে নেয়াটাই শ্রেয়। রাজনৈতিক দর্শনে নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই লিখছি। শাহেরীন আরাফাতের লেখা বইটির পুরো নাম– ‘বস্তার’ রাষ্ট্র–কর্পোরেট–হিন্দুত্ববাদের যৌথ সন্ত্রাস। এটি ২০১৭ সালের মে মাসে উৎস পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদ করেছেন শিশির মল্লিক।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ তামাম দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো শ্রমিকশ্রেণি এবং জনগণের মুক্তি ও অগ্রগতির পথে নানা উপায়ে বাধা সৃষ্টি করার জন্য সংহত হচ্ছে। শিল্প–সাহিত্যকেও তারা কাজে লাগাচ্ছে ব্যাপকভাবে। এমন সময়ে ‘বস্তার’ বইটি নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে উৎকৃষ্ট সাহিত্য সমালোচনা করাটা নিতান্ত সহজ কাজ নয়। বরং এমন বই– যেখানে সমাহার ঘটেছে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, আগ্রাসন, সংগ্রাম ও প্রতিরোধের বিপুল তথ্য– তা নিয়ে আলোচনা করাটা বেশ কঠিন ও জটিল।

আমরা জানি, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রতিটা মানুষই নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। বুর্জোয়াশ্রেণি যেসব বই-পুস্তক ও মিডিয়া আমাদের সামনে উপস্থাপন করে, তা ওই শ্রেণি ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই প্রচারিত হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যাপক নিপীড়িত জনগণ ও বিপ্লবী চেতনার বিরুদ্ধেই প্রচারণা চলে। জনগণের মধ্যে প্রতিনিয়ত বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হয়। আর এ কাঠামোর বিপরীতে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং বুর্জোয়া চেতনার প্রতিক্রিয়াশীল রূপ উদঘাটন করা খুব জরুরি। এ লেখাটি তারই এক ক্ষুদ্র প্রয়াস বলা যেতে পারে।

শ্রেণিবিভক্ত সমাজে কোনো সাহিত্য বা রচনাও নির্দিষ্ট শ্রেণির অধীন। আর সেই রচনা জনগণের স্বার্থের পক্ষে, ঐক্য ও সংগ্রামের পক্ষে রচিত; নাকি তার অবস্থান গণবিরোধী– সেটা নির্ধারিত হয় লেখক-পাঠকের শ্রেণিচেতনার ভিত্তিতে। ধরুন, একই বিষয়বস্তু নিয়ে দুজন লেখক লিখলেন– শ্রেণিচেতনায় ভিন্নতা থাকলে দুজনের লেখার দৃষ্টিভঙ্গীও হবে বিপরীতমুখী। আবার পাঠকের উপলব্ধির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ‘বস্তার’ গ্রন্থের লেখক শাহেরীন আরাফাত সেই কাজটাই করেছেন। তার ধারণ করা রাজনৈতিক দর্শনই বইটিতে গুরুত্ব পেয়েছে।

কোনো বই সমাজ বিপ্লবে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। ‘বস্তার’ বইটি পড়ার পর এটিকে তেমনই এক চেষ্টা বলে মনে হয়েছে। মধ্যভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের বস্তার বিভাগের নামানুসারেই বইটির নামকরণ করা হয়েছে। বইয়ে ওই অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস উঠে এসেছে।

বস্তার বিভাগটি ছয়টি জেলা নিয়ে গঠিত– কাঁকের, বস্তার, দান্তেওয়াড়া, সুকমা, বিজাপুর ও নারায়ণপুর। বইটিতে বলা হয়, “২০০০ সালে মধ্যপ্রদেশ রাজ্য ভেঙে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় নামে দুটি পৃথক রাজ্য গঠন করা হয়। তখন গোঁড় আদিবাসীদের বাহান্নটি গড়ের ষোলোটি স্থান পায় মধ্যপ্রদেশে, আর ছত্রিশটি গড় নিয়ে গঠিত হয় ছত্তিশগড়। তবে এই ছত্রিশটি গড়ের একটিও বস্তারে নয়। তবু বস্তার বিভাগটি ছত্তিশগড়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, বস্তারের মানুষ কোনোদিনই নিজেকে ছত্তিশগড়ের অংশ মনে করেননি, একটা স্বতন্ত্র পরিচয় ছিলো বস্তারের। কিন্তু এখানে তার কোনো তোয়াক্কাই করা হয়নি।”

বস্তারের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি ‘বস্তার’ বইটি থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। অবিভক্ত বস্তারের আয়তন ছিল ভারতের কেরালা রাজ্য থেকেও বড়। বস্তারের ৬২ শতাংশই বনাঞ্চল। আর এ বনই আদিবাসীদের জীবন–যাত্রার মূল উৎস। জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশই আদিবাসী। বইটি ওখানকার আদিবাসীদর ভাষা, অর্থনীতি, কৃষি, বনজ উৎপাদন, প্রধান শিল্প, জীবিকা নির্বাহ সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। প্রতিটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। যা বস্তারের আদিবাসীদের মধ্যেও বিরাজমান। বস্তারের আদিবাসীরা মূলত জুম চাষে অভ্যস্ত ছিলেন। ইন্ধিরা গান্ধীর শাসনামলে সরকারের তরফে জোরপূর্বক হালচাষে বাধ্য করা হয়। এতে আদিবাসীদের একাংশ নিজ ঐতিহ্যগত চাষ পদ্ধতি থেকে ছিটকে পড়েন। একটা জাতিসত্তা যত বেশি নিপীড়িত, তত বেশি সংগ্রামী হতে পারে; যদি সঠিক রাজনৈতিক দর্শন উপস্থিত থাকে। ঠিক এই শিক্ষাটিও আমরা পেতে পারি বস্তারের আদিবাসীদের দৃঢ়তা দেখে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মাওবাদী মতাদর্শ ধারণ করে প্রকৃত বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে আদিবাসীদের আন্দোলন সংগ্রাম অগ্রসর হতে পারে বলে মনে করি।

বস্তার প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। আর এজন্যই সাম্রাজ্যবাদীরা এ অঞ্চলের সম্পদ লুটে নিতে চাইছে। রাষ্ট্রীয় মদদে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো চালাচ্ছে আগ্রাসন। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের নগ্ন আগ্রাসী রূপটি তুলে ধরা হয়েছে এ বইয়ে। ভারতের সরকার জনগণের ওপর এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। ‘অপারেশন গ্রিনহান্ট’ নামক সেই অভিযান আজও চলমান। আর এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ও সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে মাওবাদী ও লড়াকু জনগণের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। বর্তমান ফ্যাসিবাদী মোদি সরকার গণবিরোধী অবস্থানকে আরও বিস্তৃত করে বস্তার তথা পুরো দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলজুড়ে চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী কার্যক্রম।

হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা অনুসারে, ছত্তিশগড়ের উত্তরে কোরিয়া জেলা থেকে দক্ষিণে বস্তারের মাঝ বরাবর দণ্ডকারণ্যর মধ্য দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে তা–ই কথিত তীর্থপথ– ওই পথেই নাকি রাম বনে গিয়েছিলেন! আর এই পথে বহু স্থানে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য আশ্রম ও মন্দির, বিশেষত যেখানে যেখানে রামচন্দ্র ‘রাক্ষস’ বধ করেছিলেন বলে প্রচার করা হয়। এসব আশ্রম ও মন্দিরকে ঘিরে চলছে একদিকে হিন্দুত্ববাদের ব্যবসা, অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদের সন্ত্রাস। হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা ও মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রে ‘রামগাঁথা’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য রাজ্যজুড়ে রামের বিষয়ে সরকারি আদিবাসী স্কুল ও ক্যাম্পগুলোতে পড়ানো হয় ওই ‘রামগাঁথা’, যার অর্থায়ন করেছে রাষ্ট্র ও আরএসএস। কোয়াসহ বিভিন্ন গোত্রের গোঁড় আদিবাসীদের ওই ‘রামগাঁথা’ বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হয়। আর বিবিধ মিথ বা উপকথার সাহায্যে এমন আবহ তৈরি করা হয়, যেন আদিবাসীদের মগজে তা প্রোথিত হয়। শোষিত যেন শোষণকে নিজ থেকেই শিরোধার্য বলে মেনে নেয়।

এসময়ে আরেকটি পন্থায় হিন্দুত্ববাদের বিষ ছড়ানো হয় সুকৌশলে। যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী এবং এর মাধ্যমে আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি হিন্দুত্ববাদ দ্বারা পূর্ণ করার চেষ্টা করা হয়। যেসব আদিবাসীদের হিন্দুত্ববাদ দ্বারা প্রভাবিত করা সম্ভব হয়, সেসব পরিবারের নারীদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয় হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে। পরে ওই আদিবাসী নারী ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাধ্যমে চলে হিন্দুত্ববাদের প্রচারণা। সব হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই ‘মাওবাদী’ বলে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। অথবা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হত্যা বা এলাকা ছাড়া করা হয়। অধিকারকর্মী সোনি সোরিকে গ্রেফতার করে যে পুলিশ ধর্ষণ করেছিল, তাকে রাষ্ট্রপতি সম্মাননা দেয়া হয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক বেলা ভাটিয়ার বাড়িতে হামলা চালানো হয়। প্রতিবাদকারীদের এলাকা থেকে বের করে দেয়া, বাইরের কাউকে এলাকায় ঢুকতে না দেয়া, সংবাদকর্মীদের কাজে বাধা দেয়া ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া বস্তার অঞ্চলের খুব সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

বস্তারের আদিবাসী জনগণের উপর যে দুবির্ষহ নির্যাতনের চিত্র লেখক তুলে এনেছেন– তা লেখকের দর্শনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। দর্শন পরিষ্কার না থাকলে আমরা বস্তারের আদিবাসীদের উপর নির্যাতনের চিত্রটা এভাবে পেতাম না। বস্তারে ৫০–এর দশকের শেষের দিকে কথিত উন্নয়নের দামামা বাজিয়ে আদিবাসীদের উৎখাত শুরু হয়। যার ধারাবাহিকতা এখনও চলমান। সেখানকার জনগণের প্রতিরোধ শক্তি মাওবাদীদের উপর ভারত রাষ্ট্রের বর্বরোচিত হামলাই তার প্রমাণ রাখে। উন্নয়নের নামে বাঁধ নির্মাণ, সেচ প্রকল্প, খনিজ সম্পদ উত্তোলন করার মধ্যদিয়ে বাস্তুচ্যুত করা হয়। এই উন্নয়নের ফাঁদে পড়ে তিন কোটিরও বেশি মানুষ ভিটেমাটিহীন। এ চিত্রকে অপ্রকাশ্য রেখেই ভারত রাষ্ট্রের ধারকেরা সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের বুলি দিয়ে থাকে।

ভারত জন্মলগ্ন থেকেই ‘তার নিজ জনগণের’ বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী মোতায়েন রেখেছে। ইতিহাসের দারস্থ হলে আমরা এর স্পষ্ট উদাহরণ দেখতে পাই। এই একটি মাত্র বই পড়েই ভারত সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করা সম্ভব না হলেও, তা আমাদের চিন্তার জট খুলে দিবে নিশ্চিতভাবেই। মনিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, কাশ্মির, জুনাগড়, পাঞ্জাব, হায়দ্রাবাদের জনগণের উপর যে ভারতীয় বাহিনী আগ্রাসন চালিয়ে দখল করেছে, আমরা সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাই।

ভারতের জনগণ আজ আর উন্নয়নের নাম শুনলে স্বস্তিবোধ করেন না, তারা সরকার বা শাসকশ্রেণির মুখে উন্নয়নের কথা শুনলেই বুঝতে পারেন– স্থানীয় জনগণের বাস্তুচ্যুত হওয়া। উন্নয়নের নামে, মেগাসিটির নামে নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠির উপর নিপীড়ন আর কর্পোরেট লুটই মোদ্দা কথা। আর সবসময় এ ধরনের উন্নয়নের বিরুদ্ধে জনগণের শক্তি হয়ে পাশে দাঁড়ায় মাওবাদীরা। যে মাওবাদীদের ধ্বংস করে দেয়াই শাসকগোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য। ভারতের দালাল কর্পোরেট শাসকশ্রেণির উন্নয়নের মূল এজেন্ডা হলো– সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উন্নয়ন। আর সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধেই লড়ে যাচ্ছেন মাওবাদীরা। আর এজন্যই মাওবাদীদের ‘এক নম্বর অভ্যন্তরীণ শত্রু’ বলে গণ্য করছে শাসকশ্রেণির সবগুলো দল।

মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের অবস্থান দারিদ্র্য সীমার নিচে। এই ৮০ শতাংশ জনগণকে দারিদ্র্যের বেড়াজালে রেখে সরকার যখন উন্নয়নের ডামাডোল বাজায়, তখনই মাওবাদীরা প্রতিবাদ–প্রতিরোধে গড়ে তোলে। ওই ৮০ শতাংশ জনগণের পক্ষের শক্তির মূল দর্শনই ‘মাওবাদ’।

“…শোষণ, নিপীড়ন, কলুষতা আর সাম্রাজ্যবাদী কথিত ‘উন্নয়ন’ দর্শনের বিপরীতে মাওবাদীরা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে জনগণের প্রকৃত উন্নয়নে অবদান রেখেছেন।… লেখক মাওবাদীদের সঙ্গে কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট ভারত রাষ্ট্রের লড়াইকে দুটি বিপরীত দর্শনের সংঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন– “মাওবাদীদের সঙ্গে ভারত রাষ্ট্রের সংঘাত কোনো দুটি গোষ্ঠী বা ব্যক্তির সংঘাত নয়। বরং এই সংঘাত হলো দুটি উন্নয়ন দর্শনের সংঘাত। এখানে পুলিশ বা রাষ্ট্রীয় বাহিনী কয়জনকে মারতে পারলো, অথবা মাওবাদীরা কয়জনকে খতম করলো, তা মূল্যহীন। কে কোন পক্ষ থেকে কোন লক্ষ্যের জন্য লড়ছেন, সেটাই মুখ্য। একদিকে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার লড়ছে কর্পোরেশন, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ– এর পক্ষে, তাদের রাস্তা পরিষ্কার করে আদিবাসীদের উচ্ছেদের জন্য। অপরদিকে, মাওবাদীরা লড়ছেন আদিবাসীদের জল–জঙ্গল–জমিনের অধিকারের পক্ষে, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ আর কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে। এটাই দুই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির মূল সংঘাত।”

মধ্যভারতে সরকার তথা কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের কথিত উন্নয়নের বিপরীতে প্রকৃত উন্নয়নের রূপরেখা হাজির করেছেন মাওবাদীরা। যেখানে মাওবাদীদের ঘাঁটি অঞ্চলে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরবর্তী সরকারের একটি রূপ তুলে ধরেছে সেখানকার ‘জনতন সরকার’।

“মাওবাদীরা বস্তারসহ মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দণ্ডকারণ্যে ‘জনতন সরকার’ বা ‘জনতার সরকার’ নামে এক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। প্রায় ১ লাখ বর্গ কিলোমিটারের ওই অঞ্চল ভারতের ছয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ,মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ এবং উড়িশ্যায় ছড়িয়ে রয়েছে। ওই অঞ্চলের জনসংখ্যা দুই কোটিরও বেশি। গোঁড়, কোন্ডারেড্ডি, ওড়িয়া গুদিজুরসাসহ বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীই ওই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ।”

বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের বিরুদ্ধে কার্যত সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছে কথিত সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্র। মধ্যবিত্তের চিন্তাশক্তিও দখল করে রেখেছে ক্ষমতাসীন শ্রেণী। বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ আজ দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এর বিপরীতে যারাই কথা বলছেন, তাদের হয় সামাজিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক চাপে দমিয়ে রাখা হচ্ছে, ‘মাওবাদী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘আতঙ্কবাদী’ ট্যাগ দিয়ে কারাগারে বন্দী করা হচ্ছে; নয়তো লিস্ট ধরে হত্যা করা হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদ, তথা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের সহিংসতাকে জায়েজ করছে মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবীরা। মিডিয়াগুলোও এই হিন্দুত্ববাদের সপক্ষে সাফাই গাইছে। আর এসব গণবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে যখন মাওবাদীরা লড়ছে তখন তাদের উপর চলে নৃশংস হামলা। অথচ মিডিয়া সেখানে নীরব!

একইসঙ্গে বইটি হত্যা, গুম, খুন, ক্রসফায়ার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিবে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সুস্পষ্ট চিত্র এ বইয়ে তুলে আনা হয়েছে– যার মূল ভিত্তিটুকু সম্পর্কে আমাদের সকলেরই জানা আবশ্যক–

“কর্পোরেট স্বার্থে নয়া–উপনিবেশবাদকে টিকিয়ে রাখতে সামরিক নীতি হিসেবে সামনে আনা হয় লো ইন্টেন্সিটি কনফ্লিক্ট (এলআইসি) বা নিম্ন মাত্রার যুদ্ধ নীতি; যা ডিভাইড অ্যান্ড রুল–এর থেকেও আগ্রাসী শোষণের তত্ত্ব।…

“এলআইসি হলো– জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, বিপ্লবী যুদ্ধের মতো বিশ্বের সকল ন্যায় যুদ্ধকে নৃশংসভাবে দমন করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের সূত্রায়নে রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতি। এতে সামরিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কর্মসূচী। আর তার সঙ্গে থাকে জনগণকে শাসকশ্রেণীর রাজনীতিতে একাত্ম করে নেওয়া, গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা এবং বিশেষ বাহিনী গঠন।”

‘বস্তার’ বইটিতে বিশ্বায়ন, নয়া–উপনিবেশবাদ, কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ‘কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ’ পরিভাষাটি আমার কাছে নতুন। তার ব্যাখ্যায় লেখক যে যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন, তাও ভীষণ গ্রহণযোগ্য।

“বিশ্বায়নের মানে হলো– সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বিশ্বায়ন। অর্থাৎ, ক্রমাগত নতুন নতুন ক্ষেত্রে এবং বিশ্বের নতুন নতুন অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির উৎপাদন–সম্পর্কের, পুঁজিবাদী মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদ নির্দেশিত গণতন্ত্র ও উন্নয়ন দর্শনের বিস্তারলাভ। পুঁজির বিশ্বায়ন নতুন ঘটনা না হলেও সাম্রাজ্যবাদের নয়া–উপনিবেশবাদী পর্যায়ে বিশ্বায়ন নতুন নতুন রূপ নিয়ে হাজির হয়। লগ্নি ও একচেটিয়া পুঁজির রপ্তানি ছিল তার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখন যা প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ, কর্পোরেট পুঁজির মাধ্যমে রপ্তানি হচ্ছে। ১৯৭০–এর দশক থেকে, বিশেষত ১৯৮০–এর দশকের শুরুর দিকে পুঁজিবাদের লাগাতার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়। আর এটিই হলো এসময়ে পুঁজিবাদের টিকে থাকার একমাত্র আধার। এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment) ও লগ্নিপুঁজি লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকতা পায় শ্রমের বিশ্বায়ন; যেখানে স্বল্প মজুরির শ্রমিক আর পরিবেশ দূষণের ঘোষিত/অঘোষিত লাইসেন্স পাওয়া যায়, সেখানেই আসবে পুঁজির বিনিয়োগ।”

“উপনিবেশ আর নয়া–উপনিবেশের মধ্যে পার্থক্য হলো– উপনিবেশকে একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রত্যক্ষভাবে শাসন করে তার নিজের সাম্রাজ্যের প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর দ্বারা; আর নয়া–উপনিবেশে এক বা একাধিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চালায় তার এজেন্ট বা দালালদের ক্ষমতাসীন করার মাধ্যমে, অর্থাৎ অপ্রত্যক্ষভাবে। বর্তমানকালে এই নয়া–উপনিবেশবাদ কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, নির্ধারিত, পরিচালিত।

“নয়া–উপনিবেশবাদের সঙ্গে কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। তবে ১৯৭০–এর দশকে তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়– বস্তুত তখন থেকে মার্কিন প্রশাসন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে গুটিকয়েক অধিজাতিক কর্পোরেশন দ্বারা। সেই সঙ্গে পেট্রো–ডলার ব্যবস্থা, সমরাস্ত্রের অর্থনীতি এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন অঞ্চলে অধিজাতিক ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর একচেটিয়া লুণ্ঠনতন্ত্রের মাধ্যমে কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে; যা নয়া–উপনিবেশবাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।…

“অর্থনৈতিক শোষণের কথা বিবেচনা করলে, নয়া–ঔপনিবেশিক পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা বিশ্বব্যাপী লুটপাটের মাত্রা ঔপনিবেশিক পর্যায়কেও ছাড়িয়ে যায়। জল, জমি, জঙ্গল, শ্রম, সম্পদ শুষে নেওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল, তার মাঝে প্রধান হলো–

১। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে;
২। পণ্যের অসম বিনিময়ের মাধ্যমে;
৩। ঋণের উপর ধার্যকৃত চড়া সুদের মাধ্যমে।”

 “কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ হলো একচেটিয়া ও লগ্নিপুঁজি, তথা কর্পোরেশনসমূহের সর্বময়তা। কর্পোরেশনগুলো প্রতিনিয়ত নজিরবিহীন শোষণের মাধ্যমে শ্রমিকদের দারিদ্র্য বৃদ্ধি করে, কর্পোরেট–বান্ধব সরকারগুলো ফ্যাসিবাদী কায়দায় শ্রেণীগত ও জাতিগত নিপীড়ন চালায়। বিশ্বব্যাপী শোষণের ক্ষেত্রে কর্পোরেশনগুলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ন্যাটো, গ্যাট, এডিবি, আইডিবি, ব্রিকস্‌ ইত্যাদির মতো প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন রাষ্ট্র ও তার সেনাবাহিনীকে উন্নয়নের নামে নয়া–উপনিবেশবাদী নীতির সম্প্রসারণ ও প্রয়োগে কাজে লাগায়। এশিয়া–আফ্রিকা–আমেরিকার যেসব দেশ নামসর্বস্ব স্বাধীনতা পেয়েছে, তাও এখন অকেজো হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের মাঝে বিভাজন তৈরি করাটাও সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালশ্রেণীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর এর মাধ্যমে কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ শ্রমিকদের অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের মাঝেই ঘুরপাক খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। তারা জনগণের মধ্যেকার বিপ্লবী চেতনাকে জাতিগত ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় বিভক্ত করছে। জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন গণ–বিরোধী, ফ্যাসিবাদী শক্তির, আর জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে যুদ্ধ। আর এ থেকেও কর্পোরেটগুলোর মুনাফা অর্জন নিশ্চিত হচ্ছে।”

বস্তারে বিপ্লবী কমিউনিস্ট রাজনীতি ব্যাপকতা লাভ করে ১৯৮০–র দশকে। তখন থেকেই সেখানকার আদিবাসীদের মধ্যে বিপ্লবী রাজনীতি শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠতে শুরু করে। ২০০৪ সালে গড়ে উঠে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মাওবাদী)। এই দলটির পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি–র একটা বড় অংশ ওই আদিবাসী জনগোষ্ঠী থেকেই এসেছে। ভূমিদস্যু, দালাল বুর্জোয়া, কথিত উন্নয়নের ঠিকাদার, বনরক্ষী, ভারত সরকারের আমলা, লুটেরা ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্রীয় পুলিশের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা সংগঠিত সংগ্রাম পরিচালনা করতে থাকে। এতে বেশকিছু অধিকার আদায় করতেও তারা সক্ষম হন।

“যখন কথিত বামপন্থী ও কমিউনিস্ট নামধারী প্রকাশ্য দলগুলোও আদিবাসীদের পক্ষে দাঁড়ায়নি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তখন ভারতের মাওবাদীরাই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর তাই আদিবাসীরা তাদেরই আপন করে নেন। রাষ্ট্রব্যবস্থাও সে সম্পর্কে অবগত। তাই ওই আদিবাসীদের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন।”

“বস্তারে একদিকে মাওবাদী মতাদর্শে সজ্জিত পিপল’স লিবারেশন গেরিলা আর্মি (পিএলজিএ) লড়ছে আদিবাসী, তথা সমগ্র জনগণের মুক্তির যুদ্ধ; অপরদিকে ভারতের শাসকশ্রেণী রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে দাঁড় করিয়েছে জনগণের বিরুদ্ধে কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস হিসেবে। পিএলজিএ তার সীমিত সাধ্যে ১৯৮০–র দশক থেকেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যে বাহিনীর একটা বড় অংশ ওই আদিবাসীদের থেকেই এসেছে।

“জনগণের এই লড়াই যেমন একদিকে জীবন–জীবিকা রক্ষার, অপরদিকে বন ও পরিবেশ রক্ষারও। কারণ বন না থাকলে তার প্রভাব যে তাদের জীবন–জীবিকাতেই পড়বে, তা ভুক্তভোগীরা বেশ ভালোই জানেন। কিন্তু এ পরিবেশ রক্ষার লড়াই–ই ভারতের কাছে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।…”

বইটিতে নয়া–গণতন্ত্রের বিশ্লেষণও যথার্থভাবে তুলে ধরা হয়েছে। “শ্রেবিভক্ত সমাজে গণতন্ত্রও সবার জন্য সমান হয় না। যেমন, ভারত রাষ্ট্রের বর্তমান ব্যবস্থায় দালাল বুর্জোয়াশ্রেণির নেতৃত্বে শাসকশ্রেণির অন্যান্য অংশ এই রাষ্ট্রের মালিকানা ভোগ করে, বা ব্যাপক নিপীড়িত জনগণকে শোষণ করে থাকে। এর বিপরীতে আমাদের কাছে জনগণের মানেই হলো, ব্যাপক নিপীড়িত জনগণ, সাম্রাজ্যবাদের দালাল শাসকশ্রেণি ও তার সহযোগীদের বাইরে যাদের অবস্থান। আর আমাদের নিকট গণতন্ত্রের মানেই হলো, শ্রমিক–কৃষক–মেহনতি জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব। সেই গণতন্ত্রের ক্ষমতা চর্চায় দালালদের কোনো স্থান নেই, এটাই নয়া-গণতন্ত্র।”

বইয়ের সারমর্ম বোঝার জন্য পরিশিষ্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই বইটির পরিশিষ্ট ঠিক সেই কাজটি সুনিপুণভাবে করেছে। ৪৬ পৃষ্ঠার পরিশিষ্ট বইটির মান দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। পরিশিষ্টে ‘সেক্যুলারিজম’ নিয়েও একটি অংশ রয়েছে। সেখানে সেক্যুলারিজমের নামে ভারত বা বাংলাদেশে চর্চিত ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্নিহিত ভণ্ডামো তুলে ধরা হয়েছে– “সমাজতাত্ত্বিক বা দার্শনিকভাবে সেক্যুলারিজমের (secularism) বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত শব্দটি হলো ‘ইহজাগতিকতাবাদ’। যে ব্যবস্থা পারলৌকিকতাকে অস্বীকার করে, চলতি কথায় যা ধর্মহীন। আর এ নিয়ে বেশ বড় রকমের বিভ্রান্তি রয়েছে। অথবা তা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে। আর এ ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে ব্যবহার করা হয়েছে ওই বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে। তারা সেক্যুলারিজমের একটা উদ্ভট এবং অগ্রহণযোগ্য ধারণা ফেরি করছে, আর তা হলো সেক্যুলারিজম মানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ।…

“…সেক্যুলারিজমকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ বলার মধ্য দিয়ে কিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে আধিপত্যের স্থানে আসীন করা হয়, সে বিষয়টিকে আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। ভারতে বিদ্যমান রয়েছে ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন। আর রাষ্ট্রের আইনে ধর্মতত্ত্বকে ধারণ করে সেক্যুলারিজমের কথা চিন্তাও করা যেতে পারে না। সম্প্রতি আমরা দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ইসলামি ‘তিন তালাক প্রথা’ নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী পুরুষতান্ত্রিক ও বর্ণবাদী সংস্কৃতিকে ভারতীয় সংস্কৃতি বলে প্রচারণা চালিয়ে, তা সমগ্র জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন তিনি ও তার ফ্যাসিবাদী পার্টি।…”

ভারতের শাসকগোষ্ঠির চরিত্র বোঝার জন্য বস্তার বইটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই প্রত্যাশা করি। প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারত কেন আমাদের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ? কারণ ভারতের বিপ্লব বাংলাদেশের বিপ্লবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর তাই দেশটির শাসকশ্রেণীর চরিত্র সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান থাকাটা খুব জরুরি। ভারত রাষ্ট্রকে কেন আমরা সম্প্রসারণবাদী বলি, সেটিও লেখক পরিশিষ্টে নিপুণ মুন্সিয়ানায় তুলে ধরেছেন–

“আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার করতে পারলেও ভারত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মতো নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম নয়। মূলত ভারত সাম্রাজ্যবাদের অনুচর রাষ্ট্র, আর এমন চরিত্রের রাষ্ট্রকেই আমরা অভিহিত করছি – সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে।”

মাওবাদের দর্শন ও অনুশীলনের ভিত্তি বোঝার ক্ষেত্রেও তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের একটা বৃহৎ অংশ মাওবাদী দলে যুক্ত– যে মাওবাদীরা আদিবাসীদের সকল সুখ–দুঃখের নিত্যসঙ্গী। মাওবাদী আন্দোলন আজ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করছে, যা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। আমাদের দেশেও এই বিপ্লবী মতাদর্শকে আঁকড়ে ধরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ুক। এটুকু আশাবাদ আমরা রাখতেই পারি।

‘বস্তার’ বইটি পড়ে ‘শিল্প–সাহিত্যের উৎস সম্পর্কে’ মাও সে–তুঙের কথার প্রাসঙ্গিকতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। ১৯৪২ সালে ওই প্রবন্ধে মাও বলেছিলেন, ‘শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হচ্ছে জনগণের সামাজিক জীবন। মতবাদগত রূপ হিসেবে শিল্প–সাহিত্যের রচনার উৎপত্তি হয় মানুষের জীবনের প্রতিফলন থেকে। তেমনি বিপ্লবী শিল্প–সাহিত্য রচনার উৎপত্তি হয় বিপ্লবী শক্তি ও সাহিত্যিকদের মগজে জনজীবনের যে প্রতিফলন হয়, তা থেকে। জনগণের জীবনে শিল্প ও সাহিত্যের কাঁচামাল সব সময়েই থাকে অজস্র পরিমাণে, থাকে স্বাভাবিক ও অমার্জিত অবস্থায়– কিন্তু এইসব মালমশলাই হচ্ছে সবচেয়ে প্রাণবন্ত, মূল্যবান ও মৌলিক।…’

শাহেরীন আরাফাতের লেখা এ বইটি নিশ্চিতভাবেই বিপ্লবী সাহিত্যের অংশ। যে সাহিত্যের প্রধান কাঁচামাল মানুষ, প্রকৃতি, শ্রেণিসংগ্রাম। শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন, কর্ম, জীবন ও জীবিকা সমাজের বিশেষ বিশেষ অবস্থার সঙ্গে জড়িত থেকে সাহিত্য রচনা করাই বিপ্লবী সাহিত্যিকদের কাজ। যে সাহিত্যের বড়ই অভাব এ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়। আর এসময় যখন ‘বস্তার’এর মতো বইটি লেখা হয়, তা নিঃসন্দেহে আলোর দিশারী। আলো দিয়েই আলো জ্বালাতে হয়। বস্তার বইটি সেই আশার আলো দেখিয়েছে। এ ধরনের সাহিত্য আরো বেশি বেশি লেখকের কাছ থেকে প্রত্যাশ করি। লেখক আমাদের অনুপ্রেরণার শক্তি হোক, আমাদের বিপ্লবী প্রতিভাকে বিকশিত করার জন্য সহযোগিতা করুক তার লেখনীর দৃঢ়তাবলে। সেইসঙ্গে বিপ্লবী সাহিত্যের নতুন লেখকরা সামনে আসুক সেই প্রত্যাশাটুকুও করি।

একটা কথা আমরা উপলব্ধি করতেই পারি– রচনার বিপ্লবী রাজনীতিক বিষয়বস্তু সত্ত্বেও শিল্পরূপ উৎকৃষ্ট না হলে, রচনা স্লোগান সর্বস্ব হয়ে পড়লে তার আবেদন জোরদার হতে পারে না। সুতরাং শিল্পরূপ উৎকৃষ্ট হওয়ার দাবি রাখতেই পারি। সাহিত্যের বিচার ও সমালোচনা বাড়ুক– এই প্রত্যাশাও করি। সর্বশেষ, এটুকু বলে সমাপ্তি টানার চেষ্টা করছি– লেখককে আরও সহজ, সাবলীল হতে হবে। যাতে আমার মতো আমজনতা বইটি পড়ে উপলব্ধি করতে কোনো বেগ পেতে না হয়। সর্বসাকুল্যে ‘বস্তার’ বইটির প্রচার চাচ্ছি, যে দায়ভার মুক্তিকামী প্রতিটা মানুষেরই রয়েছে। সেই দায়ভার নিয়েই শেষ টানছি।

একুশে বইমেলা ২০১৮