বানান বিরেশ্বরি: শিল্পি মাহালানবিশ সমীপে

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৭, ২০১৮

বাংলাভাষি ব্যাপক খবিশেরা উচ্চারণ করে, মহলানবিশ। ইংরেজি বানানে তা কি জাতে উঠে হয় মাহালানবিশ? একাত্তর মিডিয়া লিমিটেডের জনৈক কর্তা, যার ডাকনাম শিল্পি ইংরেজিতে তার পদবির বানান লেখেন মাহালানবিশ। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনিতে চাকুরিরত আমার বাবা। আমার নামের ইংরেজি যে বানান নির্ধারণ করেছিলেন, তাতে আমার নাম দাঁড়িয়েছিল চায়ান। যার ইংরেজি আকারান্ত বাতিল করে আমি আবার খবিশ শ্রেণির ওকারান্ত যোগে হয়ে যাই চয়ন। আমার সবেচেয়ে বড় বোনের নাম ছবি। বাবাকৃত ইংরেজি বানান তরিকায় তা বেহালে দাঁড়ায়, চাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিতে স্নাতোকোত্তর বড় বোন সেই চাবিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে হাসেল রেখেছেন।
ভাববেন না, না বুঝে খবিশ খবিশ করছি। বাংলা ওকারান্তের প্রাবল্য এসেছিল প্রাকৃত উচ্চারণ থেকে। বাংলা উচ্চারণের ভিত্তি যে সংস্কৃত নয়, প্রাকৃত, তার যোগসূত্রও এই ওকারান্তে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালেও বাঙালি লিখেছে, পোড়বো, কোরবো। এক জাতের বাঙালি যেরকম তার বিদেশি ঠিকুজি দেখিয়ে আরাম পায়, সেই একই জাতের বাঙালি সংস্কৃত বানানসূত্রের পরীক্ষা দিয়ে প্রবোধ লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, প্রাচীন বাঙালি বানান সম্বন্ধে নির্ভীক ছিলেন। পুরানো বাংলা পুঁথি দেখিলেই  তাহা বুঝা যায়। আমরা হঠাৎ ভাষার উপর পুরাতত্ত্বের শাসন চালাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছি। এই শাসন ম্যালেরিয়া প্রভৃতি অন্যান্য নানা উপসর্গের মতো চিরদিনের মতো বাঙালির ছেলের আয়ুক্ষয় করিতে থাকিবে। (রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর/বাংলা শব্দতত্ব/বাংলা বানান)।
ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচতে আমি রবিন্দ্রনাথের ঈকার বাদ দিলাম রবিন্দ্রনাথেরই ভরসায়। যার যার বাপমায়ের দেয়া নাম, য্যামন খুশি স্বর, ব্যাঞ্জনে সাজাবে। এসব খটোমটো, বাদানুবাদের ভেতর মিডিয়া কর্তা মাহালানবিশকে টানাহেঁচড়া কেন? একখানে অপর গণমাধ্যম কর্তা উদিসা ইমনের প্রতি নিচের কথাবার্তা চোখে পড়লো বলে।
Shilpi Mahalanobish তোমার বাংলা বানান কি নিজের তৈরি?
Udisa Emon জ্বি। আমার প্রোফাইলের সব আমার নিজের। আমি নিউজ লিখি যখন তখন বাংলা একাডেমির নিয়ম মানি। কোনও সমস্যা?
Shilpi Mahalanobish সমস্যা কিছু নাই। ভাবলাম আমার কেথাও ভুল হচ্ছে কিনা। ফেসবুকও তো বড় একটা মাধ্যম। হয়তো এখান থেকেই কেউ ভুল বানানের ফলোয়ার হলো...
Udisa Emon apa OMG, hello france (friend) esober motoi banglateo samaji jogajog er banan riti daraise... chinta koiren na..
সকলে হয়তো অবগত আছেন যে, হরেক কিসিমের বাংলা ফন্টের জায়গিরদার মোস্তফা জাব্বার সাহেব এখন একজন পুরোদস্তর গজদন্তমিনারবাসী। মন্ত্রী হবার আগে যে মোস্তফা জাব্বারের নাগাল ধরতে পারি নাই, গজদন্তমিনারে আসীন হবার পর যে উনি নাগালের আরো বাইরে, তা লেখা বাহুল্য। এখানে আমাদের মতো খবিশদের ভরসা শিল্পি মাহালানবিশদের মতো বাংলা বানান সচেতন গণমাধ্যম বিরেশ্বরিগণ। তারা নিশ্চয় ইউনিকোড এবং সর্বজনীন বাংলা ফন্টের জন্য আপামর খবিশদের আহাজারি গজদন্তমিনারে পৌঁছায়ে দেবেন।
পৌছায়ে দেবার আগে শিল্পি মাহালানবিশকে, মৌলবাদিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত প্রয়াত বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের ব্লগ মুক্তমনাতে বানান বিষয়ক বিতণ্ডা আমার বানান-বেআদবি ঘিরে ২০১০ সালে কোন সপ্ত আসমানে পৌঁছেছিল তার শিরোনাম ছিল, ভাষাচিন্তা: পোকায় কাটা কয়েকটা দাঁত ফেলে দিলেই দুখিনি বর্ণমালার দাঁতব্যথা সেরে যাবে।
সাত বছর আগে লিখেছিলাম, সম্প্রতি অভ্র ইউনিকোড ফন্টের ডেভলাপার এবং চর্চাকারীদের সাথে, বিজয়-পণ্য সামগ্রির যে বিরোধ তাতে সঙ্গত কারণেই আমার অভ্র দলের দিকে পক্ষপাত করা দরকার। আমি অভ্র ব্যবহার করি। আনফ্রেন্ডলি সফটওয়্যার হওয়াতে বিজয়, সোলায়মানি এসব কখনোই ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনি।
সখ্যের সহজিয়ায় অভ্র ইউনিকোড, বিজয়-পণ্য-সামগ্রী থেকে অনেক এগিয়ে থাকলেও; ভাষার পেছনে ভাব প্রকাশকে অর্গলমুক্ত করার এবং আবার ভাষাকেই শ্রেণি শাষণের মূল হাতিয়ারে পরিণত করার যে-কায়েমি প্রয়াস সেই দার্শনিক বিরোধে; অভ্র এবং বিজয়ের দ্বন্দ্বকে আমার শুধু skill বা প্রায়োগিক মনে হয়েছে। মনে হয়েছে সামগ্রিকভাবে যে-জিঞ্জিরা কালচার চলছে তারই বিস্তার। এর পেছনে সনাতনের অচলায়তন ভাঙার কোনও ইশারা এখনো পাইনি।
সাত বছর পর শিল্পি মাহালানবিশকে দেয়া উদিসা ইমনের (না কি এমন?) উত্তরগুলো পড়ে ভরসা করতে লোভ হয় যে, এক জীবনে হয়তো মাতৃস্বর, মাতৃব্যাঞ্জনের সর্বজনীন সরলিকৃত সংস্কার দেখে যেতে পারবো।
সাত বছর আগে যখন আদালতের রায় অবমাননা করে অভ্রের পক্ষে কলম ধরেছিলাম, তখন তার নির্মাতা মেহেদি হাসানের নাম জানতাম না। আজকে মেহেদি সাহেবকে যে সালাম জানাচ্ছি তা ঈকার মুক্ত হলেও সম্মানের আন্তরিকতায় যে কোনও ইলেকচিহ্ন থেকে দীর্ঘতরো। ধন্যবাদ জানাই জুলেখা সিরাপের এডমিনদেরও এ বিষয়ে লাগাতার লিখে যাবার জন্য।
প্রণতি জানাই, বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক মানুষ দত্ত কুলোদ্ভব মাইকেল চরণে, যিনি লিখেছিলেন:

মিত্রাক্ষর:
বড়ই নিষ্ঠুর আমি ভাবি তারে মনে,
লো ভাষা, পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে
মিত্রাক্ষররূপ বেড়ি! কত ব্যথা লাগে
পর` যবে এ নিগড় কোমল চরণে
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে
ছিল না কি ভাবধন, কহ, লো ললনে,
মনের ভাণ্ডারে তার, যে মিথ্যা সোহাগে
ভুলাতে তোমারে দিল এ তুচ্ছ ভূষণে?
কি কাজ রঞ্জনে রাঙি কমলের দলে?
নিজরূপে শশিকলা উজ্জ্বল আকাশে!
কি কাজ পবিত্রি` মন্ত্রে জাহ্নবীর জলে?
কি কাজ সুগন্ধ ঢালি পারিজাত-বাসে ?
প্রকৃত কবিতা রূপী কবিতার বলে,
চীন-নারী-সম পদ কেন লৌহ ফাঁসে?