বিজ্ঞান ও ইসলাম

প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম

প্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০১৮

একথা কারও অজানা নয় যে, বিজ্ঞানের জয়যাত্রার বহু পূর্বেই বিজ্ঞানের মৌলিক নীতিগুলি ইসলাম জগতের সামনে উপস্থিত করেছে। শুধু তাই নয়, ইসলামের আবির্ভাবের পর বিজ্ঞানের উন্নতি ইসলাম ও বিজ্ঞানের মধ্যে একটি কার্যকারণ সম্পর্ক সূচিত করে।

বিশ্বের ঐক্যবোধ ইসলামের একটি মহান অবদান। অতীতের বিভিন্ন ধর্ম বহু সৃষ্টিকর্তার স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্ব ও সমাজকে বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্নরূপে দেখেছে। এমনকি ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মও এই বহুত্বের ত্রুটি হতে সবক্ষেত্রে মুক্ত ছিল না। কিন্তু ইসলামই প্রথম এক সৃষ্টিকর্তার অধীনে এক অখণ্ড বিশ্বের ও আইনের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রবর্তন করে। ইসলামের ঐক্য ধারণা, যাকে আমরা তৌহিদ বলি, এতদূর অগ্রসর হয় যে, এর মতে পৃথিবীতে প্রকৃত ধর্মও বহু নহে, একটিমাত্র, এবং সেটা ইসলাম। বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন যুগে সে সমস্ত ধর্মপ্রচারক এসেছিলেন, তাঁরাও ইসলাম ধর্মের এক একজন পয়গম্বর ছিলেন। কোরআনের বিবৃতি অনুসারে এমন কোনও দেশ বা জাতি নাই যেখানে অতীতে ইসলামের নবি প্রেরিত হয়নি। ইসলাম স্বীকার করে না যে, শুধুমাত্র এক ব্যক্তিই ইসলাম প্রচার করেছেন। ইসলামের প্রবর্তক শুধু হযরত মুহাম্মদ (সা.) নন। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এবং বিভিন্ন দেশের আরও হাজারও মহাপুরুষ ইসলামের এক একজন বিশিষ্ট পয়গম্বর। তাই ইসলাম সমস্ত মানবতার ধর্ম, এটা সাম্প্রদায়িক ধর্ম নয়।

ইসলামের ঐক্য ধারণায় প্রকৃত সত্য অবিনশ্বর ও নিত্য। এটা সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তনশীল নয়। আর এই সনাতন সত্য প্রচারের জন্যই বিভিন্ন যুদে পয়গম্বররা আগমন করেছিলেন।

এক আল্লাহয় বিশ্বাসের ফলে সমস্ত বিশ্বজগৎ একই নীতির অধীন, এই ধারণা ইসলামই জগতে সর্বপ্রথম সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে, লৌকিক ও পারলৌকিক এই দুটির বিচ্ছিন্নতাও ইসলাম স্বীকার করে না। শুধু তাই নয়, জীবনের সর্বদিকের ঐক্যে বিশ্বাস করে বলেই ইসলাম রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতিতে কোনও বিচ্ছিন্নতা মেনে নেয়নি। রাজনীতি-অর্থনীতি সবকিছু মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত। মানুষের জীবনের বিভিন্ন বিভাগ থাকলেও কোনোটা বিচ্ছিন্ন নয়, ঐক্যসূত্রে সবটাই গ্রথিত। এজন্য একই মানব জীবন একই নীতির দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত বলেই জীবনের সাথে জড়িত কোনও দিককেই বিচ্ছিন্ন করে দেখা ভ্রান্তিমূলক। এজন্য জীবনের কোনও ক্ষেত্রে ধর্ম-নিরপেক্ষতার স্থান ইসলামে নেই। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিরই এটা স্বাভাবিক ফল। কারণ বিজ্ঞানের প্রথম মূলনীতি আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়ে থাকে।

ইসলামে পয়গম্বরদেরকেও অতিমানুষ বলে ধারণা করার কোনও অবকাশ নেই। কোরআন তাই স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, হযরত মুহাম্মদও (সা.) একজন মানুষ এবং তিনিও বিশ্বের একই নিয়মের আয়ত্তাধীন। যখন তাঁর এক পুত্রের মৃত্যুর সময় সূর্যগ্রহণ হয়, তখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন কুরাইশা এটাকে হযরতের অলৌকিক শক্তির প্রমাণ মনে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অগ্রসর হয়েছিল। সে সময়ে মহানবি ঘোষণা করেছিলেন, চন্দ্র-সূর্য আল্লাহর আইন অনুসরণ করে এবং এরা কোনও নবি বা সাধারণ লোকের দ্বারা আদৌ প্রভাবিত হয় না। সেই চৌদ্দশো বছর আগে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের পূর্ণ বিকাশের বহু আগে এই রকম যুক্তিবাদের অবতারণা সত্যিই সকলকে অবাক করে দেয়।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) শেষ নবি, তার পর আর কোনও নবি আসবেন না- একথা অযৌক্তিক বলে মনে হয়। কিন্তু এ ব্যাপারেও মৌলিকভাবে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। দার্শনিক স্পিনোজা জ্যামিতিক নিয়মে চিন্তার ঐক্য প্রমাণ করেছিলেন। মৌলিক চিন্তা ও যুক্তির ঐক্য প্রমাণ করে যে, পূর্ণ ক্ষেত্র প্রস্তুতির পর এটা বারবার প্রকাশের আবশ্যকতা নেই। একই সত্য বারবার বলার যৌক্তিকতা কোথায়? এজন্য বলা হয়ে থাকে, হযরত মুহাম্মদের (সা.) আবির্ভাবের সময় ও কিছু পরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে চলাচল ও ভাবের ব্যাপক আদান-প্রদান শুরু হয়। আগে যেমন এক দেশ অন্য দেশের কাছে ছিল অনধিগম্য, এখন তা আর রইল না। সুতরাং ইসলামের সত্য পৃথিবীর সব দেশে পৌঁছার মতো পরিবেশ তখন সৃষ্টি হয়েছিল। যা অতীতে সম্ভব ছিল না। আর এজন্য আগে বিভিন্ন দেশে সত্য প্রচারের জন্য বিভিন্ন মহাপুরুষের আবশ্যক ছিল। দ্বিতীয়ত, তখন লেখাপড়ার পদ্ধতি এমন স্তরে এসেছিল যে, কোরআনের মতো মহাগ্রন্থ অবিকৃত অবস্থায় রাখা সম্ভব হয়েছিল। ফলে অতীতে যেমন ধর্মপুস্তক বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা, এবং হয়েছেও, এখন তা দূরীভূত হওয়ার ফলে পুনরায় ধর্মপ্রচারকের কোনও আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। তবু মৌলিক যুক্তি এক হলেও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তা বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্নরূপে প্রকটিত হয় বলে তার সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে যুগে যুগে সংস্কারক ও মহাচিন্তাবিদদের আগমনের আবশ্যকতা ইসলাম স্বীকার করেছে।

এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার। পূর্ণ সত্য পূর্ণরূপে প্রচারিত হবার পরেও যদি নতুন পয়গম্বর আসার নীতি স্বীকৃত হতো, তাহলে বহু প্রকৃত ও বহু ভূয়া পয়গম্বরের আবির্ভাবে ও বহু ধর্মের প্রতিষ্ঠায় মনুষ্য সমাজ অধিকতর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। হযরত মুহাম্মদের (সা.) তিরোধানের পরই বহু ভূয়া পয়গম্বরের আবির্ভাবে কী অনর্থ ঘটেছিল, তা ইতিহাস-পাঠকদের অবিদিত নয়।

ইসলামের আরেকটি বৈশিষ্ট হলো, ব্যক্তিকে সে এক বিশিষ্ট স্থান দিয়েছে। কোরআনে তার বহু নজীর আছে। মহাকবি আল্লামা ইকবালের আসরারে খুদিরের মধ্যে মানুষের এই ব্যক্তিসত্তার অসীম গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিজ্ঞানের দ্বিতীয় নীতিও এটাই। বস্তুকে বিশিষ্ট অবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া।  

লেখকের ‘বিজ্ঞান সমাজ ধর্ম’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো