বোধিসত্ত্ব

শেষ পর্ব

ছায়াবীথি শ্যামলিমা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০১৯

বোধিসত্ত্বের মহাকরুণা ও সাত্ত্বিক দর্শন: বোধিসত্ত্ব যানকেই মহাযান বলা হয়। মহাযানে বোধিসত্ত্বযানের কল্পনা এক অদ্বিতীয়, শক্তিশালী, উদার এবং উপাদেয় সিদ্ধান্ত— যার ফল স্বরূপ বৌদ্ধধর্ম এশিয়ার এক বিশাল ভূখণ্ডের উপর আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয়েছিল। তারই সুদূর প্রসারী পরিণাম আজ মহাযান অধ্যুষিত চীন, জাপান, কোরিয়া, মাঞ্চুরিয়া, ভিয়েতনাম, তিব্বত, ভূটান প্রভৃতি দেশ এবং লাদাখ সিকিম, দাজিলিং প্রভৃতি ভারতের বিস্তৃত পার্বত্য প্রদেশ সমূহে কোটি কোটি মানুষ বুদ্ধের অনন্য ভক্ত। মহাযানের এই উদার মহত্বশালী এবং ক্রমবিকশিত ও সম্প্রসারণশীল নীতিই এই রূপ অসাধারণ সফলতা লাভে সমর্থ হয়েছিল। মহাযান ধর্ম যে শুধু বৌদ্ধধর্মের তত্ত্ব বিশ্লেষণে এই সকল দেশের অগণিত মানব হৃদয় জয় করেছিলেন তা নহে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের অনেক ধর্মবিশ্বাসকেও নিজের মধ্যে গ্রহণ করেছিল, ইতিহাসই তার স্যা দেয়।

বোধিসত্ত্বযানের শাব্দিক অর্থ বোধি বা জ্ঞান প্রাপ্তির মার্গ। এই মার্গ দিয়েই অগ্রসর হলেই সাধক এক বিশিষ্ট মার্গফলের অধিকারী হন। তা প্রাপ্তির জন্য অন্য এক বিশিষ্ট সাধনার প্রয়োজন, তা হল সপ্তত্রিংশৎ বোধিপীয় ধর্মের মাধ্যমে পারমিতা সমূহের পূর্ণতা প্রাপ্ত করা। স্থবিরবাদীদের মতে পারমিতা সিদ্ধান্ত দশ প্রকার: দান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, প্রজ্ঞা, বীর্য, কান্তি, সত্য, অধিষ্ঠান, মৈত্রী ও উপো। পরন্তু মহাযানী গ্রন্থে পারমিতা ছয় প্রকার : দান, শীল, কান্তি, বীর্য, ধ্যান ও প্রজ্ঞা। পরবর্তীকালে উপায়কৌশল্য, প্রণিদান, বল ও জ্ঞান সহযোগে তার সংখ্যাও দশ করা হয়েছে; পরন্তু ষ্ট পারমিতাই অধিক প্রসিদ্ধ ও প্রামাণিক মানা হয়। এদের মধ্যেও আবার প্রজ্ঞার প্রাধান্যই সর্বাধিক। বোধিসত্ত্বযান বা মহাযানের অনুশীলন ঐ সকল ব্যক্তির পইে সম্ভব, যাঁদের প্রজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে মহাকরুণাও বিদ্যমান। ‘আর্য গয়াশীর্ষ’ নামক তন্ত্র গ্রন্থে মঞ্জুশ্রী হতে জিজ্ঞাসা করছেন যে, বোধিসত্ত্বচর্যার আরম্ভ কি? আর ইহার অধিষ্ঠান বা আলম্বন কি?

উত্তরে মঞ্জুশ্রী বলেছেন, বোধিসত্ত্বচর্যা মহাকরুণা পর:সর আর মহাকরুণাই ইহার আরম্ভ এবং দুঃখিত প্রাণীই মহাকরুণার আলম্বন। এইজন্য ধর্মসঙ্গীতিতে বোধিকারক ধর্মসমূহে মহাকরুণাকে সর্বপ্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। এর মতে বোধিসত্ত্বদের কেবল একই ধর্ম স্বায়ত্ব করা দরকার— যার নাম মহাকরুণা। এই মহাকরুণা যেই মার্গানুসরণ করে, অপর বোধিকারক ধর্মসমূহও সেই মার্গরই অনুগমন করে, যেমন- জীবিতেন্দ্রিয় থাকলেই অন্য ইন্দ্রিয় সকল প্রবৃত্ত হয়।

জগতের কল্যাণ সাধনই বোধিসত্ত্বগণের জীবনের পরম উদ্দেশ্য। তাঁদের স্বার্থ এতই বিস্তৃত যে, স্ব এর পরিধির ভিতরই জাগতিক সমস্ত প্রাণী সমাহিত হয়। বিশ্বের একজন মাত্র প্রাণীও যদি দুঃখানুভাব করতে থাকে, তাহলে তাঁরা স্বীয় মুক্তিও তৃণবৎ ত্যাগ করেন। তাঁদের হৃদয় করুণা দ্বারা এতই দ্রবিভূত হয় যে, দুঃখীর দুঃখে সতিই বিগলিত হয়ে উঠে। তাই শান্তিদেব বোধিসত্ত্বের করুণা সম্বন্ধে নিম্নোক্ত শ্লোকে তা ব্যক্ত করেছেন—
এবং সর্বমিদং ক্বত্বা যন্মস্না সাধিতং শুভং,
তেন স্যাং সর্বসত্ত্বানাং সর্বদুঃখ প্রশান্তিকৃত। (বোধিচর্যাবতার, ৩। ৬)

সৌগতমার্গের অনুষ্ঠান দ্বারা আমি যেই পুণ্যসম্ভার অর্জন করেছি, তাদ্বারা আমার এই কামনা যে, সমস্ত প্রাণীর দুঃখ শান্ত হোক। মুক্ত পুরুষের হৃদয়ে যেই আনন্দ সমুদ্রের হিল্লোল উঠে, ইহাই আমার জীবনকে সুখী করতে পর্যপ্ত, রসহীন শুষ্ক মোক্ষ লাভে আমার কি প্রয়োজন? যথা-
‘মুচ্যমানেষু সত্ত্বেষু যে তে প্রমোদ্যসাগরা:,
তৈরেব নভু পর্যাপ্তং মেণোরসিকেন কিং।’ (বোধিচর্যাবতার, ৮। ১০৮)

অতএব বোধিসত্ত্বগণ নিজের পরার্থে স্থাপন করতে বিশ্বপ্রাণীও পরার্ধে স্থাপন করতে চান এবং নিজের পরিনির্বাণের অপেক্ষা না করে বিশ্বপ্রাণীকেই নির্বাণে পৌঁছাতে চান, এটাই বোধিসত্ত্বচর্যার পরম পরার্থতা, চরম সার্থকতা।

সাত্ত্বিক জীবন বোধিসত্ত্ব কল্পনার তাৎপর্য: বোধিসত্ত্ব আদর্শের বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করে দেখা গেল, সর্বপ্রথম যখন মহাযানে বোধিসত্ত্বের কল্পনা অঙ্কুরিত হয়, তখন অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বই প্রথম দেখা দেন। তাঁর পরই মঞ্জুশ্রী বোধিসত্ত্বের আবির্ভাব। তাঁদের মধ্যে অবলোকিতেশ্বর ছিলেন করুণার প্রতীক আর মঞ্জুশ্রী হলেন প্রজ্ঞার অধিকারী। বিকাশের প্রথম অবস্থাতে প্রজ্ঞার স্থান হল করুণা হতে অধিক মহত্ত্বশালী। এর তাৎপর্য এই যে, মঞ্জুশ্রী বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব হতে অধিক মহত্বপূর্ণ পরে এই ক্রমের পরিবর্তন দেখা দেয় এবং প্রজ্ঞা হতে করুণা অধিক উচ্চস্থান প্রাপ্ত হয়। পরবর্তীকালে সামন্তভদ্র, বজ্রপাণি, বজ্রগর্ভ, জ্ঞানগর্ভ, ক্ষিতিগর্ভ, রত্নগর্ভ, আকাশগর্ভ, সূর্যগর্ভ, মৈত্রেয় প্রভৃতি অনেক বোধিসত্ত্বের কল্পনা অঙ্কুরিত হয়। এদের মধ্যেও আবার করুণার প্রতীক রূপে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের স্থানই সর্বোচ্চে নিশ্চিত হয়।

উপরি উক্ত বোধিসত্ত্বের যে কল্পনা বিকাশ লাভ করেছিল, তাতে নিশ্চিত কোন ঐতিহাসিক আধার নাই, তবে গৌতম বুদ্ধের পূর্ব জীবনচর্যার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল বোধিসত্ত্বের কল্পনা। বুদ্ধ যেই করুণা দৃষ্টিতে বিশ্বসংসার জ্ঞানাবলোকন করেছিলেন, তারই প্রতীকরূপে অবলোকিতেশ্বরের কল্পনা অঙ্কুরিত হয়েছিল। এই রূপে বুদ্ধের মঞ্জুঘোষ মঞ্জুশ্রী বোধিসত্ত্বরূপে প্রতীকবদ্ধ হয়েছে। এভাবে অন্যান্য বোধিসত্ত্বেরাও বুদ্ধের বিভিন্ন জীবন ও ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন গুণব্যুহের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়েছে। অবলোকিতেশ্বরের উপরি উক্ত গুণব্যুহতে এর সমর্থন মিলে। অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব যে শুধু করুণার পারাবার ছিলেন তা নয়, তিনি সৃষ্টির স্রষ্টাও ছিলেন। কারণ্ডব্যূহ তথা অন্যান্য মহাযান সূত্র গ্রন্থে বলা হয়েছে, অবলোকিতেশ্বরের চু হতে চন্দ্র-সূর্য হতে মহেশ্বর, বাহু হতে ব্রহ্মা আদি দেবগণ, হৃদয় হতে নারায়ণ, দন্ত হতে সরস্বতী, মুখ হতে মরুত, পদ হতে পৃথিবী আর উদর হতে বরুণের উৎপত্তি হয়। এইভাবে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বকে সর্বোচ্চ সিংহাসনে বসান হয়েছিল।

তাঁদের কল্পনায় তিনি শুধু সৃষ্টিকর্তা ছিলেন না; মুক্তিদাতাও ছিলেন। তাই বোধিচর্যাবতার গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘আমি অনাথের নাথ, যাত্রীর স্বার্থবাহ পারে ইচ্ছুক তরণী, সেতু ও ধরণী ; দীপার্থীর দীপ, শর্য্যার্থীর শর্য্যা, দাসার্থীর দাস; এই ভাবে আমি সমস্ত প্রাণীর সেবক হব।

পালি সাহিত্যের জাতক নিদান গ্রন্থে মহাযানী বোধিসত্ত্বের আদর্শের মূলস্রোত খুঁজে পাওয়া যায়। গৌতম বুদ্ধ সুমেধ তাপস অবস্থার চিন্তা করেছিলেন যে, আমি যদি চেষ্টা করি তাহলে অবশ্যই সর্বপ্রকার চিত্তমালিন্য নিঃশেষ করে সংঘভুক্ত হয়ে নির্বাণ লাভ করতে পারি; কিন্তু বলবীর্য সম্পন্ন পুরুষের পে একাকী মুক্ত হওয়ার কি ই বা সার্থকতা আছে। আমিও দীপঙ্কর দশবলের ন্যায় সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ করে দেব-মানব সহ অসংখ্য প্রাণীকে মুক্ত করব। তাই জাতক নিদানে বলা হয়েছে,

‘কিং মে একেন তিন্নেন পুরিসেন থামদস্সিনা,
সব্বঞ্ঞূতং পাপূনিত্বা সন্তরেস্সং সদেবকং।’

কি উদাত্ত ভাবনা, বিশ্বপ্রাণীর সঙ্গে নিজকে একাকার করার কি বিহ্বলতা, পরার্থে আত্মার্থ বিলীন করে দেওয়ার কি অদম্য উদ্যোগ। এইত বোধিসত্ত্ব আদর্শের চরম বিকাশ, পরম পরাকাষ্ঠা। চীন, জাপান আদি বৌদ্ধ দেশে এর বিপুল প্রভাব, লোক সেবার ধার্মিক অভিব্যক্তি রূপে আজও বিদ্যমান। পরবর্তী কালে ইহাই প্রচারকদের মধ্যে এই উদাত্ত ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়। সাধনা ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে সেবাধর্মের সমন্বয় বৌদ্ধ আচার্যদের জীবনের মহান আদর্শ মহাযানে এসে চরম বিকাশ লাভ করে, যার ক্রিয়াত্মক রূপ ভারত তথা বিশ্বের অনেক দেশে আজও ক্রিয়াশীল।

উপসংহার: মহাযান বৌদ্ধধর্ম দর্শন প্রাচীন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহাযান মতাদর্শ বুদ্ধোত্তর কালে প্রচলিত হয়। এ মতবাদের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্বের জীবন ও দর্শনকে ভিত্তি করে আবতির্ত হয়েছে। আলোচ্য এ প্রবন্ধে বোধিসত্ত্বের নানা দিক ও বৈশিষ্ট্যতা আলোচনার পাশাপাশি আদর্শ উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিভাত হয়েছে- প্রথমত: মহাযান ধর্মদর্শনের বিবর্তন, প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য, বোধি মার্গ বা যান। দ্বিতীয়ত : মহাসত্ত্ব বোধিসত্ত্বের জীবন ও দর্শন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যউপাত্ত। তৃতীয়ত: মহাযান ধর্মদর্শনে বোধিসত্ত্বের সাতটি বিষেশত্ব ও দশভূমি ভাবনা। চতুর্থত : বোধিসত্ত্বের আদর্শ ও উদ্দেশ্য এবং মহাকরুণা ও তাৎপর্য। এ পর্যালোচনার ফলে পালি সাহিত্য তথা বৌদ্ধ সাহিত্য ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ হবে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরো অধিক গবেষণা, চর্চা ও প্রয়োগিক দর্শন প্রয়োজন।