ভূত বিলাসের ঘর

পর্ব ৮

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ০৯, ২০১৮

বন্ধু বদলে যায়। বন্ধু বদলাতে থাকে আজীবন। যার সাথে ছিল আপ্রাণ সখ্য, মনে হতো এই বুঝি জীবনের শেষবেলা অবধি থাকবে, তাকেই হঠাৎ একদিন অপরিচিত বোধ হতে থাকে। আবার যে ছিল অনন্য আবডালে, সে হঠাৎ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়। বন্ধু বদলে যায়। বন্ধুতা বদলায় না।

অনেক অ্যাটেনশনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলাম আমি। লেখাপড়ায় আমার চলাচল ছিল অপ্রতিরোধ্য। বাংলা থেকে ইতিহাস, অঙ্ক থেকে বিজ্ঞান, সবেতেই ছিল অবাধ বিচরণ। দুর্বল জায়গা খুঁজে বের করা ছিল প্রায় অসম্ভব। অনেক মা-বাবাই চাইতেন, তার মেয়ে শ্রেয়ার মতো হোক। এমনও হতো, কোনো কোনো বছর আমার ক্লাসের জন্য নির্ধারিত সব প্রাইজই আমি পেতাম। এমনকি এক্সট্রা ক্যারিকুলারেও। এ আমার বড় ভুল ছিল। সব স্পেসটাই কারোর একার হওয়া ঠিক নয়। এর ছিল বেশ কিছু বিষময় ফল।

আমাদেরই ক্লাসে আমার বন্ধু ছিল মেঘ। তখন ক্লাস ওয়ান কী টু। একদিন তার বাড়িতে গেছি। গিয়ে শুনি, তার মা বিরাট চেঁচামেচি করছে। কোনো এক পরীক্ষায় মেঘের নম্বর আশানুরূপ হয়নি। তার মা তাকে বলছে, ‘শ্রেয়া যদি ফার্স্ট হতে পারে, তুই কেন পারবি না?’ ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। মেয়েটি মায়ের রোষানলে পুড়তে পুড়তে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই তার সেসময় শ্রেয়ার ওপর যথেষ্ট রাগও হচ্ছিল। কিন্তু কী করবে বেচারি! কী করবো কিছুই ঠাহর না করতে পেরে আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখছিলাম। হঠাৎ মেঘের মা কোথা থেকে একটা অ্যাসিডের বোতল নিয়ে তেড়ে এলো মেঘের দিকে। ‘মর তুই, আজকে মেরেই ফেলবো’। বোতল খুলে অ্যাসিড ঢালতে যাবে আচম্বিতে মেঘের বাবা মেঘের হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিলো। বোতল থেকে সেই অ্যাসিড তখন গলগল করে ছড়িয়ে পড়ছে মেঝেময়। সেদিন আমি বুঝে উঠতে পারিনি, আসল অপরাধী কে ছিল? আমি না মেঘ না মেঘের মা নাকি এই সিস্টেম?

মেঘেদের বাড়িতে শেষবার যখন গেছিলাম দেখেছিলাম মেঝেতে সেই অ্যাসিডের দাগ এখনো লেগে আছে। ওই মা যে তার মেয়েকে ভালোবাসতেন না, এমন নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে নিজের হতাশা নিজের ব্যর্থতা আর স্যাডিজম সন্তানের ওপর আরোপ করার বহুপ্রচলিত এক ধারা আছে। কারণ শিশুটি দুর্বল, প্রতিবাদে অক্ষম। পড়ে পড়ে মার খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তার, যদি তার রক্ষকই ভক্ষক হয়ে ওঠে। একটি শিশুর ওপর যৌননিগ্রহ হলে তার হয়ে সবার আগে প্রতিবাদ করেন তার মা। কিন্তু এই মায়েরাই অজস্র ক্ষেত্রে অজস্র উদাহরণে নিজের সন্তানকেই তার যাবতীয় হতাশা অবদমন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রথম অস্ত্র কিংবা সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করেন।

শুধুমাত্র যৌননিগ্রহ ছাড়াও আরো অনেক রকমের নিগ্রহ চলে একটি শিশুর ওপর। যেমন সামান্য কারণে বেদম মারধোর, নিজের ঈর্ষা তাদের মধ্যে ইনজেক্ট করা, সর্বোপরি ঘৃণা করতে শেখানো। এসব মায়েরা অপরাধী। এদের সন্তানেরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়। বড় হয়ে বাইরে থেকে সবল ও প্রতিবাদী ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে চিরকাল ওই মার খাওয়া অসহায় শিশুটিই থাকে।

ক্লাস ফাইভে হঠাৎ এক বন্ধু এসে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, এই, তোর বাবা নাকি তোকে ভালোবাসে না?
কে বললো?
মেঘ।
কলেজে যখন পড়ি তখন শুনতে হলো, কীরে, ক’টা প্রেম হলো? আরো ক’টা করবি রে?
মানে?
না মানে, মেঘ বলছিল...

বিষয়টা কতটা গভীর, তা বুঝতে আরো বেশ কিছুদিন লেগেছিল। মেঘের সাথে আমার দীর্ঘ যোগাযোগ ছিল। আমি তাকে ভালো বন্ধু বলে জানতাম। বিভিন্ন সময়ে আমার কানে নানা কথা ভেসে আসতো, মেয়েটি আমার সম্পর্কে এটা ওটা বলে বেড়ায়। সেসবকে গুরুত্ব দেইনি কারণ বন্ধুত্বে অনেক ভুল ত্রুটিকে অগ্রাহ্য করাটা আমার অভ্যেস। কিন্তু বছরখানেক আগে যখন তার বাড়িতে আমার রীতিমতো যাতায়াত চলছে, যখন সে তার বৈবাহিক জীবনের জটিলতা নিয়ে আমার কাছে প্রায় রেগুলার বেসিসে আইনি পরামর্শ নিচ্ছে, যে সময় আমি তাকে মেন্টাল সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করেছি আমার সাধ্যমতো, তার ফুটফুটে সন্তানের হাসি খেলায় ভরে উঠছে এক একটা সন্ধ্যা, যে বন্ধুর কোনো ক্ষতি আমি চাইনি কোনোদিন, হঠাৎই আমার সম্পর্কে অন্য বন্ধু সার্কেলে তার বলা কিছু কথা আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল।

মেঘ, আরে তোরা জানিস না, শ্রেয়ার চরিত্র খুব খারাপ।
তুই কি করে জানলি?
মেঘ, আরে ও তো সবার সাথেই শোয়।
সবার সাথেই?
মেঘ, হ্যাঁ তো। আরে ওর তো এতগুলো সম্পর্ক ছিল... অমুক... অমুক... অমুক... কারো সাথে দুদিন মিশলো মানেই সেক্স।
ওমা তাই?

সেদিন ওই আশ্চর্য সুস্বাদু রোমহর্ষক কথোপকথনের প্রেক্ষিতে আমার দু’একজন বন্ধু প্রতিবাদ করায় বিশ্বাস করেছিল, আমি কতটা খারাপ বা ভালো না জেনেই, শুধু আমার বন্ধু বলে। কেউ কেউ প্রতিবাদ করবে না সমর্থন করবে বুঝতে না পেরে চুপ করে ছিল। কেউ কেউ হয়তো মনে মনে প্রতিবাদ করলেও মুখে কিছু বলেনি। বাকিরা যারা ‘ওমা তাই’ এর দলে, হোয়াটসঅ্যাপের স্ট্যাটাস বারে তাদের নাম টাইপিং দেখিয়ে আবার হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছিল।

আর আমি? আমি চলে গেছিলাম পঁচিশ বছর আগের সেই দিনটাতে। দেখতে পাচ্ছিলাম একটা আধো আলো আধো অন্ধকার ঘরে ফ্রক পড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আর আমার থেকে হাত পাঁচেক দূরে মেঘ। একটু দূরে দেখতে পেলাম মেঘের মাকে, অ্যাসিডের বোতল হাতে। ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে মেঘ। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম আমার আর মেঘের মাঝখানে সেই অ্যাসিডের দাগ আজও স্পষ্ট হয়ে জেগে আছে।

একটি মানুষ কেমন হবে সেটা তার কৈশোরেই নির্ণয় হয়ে যায়। কে কবি হবে কে প্রেমিক কে নেতা কে ভণ্ড সব ওই সময়ের মধ্যেই স্থির হয়। ঠিক তেমনই শ্রেয়ার প্রতি মেঘের বিদ্বেষ স্থির হয়ে গেছিলো সেদিনই যেদিন তার মা তার আর আমার মাঝখানে অ্যাসিড ছড়িয়ে দিয়েছিল। এভাবেই মহানুভব যেমন আমাদের দেখানো পথে তৈরি হয়, হাজার হাজার ধর্ষক বিদ্বষী আর নিগ্রহকারী, হ্যাঁ এরাও আমাদের দ্বারাই তৈরি হয়, আমাদেরই হাতে।

তারপর এও শুনলাম, নারীবাদের ধ্বজা উড়িয়ে বেড়ানো প্রবল প্রতিবাদী সেই মেঘ নাকি আড়ালে আবডালে দু’দশজনের মাঝখানে অনেককেই `বেশ্যা` বানিয়ে ছাড়ে। কোন ছেলে কোন সময়ে কোন মহিলার ঘরে ঢুকছে, এসব বিষয়েও আগ্রহ রাখে। আমার না হয় স্বভাব চরিত্র খারাপই। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই আমার ওপর আরোপিত এই সব অভিযোগ সত্যি, তাহলে বলি, একজন বেশ্যাও জীবনে কারো ভালো বন্ধু হতে পারে। কিন্তু যে সতী সাবিত্রী সেজে সেই বন্ধুত্বের মর্যাদাটুকুও দিতে অপারগ হয়, অন্যদের সামনে সেই বন্ধুকে নামিয়ে ছোট করে খিল্লি করে আনন্দ পায়, সে বেশ্যারও অধম।

না। আমি নারীবাদী নই। তবে সেক্স ডিসক্রিমিনেশনের বিরুদ্ধে। পৃথিবীতে যে সকল অন্যায় অত্যাচার অবদমন আর নিগ্রহের রাজনীতি চলে তা আসলে একটি দুর্বল মানুষের বিরুদ্ধে একটি সবল মানুষের দ্বারা হয়। তা একটি পুরুষের দ্বারা একটি নারীর ওপরেই হয়, এমনটা নয়। যে নারী নিগৃহীতা হয় তার কোনো না কোনো দুর্বলতা আছে বা ছিল। একই কথা পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একটি সংসারে যদি তিনজন মহিলা থাকে তাহলেও দেখা যাবে, একজন মহিলা বাকি দুজনের ওপর প্রভুত্ব ফলাচ্ছে। আসলে ওই প্রভুত্ব করতে চাওয়াটা হিউম্যান ইনস্টিংক্ট। পৃথিবীতে যত স্যাডিস্ট আছে তার অন্তত অর্ধেক মহিলা। শাশুড়ির দ্বারা বৌমা নির্যাতিতা হচ্ছে এমন দৃষ্টান্ত যেমন আছে, তেমনই অসুস্থ শাশুড়িকে নির্যাতন করে এমন বৌমাও তো আছে। বাচ্চা ছেলেকে উদোম পিটিয়ে গায়ে কালশিটে ফেলে দেয় এমন মাও আছে। আর ধর্ষক? সে কি কেবল পুরুষ? শ্লীলতাহানি? সে কেবল পুরুষ করে? না। যে মহিলা শুধুমাত্র বদনাম করার উদ্দেশ্যে নিজের ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সকে চরিতার্থ করার জন্য আরেকজন মহিলাকে যেকোনো পুরুষের সাথে কাল্পনিক বিছানায় টেনে এনে রসালো গল্প সৃজন করে এবং অন্যদের তা শুনিয়ে যৎপরনাস্তি আনন্দ পায়, ধর্ষক সেও।

আমি তাই সত্যকে খুঁজি। সিস্টেম আমাকে যা বিশ্বাস করাতে চাইবে আমি তাই বিশ্বাস করবো, এমনটা নয়। নিজেকে তাই ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেখি। তুমিও ভাঙো। দেখো, নিজেকে দেখো। আঙুল তোলো নিজের দিকে। সারাক্ষণ যদি অন্যের দিকেই আঙুল তুললে, তাহলে বুঝবে কী করে, কোথায় ভুল হচ্ছে? সামান্য `সরি` শোনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল যে সম্পর্কটা, তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে না পেয়ে সেও একদিন ফিরে যাবে। খুব একা হয়ে পড়বে সেদিন, শুধু নিজের দিকে আঙুল না তোলার ভুলে।

চলবে