অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন

ভ্রম

পাপিয়া জেরীন

প্রকাশিত : অক্টোবর ২১, ২০১৮

কবরস্থানের দেয়ালে হেলান দিয়া সিগারেট টানাটা একটু দৃষ্টিকটু মনে হয়। আশপাশের লোকজনের অবশ্য কোনো আপত্তি দেখতেছি না। সবাই ব্যস্ত বিরানী নিয়া। কবরস্থানের অপজিটে `দরবার-ই-চিশতী উস সাবেরী`। আজকে এইখানে এগারো শরীফ। বিরানীর সাথে একহাতা পরিমান জরদা দেয়া হইতেছে। মুসলিমদের জন্য এই দরবার সংরক্ষিত কীনা, কে জানে। দরবারের খাদেম একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা। তার কোমর অস্বাভাবিক বড়, দেখলে মনে হয় এই কোমর নিয়া চলতে অসুবিধা। কোমরের মতো তার নাকও চওড়া, নাকে বিশাল আকৃতির নাকফুল। খুবই সাধারণ একটা সুতি কাপড় পরা সে, কিন্তু অসম্ভব সেক্সি। সেক্সি ছাড়া আর কী বলা যায়! সেক্সি বলাটা মনে হয় অশোভন, মায়ের বয়সী একজন মানুষ। তিমির চোখ ফিরায়ে রাখে, পাশের টং দোকানে যাওয়া যায়। কিন্তু এইখানের চা খুব জঘন্য। এর আগেও বাধ্য হয়ে ওই বিস্বাদ চা খাওয়া লাগছে।

দরবারের মহিলা একবার হাত ইশারা করলো, এখন আগায়ে আসতেছে, বাবা, ভিতরে আসেন। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে যান। মনোবাসনা পূর্ণ হবে। মিলাদের নেওয়াজ আছে, আসেন।
কিন্তু, আমি তো হিন্দু।
তাতে কী? এইখানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান সবই আসে। আপনি সিগারেটটা ফেলে আসেন।

ভেতরে যারা বসে খাওয়া-দাওয়া করতেছে, বেশিরভাগ শিশু। মহিলা নিজ হাতে খাবার নিয়ে আসছে। ম্যালামাইনের প্লেট, সাইডে একটু ফাটা। তিমির খাওয়া বন্ধ করে হাত গুটায়ে বসে থাকে। মায়ের নিষেধ আছে, ভাঙা কিছুতে যাতে না খায়। ‘কী বাবা, শুরু করেন। এইটা খাশির বিরানী। জর্দাটা আমার হাতে করা। এর স্পেশালিটি হইলো, কমলার খোসা কুঁচি করে দেয়া আছে।’
আসলে সমস্যা সেইটা না, আমি গরুও খাই। দেখেন প্লেটটা ফাটা।
মহিলা ভেতরে গেল, অস্বাভিক চোখে পড়ার মতো কোমর। নিগ্রো মেয়েদের মধ্যে এইরকম দেখা যায়। তার শরীরের উপরের দিকটা কালো ওড়না দিয়া ঢাকা, কোনোভাবেই কোনো কিছু আান্দাজ করার উপায় নাই। নিজের চিন্তার ধরণে নিজেরই অস্বস্তি লাগতেছে। কী ভাবতেছে, আর কী দেখতেছে সে! লগ্নর সাথে প্রায় দেড় বছরের প্রেম তার। লগ্নরে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা তো দূরের বিষয়, চোখ তুলে দেখতেও কেমন অস্বস্তি লাগে তিমিরের। আজকে তার হইছে কী! এই সিগারেটে কোনো ঝামেলা নাইতো? মায়ের বয়সী একটা মহিলা, ছিহ্! তিমির বিরক্তি নিয়া গেট দিয়া বের হয়, লগ্নদের বাড়ির দিকে যাওয়া যাবে না। আজকে আশির্বাদ। এই গলিতে দরবারের সীমানা পার হইলেই পুকুর, তারপর লগ্নদের বাড়ি। দিদি-জামাইবাবুসহ দশজন গেছে লগ্নরে আশির্বাদ করতে। দিদি বারবার বলতেছিল, আর কোনো জায়গা পাইলি না। রাস্তার দুইপাশে কবরস্থান, গলির মোড়েই মাজার।

পনেরো বৈশাখ বিয়ের তারিখ। আশির্বাদের পর দ্বিতীয়বার তিমির এই বাসায়। দিদি বারবার বলছে বিয়ের আগে এইখানে না আসতে। কিন্তু কিছু করার নাই, লগ্নর সাথে দেখা করা জরুরি। লগ্নদের বাড়িটা দোতালা। সামনের উঠানে একটা বড়ই গাছ প্রায় দোতালা পর্যন্ত লম্বা। বড়ই গাছটা ঝুমকো লতায় ঝাপড়ানো, ফাঁকে ফাঁকে বেগুনি ফুল। এই ফুলটা তিমিরদের বাড়িতে ছিল, বাবা কয়েকদিন পরপর গাছটা ছাঁটতো আর `আগাছা আগাছা` চিৎকার করতো। মা পূজার জন্য শিউলি নিত, জবা নিত, কিন্তু এই ঝুমকো লতা ফুলে হাত দিত না। এই ফুলে কি পূজা দেয় না, নাকি!

তিমির লগ্নদের সিঁড়ির দিকে আগায়, দিনের বেলাতেও এই সিঁড়িতে কোনো আলো পড়ে না। আজকেও মেয়েটা দাঁড়ানো ওইখানে, এখন নেমে আসতেছে। খুব বেশি হইলে বারো থেকে তেরো বছর বয়স। আজকেও মিষ্টি করে হাসলো। বাচ্চা একটা মেয়ে, কিন্তু তার বুক বয়সের তুলনায় বেশি বড়। তিমিরের মনটা খারাপ হয়, নিজের উপর রাগ লাগতে থাকে। এই বাড়ির কলিংবেল কাজ করে না মনে হয়। কল দেয়ার পর বেণুর মা দরজা খুলে দিছে।

আপনার দিদি কই?
দিদি চান করতেছে। ওখান থেকেই বললো যে। আপনি বসেন, নতুন জামাইবাবু।
বসার ঘরে ঠাকুরের ছবির পাশেই লতা মঙ্গেশকারের একটা দুই বেনিঅলা ছবি। ভিতরের দরজার উপরে উত্তম কুমারের একটা ছবি। তিমিরের কেন জানি হাসি পায়। এইসব কার কাজ হইতে পারে, মনে হয় শ্বশুর মশাইয়ের। ‘হা করে উত্তম কুমারের দিকে তাকায় আছো কেন? ওর মতো হতে চাও?’
হা হা... তুমি শাড়ি পরছো? বাহ্ সুন্দর লাগতেছে তো!
হু সুন্দর লাগে। এই নেও, এইটা মান্তাশার মাপ। এইরকম ডিজাইন। হুবহু একইরকম হইতে হবে।
এইটা আমার ঠাকুমার, এইটা স্মৃতি হিশেবে রাখা। হুবহু এমন হবে, বুঝলা?
বুঝলাম। চলো তুমিও সঙ্গে চলো। রেডিই তো আছো। সুন্দর লাগতেছে।
লগ্ন বেণুর মারে বুঝায়ে দিয়া তিমিরের সাথে নামতে থাকে। এক ফাঁকে সে তিমিরের গলায় চুমু খায়। এদিক-ওদিক তাকায়ে তিমিরও লম্বা চুমু খায় ওরে। ‘আচ্ছা, সিঁড়িতে উঠতে গিয়া আজকেও ওই মেয়েটারে দেখলাম। তোমার কাজিন নাকি?’
কী বলো! এখনও কেউ আসে নাই ওরা। সামনের সপ্তাহ থেকে আসবে দেখবা। কারে দেখছো এইখানে?
নিচের ভাড়াটিয়ার কেউ আছে? তেরো চোদ্দ বয়স।
তিমির, আমাদের ভাড়াটিয়ার একটাই বাচ্চা, ছেলে বাচ্চা। বয়স তিন বছর।

রাত সাড়ে তিনটা বাজে, তিমির হুরমুড়ায়ে খাট থেকে নামে। এইটা কেমন স্বপ্ন! স্বপ্নে সিঁড়ির সেই মেয়েটা তিমিরের বিছানায় শোয়া, মেয়েটার চামড়ার ভিতর থেকে কেমন কমলা রঙের ফুল ফুটতেছে। প্রথমে শরীরে ফুসকুড়ির মতো উঠতেছে সেইটা ছড়ায়ে ফুলের মতো হয়ে যাইতেছে। তিমিরের মাথায় অসহ্য চিনচিন ব্যথা বাড়তে থাকে। অফিস থেকে আট দিনের ছুটি পাইছে তিমির। নিজের বিয়ের সবকিছুই তার নিজেই দেখতে হইতেছে। তারপরও গত চার দিনের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই তিমির লগ্নদের বাসায় গেছে, এর মধ্যে তিনবার এই মেয়েটার সাথে দেখা হইছে। শেষ দিন ওর নাম জিজ্ঞেস করছে, মেয়েটা জবাব দেয় নাই, উল্টা গম্ভীরমুখে তাকায়ে ছিল। পরে মনে হইতে থাকে এইসব বাচ্চা মেয়ে নিয়া কম ঘাটাঘাটি করাই ভালো, শেষে মোলেস্টেশনের মতো কোনো ঝামেলায় পড়া লাগবে। দুইদিন পর বিয়ে তার।

লগ্নর বাসায় আত্মীয় স্বজন আসা শুরু হইছে, ওদের বাসায় গেলে লগ্নরে ফ্রি পাওয়া কঠিন। তিমিরের একরকম অপরাধবোধ হইতে থাকে। তিমির জানে যে, লগ্নরে না, সিঁড়ির মেয়েটারে দেখার জন্যই সে যায় ইদানীং। আশ্চর্য বিষয়, সিঁড়িতেই প্রতিবার দেখা হয়, অন্য কোথাও না।

ঠাকুমার মান্তাশার যে ডিজাইন আছে, অষ্টধাতু দিয়া এত সূক্ষ্ম কাজ সম্ভব না। তারপরও কাছাকাছি কিছু একটা হইছে, ছিলা করতে আরো একদিন সময় লাগবে। এই কথা লগ্নরে বললে মাথার চুল একটাও অবশিষ্ট থাকবে না। টেনশনে মাথা টপ টপ করতেছে। ঠাকুমার মান্তাশা পকেটে নিয়া বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ায়ে থাকার কোনো মানে নাই। রাস্তা পার হইলেই দরবার। তিমির আগায়ে যায়। দরবারের দেয়ালে সবুজ রং মারা হইতেছে, ভিতরে পুরাই সুনসান। গেইট দিয়া ঢুকলেই সাদা টাইলসে বাঁধাই করা দুইটা কবর, কবর দুইটার ঠিক মাঝখানে একটা কামিনী ফুলগাছ। উঠানে আরো ফুলগাছ, সবগুলাই সাদা ফুলের। কাঁঠাল গাছ, আম গাছ, সফেদা গাছ আরো কয়েকটা অচেনা গাছ দেখা যাইতেছে। এত গাছ থাকার পরেও দরবারের ভিতরটা অসহ্য গরম। বারান্দায় ছোটো একটা পাটিতে বৃদ্ধলোক বসা। তার দাড়ি-মোছে মেন্দি দেয়া। চাইনিজদে মতো সরু হয়ে নিচে অনেক দূর ঝুলতেছে। চোখ দুইটাতে আবার ছানি, অর্ধেকটা চোখের মণি নীল বাকি অর্ধেকটা হলুদ। লোকটা জিকির করতেছে অদ্ভুত সুরে। ভিতর থেকে একজন শক্তপোক্ত মানুষ হাতপাখা হাতে নিয়া দাঁড়াইলো, তার মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ।

বাবা, আমাকে বলেন। আমি এই দরবারের খাদেম।
না মানে, গত বৃহস্পতিবার আপনাদের অনুষ্ঠান ছিল। আমি আসছিলাম। এইখানে একজন মহিলা খাদেম ছিলেন, উনি কই?
বাবা, এই দরবারে কোনো মহিলা খাদেম কেন, অস্থায়ী কোনো মহিলা সাহায্যকারীও নাই। কোথাও ভুল হইতেছে আপনার।
উনি বলছিলেন কমলার খোসা দিয়া নিজ হাতে জর্দা বানাইছেন। আমাকে খাইতে দিছিলেন প্লেটে।
কথা ঠিক আছে, আমাদের এইখানে একটা স্পেশাল জর্দা হয়। হ হ!

তিমিরের নিজের উপর একটু বিরক্তি আসে । কেন এত কথা বলতেছে সে! ওই মহিলারে দিয়া কাম কী! বরং লগ্নদের বাসার দিকে যাওয়াই ভালো। মুখে বসন্তের দাগওয়ালা লোকটা মাথা নাড়তেছে।

বাবা, সেই জর্দা রান্ধনের নিয়ম জানতে চান? অনেকেই আসে আমার কাছে শিখতে। আমিই এইটা রান্ধি, বুঝলেন? কিন্তু কমলার খোসা দিয়া তো রান্ধি না, বাবা...

লগ্নর কল। নিশ্চয়ই পার্লার থেকে ব্যাক করছে।
কই তুমি?
তোমাদের এলাকায়, দরবারে।
দরবারে কী করো তুমি? আমি গলির মোড়ে আছি। বাইরে আসো।
তিমির লগ্নর দিকে তাকায়, নাক ফুইলা ঢোল... তোমার কী হইছে? নাকে কী পরছো!
আরে, পিয়ার্সিং করে এই নাকফুল ঢুকাইতে লাগলো আধা ঘণ্টা। নাকফুলের এই পাথরটা দেখো, এইটার নাম ওপাল। ডিজাইনটা দেখো, আমার দেয়া। বড়ই ফুলের ডিজাইনের মধ্যে পাথরটা সেট করা।
বিয়ের দুইদিন আগে নাক ফুটা করার মানে কী! ব্যথা পাও নাই?
ব্যথার চেয়ে লজ্জা বেশি পাইছি। নাক দিয়ে এক পোয়া সর্দি বের হইছে। নাকফুল পরাইতে গিয়া বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। বলো না, কেমন হইছে ডিজাইন?
লগ্ন, এইটা খুবই গ্রাইম্যা ডিজাইনের নাকফুল। এই দরবারের মহিলা খাদেম এমন একটা নাকফুল পরে।
কী! গ্রাইম্যা?
হু।
এই দরবারে কোনো মহিলা খাদেম আছে? এইখানে সব পুরুষ সেবক।
কে বলছে? আমি নিজে দেখছি।
আরে ধুর। আমার এলাকার দরবার, আমি জানবো না? চলো বাসায়, আজকে বাসা খালি। সব গেছে বারদী। চলো চলো, তোমার খবর আছে।

তিমিরের মাথা ঘুরতেছে, হালকা ব্যথাও করতেছে। সিঁড়িতে পড়ে যায় যায় অবস্থা। লগ্ন হাত ধরে নিয়ে যাইতেছে ওরে। ‘তিমির, কী হইছে বলো তো! নেশাটেশা করতেছো তুমি? উল্টাপাল্টা কথা বলতেছো ইদানীং।’

লগ্ন তালা খুলে ভিতরে নিয়ে যায় তিমিররে সরাসরি বেডরুমে। ওর সামনেই সেলোয়ার চেঞ্জ করে। তারপর কামিজ তুলে দিয়ে বলে, ব্রা`র হুক খুলো।

তিমির শুনতে পায় না লগ্নরে, ওর চোখ ওয়্যারড্রবের উপর একটা ছবির দিকে। তিমির ঝাপায়ে পরে ওই ফটোফ্রেমের উপর। ‘এইটা কে, লগ্ন?’
চিল্লাইতেছো কেন? এইটা আমার ছবি, ক্লাস এইটের। তখন বাবুর দিনাজপুর পোস্টিং। পিছনে আমাদের কলেজিয়েট স্কুল, দেখো। স্কুলজীবনের সেই ছয়টা বছরই আমার সেরা সময়।
এই ছবিতো আগে কখনো দেখাও নাই! তুমি এমন ছিলা দেখতে!
আগে দেখাবো কেমনে? বেডরুমে তো তুমি আসো নাই আগে। এমন ছিলা দেখতে মানে কী? খারাপ?
লগ্ন, আমি বলতে পারবো না, আমার সাথে কী হইতেছে? আমি এই মেয়েটারেই তোমাদের সিঁড়িতে দেখছি কতবার! কতবার স্বপ্নে দেখছি!
আর ইউ সিরিয়াস, কেমনে সম্ভব?

তিমিরের শরীর খুব দুর্বল লাগতেছে। হিটস্ট্রোক হইছে মনে হয়। সে ফ্রেমটা বুকে জড়ায়ে খাটে হেলান দিয়া আছে। লগ্ন তারে চামুচে তুলে জর্দা খাওয়ানোর চেষ্টা করতেছে। বাবু, কী হইছে সোনা! বিয়ের টেনশনে এমন হইতেছে মনে হয়। একচুমুক লেবুর শরবত খাও। এই জর্দাটা মুখে নিয়া দেখো, আমি নিজে বানাইছি তোমার জন্য স্পেশালি। দেখো কমলার ঘ্রাণ পাও? এই জর্দায় কমলার খোসা কুচি করে দিছি আমি...

লগ্ন অনবরত কথা বলে যাইতেছে, তিমিরের কানে কোনো কথাই ঢুকতেছে না। তিমির তাকায়ে আছে ফটোফ্রেমের দিকে... এইটে পড়া লগ্নর ছবি থেকে তার চোখ সরতেছে না।