মাঝি দ্য মাউন্টেইন ম্যান: দলিত শ্রেণির ইতিহাস

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৩, ২০১৮

ছবির ট্রেইলার দেখে তেমন আগ্রহ না জাগলেও নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকির অভিনয়ের প্রতি অসীম ভালোলাগা থেকে দেখব বলে ঠিক করি। দেখতে বসে যা দেখলাম, সত্যিই অভাবনীয়।
প্রথমেই নওয়াজের অভিনয়ের কথা বলতে হবে। অসাধারণ অভিনয় করেছেন তিনি। যৌবন থেকে বৃদ্ধ সব চরিত্র তাকে ভালোভাবেই মানিয়ে গেছে। তার বিপরীতে রাধিকা আপ্তের অভিনয়ও দুর্দান্ত।
২০১৫ সালের ২১ আগস্ট মুক্তি পায় মাঝি ছবিটি। পরিচালক কেতান মেহতা। ছবির মূল চরিত্র দশরথ মাঝিকে সম্মান জানিয়ে ছবিটি ভারতের বিহার রাজ্যে ট্যাক্স ফ্রি করা হয়েছে।
ক্যামেরার কাজ ভালো ছিল। তবে আরও ভালো হতো কাহিনির প্রয়োজনে যদি ১৯৬০ সালের প্রেক্ষাপট ফুটিয়ে তুলতে পারত। ছবির কাহিনি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। ১৯৬০ সালের কোনও এক সময় স্বাধীন ভারতের বিহারে গেহলাউর নামের এক গ্রামে বাস করত দশরথ মাঝি। তার গর্ভবতী স্ত্রী গ্রামের পাহাড় বেয়ে পথ চলতে গিয়ে মারা যায়। তাকে হাসপাতালে নিতে গিয়ে পাহাড়ের দুর্গম পথ বেয়ে চলতে হয় মাঝিকে। পথেই মৃত্যু হয় স্ত্রীর। সেই থেকে দলিত শ্রেণির এ মাঝি বুঝে যায়, গ্রামের মানুষের সকল সুবিধা বঞ্চনার কারণ এই পাহাড়িপথ। পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর জেদ চেপে যায় তার মধ্যে। অনেক পরিশ্রম আর কষ্টের বিনিময়ে আর সমাজের অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে এক সময় সে পাহাড়ের মধ্যে পথ কাটতে সক্ষম হয়। সবাই তাকে পাগল ভাবতে থাকে। পাহাড় কাটা কি সম্ভব? তাও একা!
শুরু থেকে শেষপর্যন্ত এ ছবিতে যা দেখা যায়, তা পুঁজিবাদী সমাজের ভয়ঙ্কর কাহিনি।
দলিত শ্রেণির হিন্দু হওয়াতে দশরথ মাঝি আর তার গোত্রের লোকদের ইচ্ছেমত শুষে নিতে থাকে জমিদার। অচ্ছুৎ প্রথায় চলে ভয়ঙ্কর বঞ্চনা। দলিত শ্রেণির মন্দিরে ঢুকতে মানা। যখন তখন চাবুকের আগায় আর মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। পান থেকে চুন খসলেই শাস্তি। ভারত সরকার অচ্ছুৎ প্রথা বিলোপের পরও যে এরা সুবিধা বঞ্চিতই থাকে, তা বোঝা যায় জমিদার আর তার ছেলের অত্যাচারে।
এর মধ্যে দেখা যায়, জমিদারের অত্যাচারে গ্রাম ছাড়া হওয়া এক যুবক ফিরে আসে নকশালবাদী রূপে। সবার সামনে জমিদারকে ফাঁসি দিয়ে অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটাতে চায় সে। পুলিশের গুলিতে নকশালবাদীরা সহ গ্রামবাসী নিহত হয়। এরপর জমিদারের ছেলে হয় গ্রামের মুখ্য। সে মাঝিকে আশ্বাস দ্যায় যে, পাহাড় কেটে রাস্তা হবে। এরপর সরকারি ভূমি অফিসে তাকে নিয়ে গিয়ে টিপ সই নেয়। আর সেই রাস্তা বানানোর সাহায্যের ২৫ লাখ টাকা সে হাতিয়ে নেয়। যুগ যুগ ধরে শাসক কিভাবে শোষণ করেছে তার উজ্জ্বল দৃস্টান্ত যেন এ ছবির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। মাঝি পরবরর্তী সময়ে এক সাংবাদিকের কাছ থেকে জানতে পারে এ প্রতারণার বিষয়টি। দিল্লি যাওয়ার ট্রেন থেকে টিকিট না থাকার দায়ে মাঝিকে যখন ধাক্কা দিয়ে ফেলা হয়, তখন যেন আমাদের গণতন্ত্র আমাদের চোখেই তামাশা ঠেকে! ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তার একটা ছবি নিয়ে নিরক্ষর মাঝি দিল্লি পৌঁছায় পায়ে হেঁটে। ছবিটি সংবাদপত্রে ছেপেছিল তার সেই পরিচিত সাংবাদিক। দিল্লি যায় মাঝি অভিযোগ জানাতে আর পাহাড় কেটে যেন রাস্তা হয় সেই প্রার্থনা জানাতে। তখন এক পুলিশ অফিসার সেই ছবি ছিড়ে মাঝির মুখে ছুঁড়ে দিয়ে হুমকি দেয়, জেলে ঢুকিয়ে দেব।
ফিরে এসে ক্লান্ত দশরথ মাঝি ভাবে, এ জীবনে তার আর স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে আর গ্রামবাসীর জন্য মঙ্গল করার এ কাজ আর শেষ হবে না। কিন্তু পরদিন আবার সে পুরো উদ্যমে কাজে লাগে। এইবার হাত লাগায় গ্রামবাসীও। আর তখন তাকে পাহাড়চোর আর ভূমিদস্যু আখ্যা দিয়ে জেলে ঢোকায় গ্রামের মুখ্য জমিদারের ছেলে। এটাই সবচে ট্র্যাজিক পার্ট! চারপাশের সমাজের দিকে তাকান, আমাদের একদল স্বপ্নবাজ যুবককে ছেলেধরা আখ্যা দিয়ে জেলে পুরে দিল শাসক শ্রেণি! পরে জনতার চাপে দশরথ মাঝিকে ছেড়ে দেয় পুলিশ ।
শেষে দেখা যায়, কাজ শুরুর ৫২ বছর পর, কাজ শেষের ৩০ বছর পর, আর তার মৃত্যুর ৪ বছর পর অবশেষে সরকার বিহারের সেই গেহলাউর গ্রামে পাহাড়ের মধ্যে একটি পাকা রাস্তা নির্মাণ করে ২০১১ সালে। যার নাম দশরথ রোড ।
দশরথ মাঝির ইন্টারভিউ চাইলে সে সাংবাদিককে বলে, আপনি নিজেই একটা পত্রিকা খুলে ফেলুন না!
সাংবাদিক হেসে দিয়ে বলে, এতই সোজা নাকি!
মাঝি বলে, পাহাড় ভাঙার চেয়ে কঠিন নাকি? হা হা হা
পাঠক, জগতে কোনও কাজই অসম্ভব নয়। এজন্য দরকার শুধু একাগ্রতা আর সততা।