‘মানুষের জয় হবেই’

প্রকাশিত : মে ১০, ২০১৮

গতরাত সাড়ে ৯টার দিকে নিজবাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সুসাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। আমরা হারালাম এক শিক্ষককে, একটি মহীরুহকে। তার প্রয়াণে আমরা শোকাহত। তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের নেয়া একটি সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে দেয়া হলো। সাক্ষাৎকারটি নোমান নেন ২০১১ সালে।

স্বকৃত নোমান: আপনি বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বললেন। অতীতের অভিজ্ঞতায় বর্তমান বাঙালি সম্পর্কে আপনার কী দৃষ্টিভঙ্গি?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: বাঙালি জাতিসত্তা এখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মানুষের উপর বিশ্বাস হারাই না। আমি মনে করি, মানুষের জয় হবেই। আমরা মানুষ, আমরা হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত বাঙালি। আমাদের দাবিয়ে রাখবে কে? জয় আমাদের হবেই। এই আশা আমি রাখি বাঙালির উপর।

স্বকৃত নোমান: বাঙালির যে হাজার বছরের সংস্কৃতি, সেটা আগ্রাসী সংস্কৃতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা হাজার বছরের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি ধরে রাখছি না, রাখতে পারছি না। বাঙালি সংস্কৃতিকে আমাদের ধরে রাখার বা চর্চা করার দরকার আছে কিনা? একটা জাতির জন্য সংস্কৃতি আসলে কতটা জরুরি?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: ব্যাপারটাকে আমি সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখি না। সময়ের সঙ্গে মানুষ পুষ্ট হয়। বিশ্ব আর্থ-রাজনীতির কারণে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। গ্লোবালাইজেশনটা হতে বাধ্য। আগে মনে হতো, সাত সাগর আর তের নদীর পর লন্ডন। এখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে লন্ডন যাওয়া-আসা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা গান ছিল, ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না...।’ তার মানে জানালা খুলে দিতে হবে। জানালা খুলে না দিলে তুমি অবরুদ্ধ হয়ে মারা যাবে। আমি একবার চায়নার এক শহরে গেলাম। সমুদ্র পাড়ের শহর। রেস্টুরেন্টে বসে আমরা খাচ্ছি। সমুদ্র তীরে দেখছি, বেশ কিছু মেয়ে সুইমিং পোশাক পরে বালুচরের উপর শুয়ে আছে। আমার সঙ্গে ওই দেশের যে প্রফেসর ছিল তাকে আমি বললাম, আমাদের প্রাচ্যদেশীয় মূল্যবোধে তোমার এই দৃশ্য কেমন মনে হয়? এরা তো তোমারও কন্যা হতে পারত। তখন সে আমাকে বলল, আমরা জানালা খুলে দিয়েছি। সুতরাং বাইরে থেকে বিশুদ্ধ বায়ুর জন্য আমরাও জানালা খুলে দিয়েছি। বিশুদ্ধ বায়ুর সঙ্গে খড়কুটো আসবে। সেগুলোকে বাছাই করে আমরা বাদ দিয়ে দেব। আমরা আজকে যে প্যান্ট পরছি, একসময় তো এটা বাঙালির ছিল না। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে তো আমাদের ড্রইংরুমই ছিল না। এখন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারেও ড্রইংরুম আছে, ডাইনিং টেবিল আছে। তার মানে, বাইরের বাতাস আসবে জানালা খুলে দিলে। তোমাকেই গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। সুতরাং আদি-অকৃত্রিম সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়। সংস্কার সাধিত হয় বলেই সংস্কৃতি বলা হয়। আমার বাঙালিত্বকে বজায় রেখে আমি পরিপুষ্ট হব। আমি বিদেশের যা কিছু ভালো তা গ্রহণ করব, যা কিছু খারাপ তা বর্জন করব। বেগম রোকেয়া নারীমুক্তি আন্দোলন করেছিলেন। বেগম রোকেয়ার আমল থেকেই নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে। এখন নারীরা অনেক এগিয়েছে। নারীরা এখন ভালো সাংবাদিকতা করছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশে গিয়েও মেয়েরা রিপোর্টিং করছে। কিন্তু বেগম রোকেয়ার সময় কি এই অবস্থা ছিল? বেগম রোকেয়ার সময় মেয়েদের বলা হতো ‘অবরোধবাসিনী’। বেগম রোকেয়ার সময় নারীদের যে সংস্কৃতি ছিল, সেই সংস্কৃতিকে কি আমরা এখনো বজায় রেখেছি? না, আমরা রাখিনি। আমাদের নারীরা পরিবর্তিত হয়েছে, তাদের সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হবে।

স্বকৃত নোমান: আওয়ামী লীগ ইসলামকেই রাষ্ট্রধর্ম রাখল। ক্ষমতায় এসে পরিবর্তন করল না। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে তো এ দলটির কাছ থেকে জনগণ এটা প্রত্যাশা করেনি...।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: আমি সরকারের এই কাজটিকে সমর্থন করি না। দেশের শতকরা আশি ভাগ লোক মুসলমান, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষের আর্গুমেন্ট এটাই হবে যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করতে অসুবিধা কোথায়? কিন্তু তুরস্কে কী হয়েছে? কামাল পাশাকে নিয়ে তো আমরা খুব গর্ব করি। রাস্তার নামই কামাল আতাতুর্ক রাখলাম। তিনি কী করলেন? কামাল আতাতুর্ক খলিফাকেই তাড়িয়ে দিলেন। ইসলামের খলিফাকেই দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলেন। দেশবাসী কামাল পাশার নাম দিলেন ‘আতাতুর্ক’, মানে তুরস্কের পিতা। তিনি এসে আরবি হরফকে তাড়ালেন। তুর্কি হরফে কোরআন শরিফ লেখালেন, আজান দেয়ালেন তুর্কি ভাষায়। সেক্যুলার সংবিধান বিশ শতকে কামাল পাশা করেছেন। যে দেশে শতকরা নব্বইভাগ লোক মুসলমান, সেই দেশেরই তিনি এই অসাম্প্রদায়িক সংবিধানটা করলেন। অত আগে যদি তিনি পারেন, তবে ২০১১ সালে এসে আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার কোনো দরকার আছে? ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রধর্ম কি হিন্দুত্ব? গ্রেট ব্রিটেনে বা আমেরিকাতে রাষ্ট্রধর্ম কি খ্রিস্টিয়ানিটি? কোথাও নেই। আমাদের এখানে থাকবে কেন? সরকারের এই কাজটিকে আমি কিছুতেই সমর্থন করি না।

স্বকৃত নোমান: মৃত্যু ভয় কি আপনাকে তাড়িত করে?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: না, তাড়িত করে না। হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমার মৃত্যু হলে আমার স্ত্রীর কী অবস্থা হবে? ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি চিন্তা করি না। মৃত্যুপর্যন্ত যাতে ভালোভাবে কাজ করে যেতে পারি, সেটাই চাওয়া।