মাসুদ খানের ৪ কবিতা

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯

যোগিনী ও মাছরাঙা পাখি

যোগিনী, কী যোগ করলে তবে এ-সন্ন্যাসে,
এই অবিবাহে, এই অসংসারে?
নিরঙ্কুশ এ ঘন সংশয়ে?

আর ওহে রঙ্গনের ঝোপে বসে-থাকা মীনরঙ্গ পাখি, তোকেও তো বলি,
এ ঊর্মিকুমার ঘাটে প্রতিদিন আসে কত
রূপনিধি রজকিনী বউমাছ বসন্তকুমারী—
প্রগলভা রঙিলা আর বিলোল ব্যাপিকা কত চঞ্চলা শঙ্খিনী।

এতসব ছেড়ে কেন যে জ্বালাস শুধু তাকে,
শান্তশুভ্রা ওই যোগিনীকে!

প্রেম

এক.
সেই এক উদ্ভ্রান্ত বিদ্যুৎ
যা মানুষকে মুহূর্তে পরিণত করে পরাক্রান্ত চুম্বকে।

আর ওই সেই চুম্বক যা পুনরায় বানায় বিদ্যুৎ,
আর তা চমকিয়ে চলে মানুষে মানুষীতে।

দুই.
কাঠ আর লোহা— দুজনেরই বসবাস ডাঙায়।
একদিন প্রেমে পড়ল তারা পরস্পরের
তারপর ঠিক করল, থাকবে না আর এই খটখটে নীরস ডাঙায়।
লোহা বলে— প্রিয়, আমি তো ভাসতে জানি না
কাঠ বলে— আমি আছি-না!
জড়াজড়ি করে ভেসে বেড়াব দুজনে, যুগলমিথুনে,
বন্দর থেকে বন্দরে, দেশ-দেশান্তরে।
ভাসলে ভাসব দুজনে, ডুবলেও ডুবব যুগলে
অগাধ সলিলে, সান্দ্র সহমরণে।

তখনই সম্ভব হয় প্রেমের তুরীয় পর্যায়
যখন প্রেমিক-প্রেমিকা মিলে
তাচ্ছিল্যভরে পুড়িয়ে দিয়ে চলে যায় অনাগত ঘরসংসার
যেদিকে দুচোখ যায়...

রাজহাঁস

চুপে চুপে পাঁকে নেমে হরদম খাও হে পঙ্কজ
পালকে লাগে না তবু কর্দম একটুও!
ডানা ঝেড়ে পাঁক থেকে উঠে সোজা যাও সরোবরে।
জলের উপরিতলে ভাসো
আধো-জাগা আধেক-নীরব নিদ্রাকুসুমের দেশে ভেসে বেড়াও নির্ভার
তোমার ওপর নাই জগতের ভার, ওরে ভীরু
ওরে সুখী ওহে স্বচ্ছ সাঁতারবিলাস
দুধের জলীয়ভাগ ফেলে শুষে নাও দুগ্ধসার
দ্রবণের থেকে দ্রাব্য-দ্রাবক আলাদা করে নিয়ে তবে করো হে আহার।

রে হংস, পরম হংস ওহে
হংসলীলা যেইদিন করো সংবরণ
পরিহাসরূপে দেখা দেয়
জগতের যত ডিগবাজি ডুবসাঁতার, বিবিধ সন্তরণ।

নিঃসঙ্গ

লক্ষ-লক্ষ মাইল উঁচুতে, মহাকাশে,
জনমানববিহীন ভাসমান একটি স্পেস-স্টেশনে পোস্টিং পেয়ে
এসে জয়েন করেছে এক স্টেশনমাস্টার।

একদিন একটি রকেট এসে প্রচুর বোঁচকা-বুঁচকিসহ তাকে নামিয়ে দিয়ে,
ফুয়েল-টুয়েল নিয়ে কোথায় যে চলে গেল কোন আসমানের ওপারে...
সে-ও কতদিন আগে!

মৃত্যুরও অধিক হিম আর নির্জনতা...
মানুষটি একা-একা থাকে, খায়, ঘুমায়— ওজনহীন, নিঃসাড়, নির্ভার...
মাঝে মাঝে নভোপোশাক পরে বাইরে সাঁতার কেটে আসে শূন্যে,
তখন সে বাঁধা থাকে ধাতুরাংতারচিত এক লম্বা লাঙুলে, স্টেশনের মাস্তুলের সঙ্গে।

কাছে-দূরে কোত্থাও কেউ নেই,
কোনো প্রেত-প্রেতিনী, অথবা কোনো যম-যমী, জিন-পরি, ভগবান-ভগবতী,
ফেরেশতা-ইবলিশ কাঁহা কিচ্ছু নেই, কেউই ঘেঁষে না কাছে, যে,
তার সঙ্গে একটু কথা বলবে, কফি খাবে...
এমনকি মানুষটা যে একটু ভয় পাবে, তারও উপায় নেই...
নিজের সঙ্গেই তাই নিজেরই মিথুন ও মৈথুন, খুনসুটি, হাসাহাসি, সাপলুডো খেলা...

কেবল রজনীস্পর্শা, ভীষণবর্ণা এক গন্ধরাজ্ঞী ফুটে থাকে অবাধ, অনন্তরায়...
বহুকাল দূরে...