মিঠুন চাকমা হত্যাকাণ্ড নিয়ে কিছু কথা

আলতাফ পারভেজ

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৫, ২০১৮

মিঠুন চাকমার সন্তান অর্তিক চাকমার জন্মদিন ছিল সেদিন। যে সন্তান জন্মদিনে বাবার খুন হওয়া দেহ ফিরে পায়, তার শোকের সমান কোনও সান্ত্বনাই হতে পারে না। কিন্তু অর্তিকের শোক আজ সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বিদ্যুতগতিতে। এটা এক নতুন সময়। বাংলাদেশকে অবশ্যই কিছু বলছে এই মুহূর্তটা।
কে খুন করেছে মিঠুন চাকমাকে, এ নিয়ে দেশের নাগরিক সমাজে নানামত-নানা অনুমান থাকতে পারে। কিন্তু ফোনালাপে বুঝেছি, খাগড়াছড়ির মানুষ এ নিয়ে তেমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে নেই। যে কোনও জনপদেরই নিজস্ব একটা শ্রবণ-ইন্দ্রিয় থাকে। খুব বেশি ধামাচাপা দেয়া অঞ্চলেরও বোঝাশোনার একটা নিজস্ব লোকজ শক্তি থাকে। খাগড়াছড়িও সেই শক্তির জোরেই বুঝে ফেলে প্রতিপক্ষের অনেক ভাষা। ইশারা-ইঙ্গিতও।
কেন বাঙালির ‘নির্বাচনের বছর’ মিঠুনকে প্রাণ দিতে হলো, এর একটা উত্তর খাগড়াছড়ির মানুষের কাছে এরই মধ্যে হাজির আছে। এ ঘটনায় যদি কেউ মোটাদাগে বিপদে পড়ে থাকে, তো  সে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা কি তা বুঝতে সক্ষম? বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা আদৌ কি এ ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী লাভ-ক্ষতি-দায়-দেনা হিসাব করছেন?
সরাসরি বললে, রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে যা অর্জন করেছিল, মিঠুনের মৃত্যু তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ব্যাপকভাবে। আরাকানের পাশেই পার্বত্য চট্টগ্রাম; তাই  এ খুনের প্রতীকী মূল্য বিপুল। এই খুন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো কোটি কোটি বাংলাদেশির পুরো অর্জনকে কালিমালিপ্ত করেছে।
এ মৃত্যু যে বাংলাদেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি প্রবলভাবে সামনে নিয়ে আসবে, সেটা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার দরকার হয় না। আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে রোহিঙ্গা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য বর্মার নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ যেসব সমাজতাত্ত্বিক যুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের দোহাই দিয়েছে মিঠুনের রক্তে তা অনেকখানি ভিজে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অহরহ অনেক তরুণ খুন হলেও এই খুনটি ওজনে অনেক ভারি। এ ভার বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে বইতে হবে অনেক দিন।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান যে অনেক দুর্বল হয়ে গেল, এ খুনের তাৎক্ষণিক ক্ষতি হলো সেটা।

মিঠুন চাকমার মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য আরেকটি গুরুতর জবাবদিহিতার উপলক্ষও সামনে এনেছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এদেশে জাতিগত উত্তেজনা ও উদযাপনের সময়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির তিন বছর আগে মিঠুনের মৃত্যু বাংলাদেশের সামনে এ মর্মে এক বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল যে, দেশটি আদৌ একাত্তরের সংগ্রাম থেকে কিছু শিখেছে কি না?
কেন একটা দেশে ‘সাতচল্লিশ’-এর বাইশ বছর পরই ‘একাত্তর’ আসে, বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামের বিজয়ের উপসংহার থেকে নিশ্চয়ই তার কিছু খবরাখবর জানে। কিন্তু বাংলাদেশ যদি একাত্তরে পাকিস্তানের পরাজয় ও নিজের বিজয় থেকে কোনওি রাজনৈতিক শিক্ষা সারমর্ম আকারে আত্মস্থ করতো, তাহলে মাত্র কয়েক লাখ চাকমা-মারমা-ত্রিপুরাকে ঘিরে দশকের পর দশক এত নিরাপত্তা খরচ করতে হতো না এদেশকে এবং সেই নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যেই মিঠুনের মতো সুপরিচিত ও মেধাবী এক চাকমা তরুণকে জীবন দিতে হতো না। অর্তিক চাকমাও পিতা হারা হতো না।
তবে এ ঘটনার মূল মামলাটি নিশ্চয়ই এখন আর শুধুই নিরাপত্তা প্রশ্নের চৌহদ্দিতে আটকে নেই। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে জাতিগত বিদ্বেষ, রেষারেষি ও সংঘাতের যে ঢেউ উঠছে তাতে বাংলাদেশ যে কোনও সেইফ জোনে নেই, এইরূপ সেইফ জোনে থাকার শর্তাবলি যে নিজে থেকেই হেলায় হারাচ্ছে সে, সেটাই জানান দিল আপাত প্রান্তিক এক জেলার এ খুনের ঘটনা। যে কারণে এটা শুধুই কোনও প্রান্তিক খুনের ঘটনা নেই আর। এর দায়দেনা দাঁড়াচ্ছে বিস্তর। মিঠুন প্রাণ দিয়ে খাগড়াছড়ির মানুষের রাজনৈতিক অশান্তিকে এক টানে আন্তর্জাতিক মনোজগতে হাজির করেছে। যার রেশ আমরা টের পেতে থাকবো ধীরে ধীরে। নিঃসন্দেহে মিঠুনের মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য একটা বড় আকারের খারাপ বার্তা। আজই আমরা তা বুঝবো না। আস্তে আস্তে বুঝবো। বুঝতেই হবে।
এই মৃত্যু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তহীনতাও প্রকট করছে যে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আদৌ ধরে রাখতে চায় কি না সে। মিঠুন ও তার রাজনৈতিক সহযোগিরা যখন জানপ্রাণ কবুল করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে থাকতে চাইছে তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আসলে কী চাইছে-- সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে এখন।
বস্তুত এ মৃত্যু বাংলাদেশকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে আবারও গভীর তাগিদ দিচ্ছে যে, নেত্রকোনার গারো, রাজশাহীর সান্তাল, শ্রীমঙ্গলের বাগিচা শ্রমিক কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা-মারমা-ত্রিপুরাদের কথা বলা ও শোনার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনও স্বাভাবিক জায়গা থাকবে কি-না। নাকি সেই ভুলগুলোই পুনর্বার ঘটে চলবে, যা অতীতে করা হয়েছিল?