রংবাজ

উপন্যাস ২

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮

ঈদ বাক দু’দিন। চারদিকে সাজ সাজ রব। কিছু কিছু রান্না এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বাবুদের বাসায়। বাবুর মা রান্না করছেন, সাথে আছে কাজের দুটো মেয়ে। বাবুর মা কাজের মেয়ে রোকেয়াকে বললেন, একটু বাড়িঅলীকে বলতো পানিটা ছাড়তে। পানি তো শেষ হয়ে গেছে। রোকেয়া বলল, হ নানি, পানি নাই। ওই বাড়িঅলী খাচ্চর, কথা হুনে না। পানি ছাড়তে চায় না। আমি সকালে দুইবার কইছি, হোনে নাই।
আবার বল।
আইচ্ছা, কই।

রোকেয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে খালি উঠোনটায় এসে দাঁড়ায়। বাসাটা তিনতলা, একতলায় বাবুরা থাকে আর দোতলায় বিহারী বিধবা বাড়িঅলী তার এক ছেলে আর এক বিবাহিত মেয়ে ও তার জামাইসহ থাকে। মুখ এবং ব্যাবহার দুটোই খুব খারাপ বাড়িঅলীর। কথায় কথায় গালাগালি করে। খোট্টা বিহারী বলা যায় মহিলাকে। এই বাড়ির মালিকের তিননম্বর বউ ছিল সে। শোনা যায় যে, বাড়ির মালিককে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিল এই মহিলা এবং সুকৌশলে চাপা দিয়েছিল হত্যাকাণ্ডের বিষয়টা। সেটা ঘটেছিল সত্তর দশকের শেষের দিকে। তারপরই এই বাড়ির মালিক হয়ে যায় এই মহিলা। ওই লোকের বাকি দুই বউ থাকতো পশ্চিম পাকিস্তানেক, তাই তারা আর আসতে পারেনি মালিকানা দাবি করতে। এই মহিলা কোনোভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে টিকে গিয়ে বাঙালিদের সাথে সখ্য তৈরি করে বেচে যায় এবং বেশ ভালোভাবেই নিজের প্রতিপত্তির বিস্তার করে ফেলে।

ছেলে পড়াশোনা করে না, বাউণ্ডুলে। মেয়ে শাফিনা, উর্দুতে কথা বলে, আধো আধো বাংলাও বলতে পারে। মেয়ের জামাই কিসমত, চানপুরের লোক, সাদাসিধা গাধা কিন্তু একটু লোভি টাইপের। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর এই বিহারী পরিবারটাকে বাঁচানোর জন্যে এবং রাজকুমারীসহ অর্ধেক রাজ্য পাওয়ার আশায় শাফিনাকে বিয়ে করে ফেলে কিছুটা জোরপূর্বক। ১৯৭২ সনে ওদের নাজুক অবস্থার কারণে বাধ্য হয়েই কিসমতের সাথে বিয়ে করতে হয় শাফিনাকে। শাফিনা অদ্ভুত সুন্দরী, উন্নতবক্ষা, যৌবনবতী একটা মেয়ে, গায়ের উজ্জ্বল বর্ণ, মাথার দিঘল কালো চুল আর গোলাপি ওষ্ঠ যেকোনো পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে সেকেন্ডের মধ্যে। ওকে দেখতে এক মুহূর্তের জন্যেও বিবাহিত মনে হয় না, নেশা নেশা চোখ, পাগল করা দৃষ্টি পাগল করেছে অনেক পুরুষকেই।

একতলায় বাবুরা ছাড়াও আরও দুঘর ভাড়াটিয়া আছে। তিনতলা পুরোটা নিয়ে থাকে দুই ভাই, রফিক ও শফিক। রফিক বড়। দুজনার ব্যবসা আছে নবাবপুর রোডে, হার্ডওয়্যার শপ। দুজনই অবিবাহিত। ছোট ভাইটা খুবই হ্যান্ডসাম, রীতিমতো বডিবিল্ডিং করে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দোকান, তারপরই বাসা। বাসায় এসেই পুষ্টিকর খাদ্য এবং ব্যায়ামের মহড়া, এই হলো জীবন। চমৎকার ছেলে, যেকেউ মেয়ে দিতে একবারও চিন্তা করবে না।

রোকেয়া উঠোনে দাঁড়িয়ে দোতলার জানালার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে, ওয় শাফিনা, শাফিনা... পানিটা ছাড়ো, শেষ হইয়া গেছে পানি।
বাড়িঅলীর গলা শোনা গেল, এত বারবার পানি ছাড়া যাইবে না।
রোকেয়া: কী কন! আইজকাতো শুধু একবার পানি ছাড়ছেন, একবারে কি হয়?
বাড়িঅলী: না হইলে না হইবো, লেকিন পানি আমি ছাড়বো না আইজ আর।
রোকেয়া: কন কি খালাম্মা, আইজকা সব রান্না করতে হইবো, পানি না ছাড়লে চলবো ক্যামনে?
বাড়িঅলী: ওয় বান্দির বাচ্চা, একঠো লাগাকে দুঙ্গি তাব সামাঝ আয়েগা।
রোকেয়া: উর্দুতে কথা কন কেন? আমিতো উর্দু বুঝি না।
বাড়িঅলী: আবে ভোসরিকা জানা, তেরি গাড়মে লাগা দুঙ্গি এক লাথি, তাব সামাঝ আয়েগা।

রোকেয়া বাবুর মাকে এসে বলে, দেখেন তো নানি কি রকম গালাগালি করতাছে বাড়িঅলী। বাবুর মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে শাফিনার মাকে ডাকে, এই শাফিনার মা, শাফিনার মা... শুনে যাও।
শাফিনার মা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কেয়া?
তুমি রোকেয়াকে গালি দিয়েছো কেন?
বাড়িঅলী: তো কেয়া দুঙ্গি? তোমার কাজের মেয়ে আমার লগে বেয়াদবি করছে, আমি গালি দিছি, হো গিয়া বারাবার, আব তুম কন লাটসাহেব হো জিসকি জাওয়াব দেনা পাড়েগা মুঝকো? তুঝে পানি না মিলা তো ঘার ছোড় দো, কওন তুঝকো রেহনে বোলা। ম্যায়তো বোল দিয়া তুঝকো মায় পানি নেই দুঙ্গি, আব তুম ইধার রাও আওর যাও।
বাবুর মা: এটা কেমন কথা পানি দিবা না?? তুমি তো তাইলে ইচ্ছা করেই পানি দিচ্ছো না। খামোখা ওয়াসারে দোষ দাও কেন যে পানি সাপ্লাই বন্ধ?
এর মধ্যে বাড়িওয়ালীর মেয়ের জামাই কিসমত এসে জানালায় দাঁড়িয়ে বাবুর মাকে লক্ষ্য করে বলে ওঠে, ওয় বুড়ি, তোরা বাইর হইবি কবে এই বাসা থেইকা? কি মনে করছস, বিহারী মালিক দেইখা বাড়ি দখল করবি?
বাবুর মা: কিসমত, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এভাবে তুই তুকারি করে কথা বলছো কেন? তুমিতো এতো অভদ্র ছিলে না!
কিসমত: বহুত ভদ্রতা দেখাইছি তোগো লগে, আর না। তোরা আগামী মাসের মইদ্যে বাসা থেইকা না বাইরাইলে ঘাড় ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দিমু।
বাবুর মা: তুমি জানো বাবু তোমার এই মুখ খারাপের কথা শুনলে কি করবে? তোমাকে ও ছিড়ে ফেলবে।
কিসমত: বল গিয়া তোর রংবাজ পোলারে যে আমি গাইল্লাইছি তোরে, শুওরের বাচ্চা।
বাবুর মা: অসভ্য, ইতর, ছোটলোক, কমিন, তোরে আজকে মার খাওয়াবো বাবুকে দিয়ে, দাঁড়া।
কিসমত: ক গিয়া তোর বাবুরে, কি করতে পারে দেখুম।

ঝগড়া ধীরে ধীরে প্রচণ্ড বেড়ে যায়, যার যা মুখে আসে, বলতে থাকে দুপক্ষ। একপর্যায়ে বাবুর মা গজগজ করতে করতে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। কিসমত চলে যায় জানালা থেকে। থেমে যায় ঝগড়া তখনকার জন্য।

চলবে