শস্য ও পশুপালনের স্মৃতি

মৃদুল মাহবুব

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৬, ২০১৯

বিজয় আহমেদ আমার বন্ধু। বহুত পুরানা বন্ধু। ফলে, যেকোনো বিষয়ে আমাদের দ্বিমত, মারামারি, কামড়াকামড়ি বেশি। কোনো কোনো দিন হাতাহাতি হতে বাদ থেকেছে। হবে একদিন। সেদিন আমারা ফোলা, আচড়ানো মুখের সেলফি দেব। ফলে, এমন বন্ধুর কবিতার বই নিয়ে লিখতে গেলে নিন্দুকরা বন্ধুকীর্তন নামে এগুলো খারিজ করতে চায়। নিন্দা করার অধিকার তারা রাখতেই পারে, যেহেতু আমরা এ সমস্ত করে থাকি সুযোগ সুবিধা পেলেই। আমি বিজয় আহমেদের চতুর্থ প্রকাশিতব্য ‘শস্য ও পশুপালনের স্মৃতি’ কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পড়েছিলাম অক্টোবরে ত্রিশ তারিখ। পাণ্ডুলিপি পড়ার পর বিজয়কে ইনবক্সে বহু কিছু না ভেবেই যা যা লিখেছিলাম তার একটা সারসংক্ষেপ দিলাম এখানে। তবে শিল্প সাহিত্য নিয়ে আমাদের মধ্যে পিঠ চাপড়া চাপড়ি নাই, এটুকু বলে নিয়েই কথাগুলো আপনাদের জানাতে চাই। বাংলা কবিতার একটা গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হতে চলেছে। আপনারা ‘শস্য ও পশুপালনের স্মৃতি’ পাঠ করে আনন্দিত হবেন। কবিতা নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তার উদাহরণগুলো উপলব্ধি করবেন।

সকা‌লে নাগ‌রিক বে‌শে অফিসে যে‌তে যেতে ‘শস্য ও পশুপালনের স্মৃতি’ ক‌বিতাগু‌লোর উপর চোখ বুলালাম। নাগ‌রিক বে‌শের কথা বললাম কেননা আমি‌তো মূলত মফস্বলের ছে‌লে। নাগরিক বেশটা আমার রূপান্তর মূলত, ভেতরে এক মফস্বলের বোকমি রয়ে গিয়েছে এখনো। বাটার নানের ভেতর যেমন মাখনটা থাকে তেমন আমার ভেতরও মফস্বলতার নরম নরম দৃশ্য আছে। নাগরিকতার বাইরের ভূগোল, প্রকৃতি আর জীবনটা আমি পারিবারিকভাবে। আমার দাদা, নানা, মাম, চাচারা উত্তরাঞ্চলের ধানের ক্ষেত থেকে উঠে আসা সরল মানুষ। ফলে, বিজয়ের কবিতার স্পেস বা ভূগোলটা আমার খুব প‌রি‌চিত লাগে। এই মহানগরের অধিকাংশ মানুষই সেই গ্রাম বা মফস্বলের সরলতা থেকেই উঠে আসা মানুষ। ফলে পড়ার পর এই ক‌বিতাগু‌লো নস্টালজিয়া জাগায়। স্মৃ‌তিরা জীবন্ত হয়। প্রকৃ‌তি, ভূগোল, মানুষ আর তার পরিবেশটা‌কে দেখা যায়। এটাই বাংলা‌দে‌শের বৃহৎ ভূ‌গোল এখন পর্যন্ত। কিন্তু আমার মতো মফস্বলিরা ঢাকায় এসে সেই স্পেসটাকে লুকিয়ে রেখেছি বুকসেলফের চিপায়।

বইয়ের পৃষ্ঠায় দেখা নকল ভূগোলের চেরি আর ওক গাছ, ম্যাপললিপ, ট্রামের বিপরীতে বিজয়ের এ নতুন লেখাগুলো ‘দেশে ফেরার খাতা’র মতো। আমি আলাদা গুরুত্ব দিতে চাই এই লেখাগুলোর। আমাদের সময়ের অধিকাংশ কবিতা কবিতা পড়ে লেখা, মস্তিষ্কের পঠন পাঠনের অতি চেষ্ঠায় গড়া, মেকি, সিনথেটিক, গাঢ় উজ্জ্বলতা। কিন্তু বিজয়ের এই নতুন কবিতাগুলো সত্য দৃশ্য ‘শস্য ও পশুপালনের স্মৃতি’ দেখে, উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রকৃত জীবন দেখে লেখা বলে আমার মনে হয়। অনেক বেশি অর্গানিক। এবং মেকি কবিতা থেকে বিজয় ফেরাতে চলেছে বাংলা কবিতা, এর জন্য তাকে স্যালুট। আমাদের জীবনের অনেক ব্যথা ফুল হয়ে ফোটে। এটা সেই বেদনার ফুল। তার পূর্ববর্তী যে ক‌বিতা প‌ড়ে‌ছি তার ম‌ধ্যে মহানগ‌রির ভাষা ও তার বাস্তবতা আছে। আর ‘শস্য ও পশুপালনের স্মৃতি’র ক‌বিতা সে সমস্ত আগের লেখা থেকে ব্যাপক ভিন্ন। জীবন যাপন, প‌রি‌বেশ আমা‌দের ক‌বিতা‌কে যে পরিবর্তন করে তার প্রমাণ এখানে আছে। ভিন্ন কিছু লেখার জন্য ভিন্ন জীবনও লাগে। সেটা বিজয়ের আছে।

এই ধারার কবিতার একটা ছেদ আছে বাংলা ভাষায় এই সময়ে। এই টেস্টর বাংলা ক‌বিতায়। এটা শ‌ক্তিশালী একটা উদাহরণ যে, বাংলা ক‌বিতার হ‌বে সে বিষ‌য়ে আমার মতো নাদান, কম জানা-বোঝা লোক নিশ্চয়তা রাখ‌লো। ‘শস্য ও পশুপালনের স্মৃতি’ এর মঙ্গল হোক।

একুশে বইমেলা ২০১৮