সিদ্ধান্ত দেয়ার চেয়ে বাহাসের দ্বান্দ্বিকতাই গুরুত্বপূর্ণ

কামরুল আহসান

প্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০১৮

আমাদের সংস্কৃতি হচ্ছে ওয়াজ-নসিহতের সংস্কৃতি, কথা আদান-প্রদানের সংস্কৃতি নয়। অর্থাৎ, একজন বলবে বাকিরা হা করে শুনবে, গিলবে, এবং যে-গিলে সে তো আর এটা পুরোপুরি হজম করতে পারে না। সুযোগ পেলে সেও কোথাও গিয়ে উগরায়। কোথায় উগরায়? তার চেয়ে দুর্বল কাউকে যদি কাছে পায়। সবলের সামনে তো আর সে কথা বলবে না। জানে, কথা চালাচালির কোনো সুযোগ নাই। সবল তার কথার উত্তর দেবে না। সবল বলবে, বাধ্য হবে দুর্বল শুনতে, এই হলো আমাদের সংস্কৃতি।

যতটুকু গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতি বুঝলাম, গ্রাম থেকেই একটা জাতির আদি সংস্কৃতির উৎস বের করা সম্ভব, শহর থেকে নয়। শহর আরোপিত, বাইরে থেকে আসা জলে ঘোলাটে। গ্রামে এখনো আদি চিহ্ন কিছু রয়ে গেছে। তা দেখে ধারণা করি, এ রকম রেওয়াজ, মানে কথা না-বলার সংস্কৃতি আগে ছিল না। আগে বরং ছিল বেশ ভাব আদান-প্রদানেরই। আমরাও ছোটবেলায় মুরব্বিদের সাথে কিছু বাহাস করার সুযোগ পেয়েছি।

এ প্রবণতাটা শুরু হইছে বোধহয় নব্বই দশকের পরেই। অর্থাৎ, ওয়াজ যত বাড়লো আমাদের আপামর জনসাধারণের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। ওয়াজ মানে, ওয়াজের মধ্যে আমি রাজনৈতিক বক্তৃতাও আনব এবং স্কুল-কলেজের স্যারদের লেকচারও। আমি যতটুকুই পড়াশোনা করছি, আমার স্কুল-কলেজের স্যারদের কোনোদিন আমাদের সাথে কথা বলতে দেখি নাই। তারা আসতেন, বকবক করে লেকচার দিতেন, চলে যেতেন। আমরা কী বুঝতাম, না বুঝতাম না তার দিকেও তারা তেমন খেয়াল দিতেন না। আমাদের মধ্যে যে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে সেই প্রশ্নও তারা করতেন না।

এটা একটা জাতির দার্শনিক সমস্যা বটেই। আমাদের দেশের লেখক ও বুদ্ধিজীবীরাও এর বাইরে যেতে পারেন নাই। তারা বই লেখেন, সেমিনারে যা খুশি বলে যান, সেখানে কোনো তর্ক-বিতর্ক নেই। মানে বইগুলো প্রকাশ হয়, আমরা পড়ি, ভালো লাগলে লাগে, না লাগলে নাই, সেগুলো নিয়ে আমরা আর কিছু বলি না। বলার জায়গা নাই, সংস্কৃতি নাই। এতে একটা জাতি অনিবার্যভাবে প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত হতে বাধ্য।

সক্রেটিসের অসামান্য শিক্ষা যেটা আমার কাছে মনে হয় সেটা হচ্ছে, তিনি কথোপকথন চালিয়ে যেতে চেয়েছেন, কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার চেয়ে বাহাসের দ্বান্দ্বিকতাই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার