সেটে প্রডিউসারকেও ঋত্বিক ঢুকতে দেননি

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৭, ২০১৭

এম.এ পরীক্ষার প্রস্তুতির সাথে সাথে সুরমা যখন বাচ্চাদের দেখাশোনা করছিলেন, ঠিক তখনই স্বামী ঋত্বিক ঘটকের মাথায় এলো, সিনেমা বানাবেন। তো বানালেন মেঘে ঢাকা তারা। কয়েক যুগ পরে ২০১৩ তে যে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (ঋত্বিকের জীবনের ওপর অনুপ্রাণিত) নির্মিত হয়েছে, সেটা নিয়ে বলতে গিয়ে শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ৮৪ বছরের সুরমা ঘটক। ১১ জানুয়ারি ২০১৭ তে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ফিল্মটা ভালো হয়েছে।’ কথা বলতে বলতে তিনি যেন উইন্ডমিলের মতো স্মৃতির বাতাসে অতীতে ভেসে গেলেন। ধীরে ধীরে ধুলো সরে গিয়ে সিপিয়ার রিল থেকে রঙিন হয়ে উঠতে লাগল এক শিল্পীর জীবন্ত প্রতিকৃতি। বাঙ্লায়ন করেছেন রিফাহ সানজিদা

আপনার সঙ্গে ঋত্বিকের দেখা হলো কীভাবে?
সুরমা: প্রথম দ্যাখা কলকাতায়। আমি তখন আমার মাসিমা সাধনা চৌধুরীর সঙ্গে থাকতাম। আইপিটিএ সাউথ স্কোয়ারে আমি অভিনয় করতাম। তো একদিন উনি সেখানে এলেন। আমাকে আগেই তার সাথে কথা না বলতে সাবধান করা হলো, সে নাকি ট্রটস্কিট (মার্ক্সবাদী)। এর কিছুদিন পরই আমি শিলং গেলাম। যেখানে আমি বড় হয়েছি। ফিরে এসে দেখি, উনি আমার আইপিটিএতেই সদস্যদের সাথে নর্থ, সাউথ আর সেন্ট্রাল স্কোয়াডে কাজ করছেন একটা নাটকে।
আমি সে সময়টায় তার সঙ্গে কথাই বলিনি। তার লেখার অংশখানি নিয়ে প্রশ্ন থাকলে করতাম, উনি উত্তর দিতেন। এটুকুই। আমরা আসলে দুজনই দুজনকে জানতে শুরু করলাম যখন আমার মাসিমা আমাকে বললো, ওর সঙ্গে ঘুরতে যাবে না। ওকে শিগগিরই পার্টি থেকে বের করা হবে। জ্যোতি বসুর ঘোষণা আসলো, ওয়ান-ম্যান কমিশন গঠনের। ঋত্বিককে ডাকা হলো। এরপর পার্টি মিটিংয়ে সবাই বলতে লাগলো, ঋত্বিক লক্ষ্মিটার (আমার ডাকনাম) সর্বনাশ করবে। আমি বলতে লাগলাম, মতাদর্শ, একজন ব্যক্তির চাইতে অনেক ওপরে থাকে। কিন্তু যতক্ষণ না ঋত্বিক দোষী প্রমাণিত হচ্ছে, আমাকে দেখতে দাও ব্যাপারটা। ইনভেস্টিগেশন কিন্তু বন্ধ হলো না। তখন আমি ঋত্বিককে বললাম, কি দরকার এসব! আইপিটিএ আর কম্যুনিস্ট পার্টির! চলো আমরা গ্রুপ থিয়েটারে ফিরে যাই। আমাদের কাছে আসাটা থিয়েটারেই বাড়লো।
তাহলে এর পরের ধাপটা তো নিশ্চয়ই বিয়েতে গড়াল...
সুরমা: হ্যাঁ। আমার বাবা ওর হাতে আমার হাত  তুলে দিলেন বিয়েতে। আর আমার শাশুড়ি মা খুব খুশি ছিলেন এ বিয়েতে। আমায় ভীষণ পছন্দ করতেন। বলতেন, নামেও লক্ষ্মী কাজেও লক্ষ্মী। ঠিক ওই সময়টায় সলিল চৌধুরী আমার স্বামীকে চিঠি লিখে ডাকলেন, মুম্বাইয়ের ফিল্মস্তান স্টুডিওতে চাকরির ব্যাপারে। একটা ইন্টারভিউয়ের জন্যে। আমায় সাথে নিয়ে তিনি গেলেন। তবে মাস চারেক কাজ করবার পর তিনি চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। এর মধ্যে তিনি মধুমতিসহ আরও কয়েকটি স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললেন। তিনি ওখানে বেশিদিন থাকতে চাইলেন না। বলতেন, এখানে থাকলেই বোম্বে মার্কা ছবি করতে হবে। তিনি ওই ধারার ছবির মানুষই ছিলেন না।
এরপর কলকাতায় ফিরে এলেন?
সুরমা: হ্যাঁ। তিনি ফিরে এলেন এখানে। এসে অযান্ত্রিক ছবির কাজ শুরু করলেন। টাকার খুব সমস্যা ছিল। তবে তিনি ছবির কাজ শেষ করলেন কোনোমতে ব্যবস্থা করে। যদিও ক্রিটিকসরা ভালো সাড়া দিলেন, তবে ছবিটা ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। তার পরের ছবিটা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ও একই অবস্থা হলো। ওটাও চলেনি। এরপর তিনি কাজ শুরু করেন শংকরের উপন্যাস অবলম্বনে ‘কত অজানারে’ ছবিটার। কালী ব্যানার্জি ছিল এ ছবিতেও। ঋত্বিক সেই ছবির সেটে লোকজন ঢুকতে দিতেন না, বেশ বিরক্ত হতেন। একটা সময় অবস্থা এমন যে, একবার প্রডিউসারকে পর্যন্ত ঢুকতে দেননি। সব মিলিয়ে সেটের পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিল। তখন সে ছবির কাজ আটকে গেল। ওটা আর শেষই হয়নি।
চলবে...