সেলুলয়েডে তাইওয়ানের কথক

হো সিয়ো সিয়েন

আকরাম খান

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৬, ২০১৭

ওজু, মিজুগুচি, কুরোসাওয়া, ঋত্বিক, সত্যজিৎ, কিয়ারোস্তামি এশিয়ার সৃজনশীল ও অঁতর চলচ্চিত্রকারদের এই ধারাবাহিকতায় নিঃসন্দেহে তাইওয়ানি পরিচালক হো সিয়ো সিয়েন আরেকটি বিস্ময়। চীনের গাওডাং প্রদেশে ১৯৪৭ সালে হো-এর জন্মের ঠিক এক বছর পরেই তার পরিবার তাইওয়ানের দক্ষিণে ঘর বাঁধে। ১৯৮০ সালে Cute Girl চলচ্চিত্রটি তৈরির মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রকার হিশেবে হো-এর যাত্রা শুরু হয়। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত পরিচালকদের মতোই তার প্রথম দুটি ছবি Cute Girl ও ১৯৮১ সালে তৈরি Cheerful Wind এর বর্তমানে কোনও প্রিন্ট পাওয়া যায় না। ১৯৮৩ সালে সরকারি প্রযোজনায় নির্ত Sandwitchman চলচ্চিত্রটিতে হোসহ পরিচালনায় ছিল আরও চারজন নতুন পরিচালক। এ চলচ্চিত্রটির নান্দনিক উৎকর্ষতা দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। এর বক্স অফিস সাফল্য খুলে দ্যায় তাইওয়ানে শৈল্পিক চলচ্চিত্রের সম্ভাবনার দরজা। একই বছর হো সিয়ো সিয়েনের Green Green Grass of Home তাইওয়ানের সেরা ছবি হিশেবে পুরস্কৃত হয়। পরপর দুই বছর ‘৮৪ ও ‘৮৫ তে হো এর The Boys from Fengkuei, A Summer at Grandpa চলচ্চিত্র দুটি ফ্রান্সের নানতে চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পায়। এ সময়ে বিশ্ব চলচ্চিত্র প্রেক্ষাপটে হো ব্যাপক সাড়া ফেললেও City of Sadness এর ১৯৮৭ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের গোল্ডেন লায়ন প্রাপ্তিই তাকে এনে দ্যায় অঁতর চলচ্চিত্রকারের স্বীকৃতি। ১৯৯৯ সালে তার পরিচালিত Flowers of Shanghai এর জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবের জুরিরা তার হাতে তুলে দেয় গোল্ডেন পাম।

অতীতে তাইওয়ানে ৯ ধরণের আদিবাসীর বাস ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে এই দ্বীপ ভুখণ্ডে চীন, পর্তুগিজ ও স্পেনিশরা আসা শুরু করে। ১৬২৪ সালে তাইওয়ান পর্তুগিজ ও স্পেনিশদের অধিকারে আসে। চীন ১৬৬১ সালে তাইওয়ান দখল করে নেয়। আঠারোশো শতকের শেষদিকে চীন-জাপান যুদ্ধে চীন পরাজিত হলে তাইওয়ান জাপানের অধীনে চলে আসে, পরবর্তী পঞ্চাশ বছর তাইওয়ান ছিল জাপানের উপনিবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর তাইওয়ানে শুরু হয় মূল চীনা ভূখণ্ডের জাতীয়তাবাদী শাসন। দীর্ঘ পরাধীনতার সময়কালে শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, গণঅভ্যুত্থানের চেষ্টাকে শাসকরা নির্বিচারে জেলহাজতে পুরে ও ব্যাপক গণহত্যার মধ্য দিয়ে দমন করে। তাইওয়ানিদের নির্যাতনের ইতিহাস স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হওয়া তো দূরের কথা, দীর্ঘদিন সাধারণ মানুষ আলোচনা করতেও সাহস পেত না। অবশেষে ১৯৮৭ সালে তাইওয়ানে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে মার্শাল ল উঠে যাওয়ার পর লেখক-শিল্পীরা তাদের সত্যিকারের ইতিহাস তুলে ধরতে শুরু করে। হো এর প্রথম দিকের আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্রে সরকারের চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতি ও ভাষার বদলে জনসাধারণের বহুমুখি সংস্কৃতি ও ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ১৯৮৭ সালের পর থেকে তার চলচ্চিত্রে তাইওয়ানিদের গুপ্ত ইতিহাস ও আমেরিকার সহযোগিতায় দ্রুত পরিবর্তনশীল নগরজীবনে আত্মপরিচয় সংকটে ভোগা উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রজন্মের ভোগ-বিলাসে ভেসে যাওয়া, এই দুই বিষয় মূলত ঘুরে-ফিরে এসেছে। City of Sadness, Puppet Master এবং Good man Good Woman রক্তাক্ত ইতিহাস উন্মোচিত করার এই ট্রিলজি যাত্রার পর হো ফিরে এসেছিলেন সমসাময়িক তাইওয়ানের Goodbye South Goodbye চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এ চলচ্চিত্রে হো চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের আদান-প্রদান ও তাদের জীবনে রাজনৈতিক, সামাজিক প্রভাবের গল্প বলার পর তাইওয়ান থেকে আরও দূরে সরে আরও অতীতে ফিরে গিয়ে Flowers of Shanghai এর মধ্য দিয়ে তার পূর্বসূরি ও চীনা সংস্কৃতিকে আর ভালো করে বুঝে ওঠার প্রক্রিয়ায় যেন বর্তমানের তাইওয়ানকেই আরও স্পষ্ট ও স্বচ্ছভাবে অনুধাবন করতে চেয়েছে।