সংগৃহিত

সংগৃহিত

স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষা যখন কঠিন

নীলুফার ইসলাম মোনা

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৮

ইভিনিং ক্লাস করতে যেয়ে ভ্যাঙ্কুভার শহরে বেশ কিছু ভাল বন্ধু জোটে আমার। তাদের মধ্যে একজন হলেন মারিয়া (ছদ্মনাম)। সাতাশ বছরের ফিলিপিনা আমার এ বান্ধবী পেশায় একজন লেখিকা। অসম্ভব খুঁতখুঁতে স্বভাবের এই তরুণী সারাদিন যে কত পাতা লেখেন আর ছিঁড়ে ফেলেন তার কোন হিসেব নেই। একদিন হঠাৎ সে খুব আমার বাড়ি আসতে চাইলেন। মানা করলাম না। বাড়ি এনে তাকে বসিয়েই রান্না চাপালাম। সে হঠাৎ খুব অবাক করে জিজ্ঞেস করল, নিলুফার, তুমি ভবিষ্যতে সন্তান নেবে?
হ্যাঁ, নেব না কেন! অবশ্যই নেব।
আমি নেব না।
ও আচ্ছা। খুব একটা আগ্রহ না দেখিয়ে বললাম।
তুমি সন্তান কেন নেবে?
এইবার আমি একটু চিন্তায় পরে গেলাম। অনেক ভেবে চিন্তে বললাম, কারণ আমি আমার মতো একজনকে পৃথিবীতে রেখে যেতে চাই।
আমিও ঠিক তোমারি মতো আমার লেখা বই রেখে যাব পৃথিবীতে।

তাইতো, এতে দোষের কি আছে যদি মারিয়া তার জীবনের সব মনোযোগ দিয়ে দেন তার বই লেখার পিছনে? এমন একটা বই হয়ত লিখে যেতে পারেন যা পড়ে কোটি কোটি মানুষ আনন্দ অনুভব করবেন। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলাম, আসলেই তো, পৃথিবীতে মনুষ্যজাতী বিলুপ্ত প্রায় নয় যে কিছু মানুষ সন্তান নিতে না চাইলে মনুষ্যজাতির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে!

পৃথিবীতে কালে কালে স্বেচ্ছায় সন্তানহীন বা অবিবাহিত নারী পুরুষ অনেকেই আছেন। জেন অস্টিন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রানী এলিজাবেথ ১, স্যার আইজাক নিউটন, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, জোয়ান অফ আর্ক, মাদার তেরেসাদের মতো অনেকেই আছেন, যারা হয়ত সমাজ, সংসার, বিশ্ববাসীর জন্য কিছু করবেন দেখে সংসার ধর্ম পালন করতে আগ্রহী ছিলেন না। ভুল বুঝবেন না, আমি আমার লেখা দিয়ে সংসার করতে আগ্রহী / সন্তান নিয়ে ব্যস্ত বন্ধুদের নিরুৎসাহিত করছি না। বলতে চাইছি, একেকজনের জীবন উদ্দেশ্য একেক রকম হবার কথা । এখানে কারো অবদানই কম না। সবাই সবার অবস্থানে সঠিক। মাদার তেরেসার অবদানকে যেমন আমরা কেউ ভুলতে পারব না, তেমনি তাকে পালনকারী তার জননী বেরনাই এর অবদান কেও ছোট করতে পারবনা। কেননা সেই জননীর লালন পালনেই তৈরি হয়েছে মাদার তেরসার মতো এক নিরস্বার্থ সমাজ সেবিকার।

এখন প্রশ্ন হল, সবার অবদানই যদি গুরুত্বপূর্ণ হবে তবে সমস্যাটা কোথায়? কেন এইধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্নের মুখমুখি হই আমরা? সত্যিকথা বলতে, মনুষ্যজাতী অনেক বিচিত্র প্রাণী। তারা নিজেদের আনন্দ মুহূর্ত গুলো নিয়েই পুরাপুরি সুখী হতে পারেন না। সম্পূর্ণ সুখী হতে তাদের আরেকজনকে অসুখী/ অসফল/ অপূর্ণ প্রমাণ করার প্রয়োজন হয়ে পরে। কিভাবে করি?

১. পেশাগতভাবে সফল কেউ সন্তান/সংসার নিয়ে ব্যস্ত কাউকে প্রশ্ন করবেন - "কেন চাকুরী করেন না?" "পড়াশুনাটা আবার শুরু করলেই তো পারেন" "এভাবে আর কতদিন বসে থাকবেন?"

২. সংসার/ সন্তান নিয়ে ব্যস্ত কেউ চাকুরীজীবী কাউকে আচমকা জিজ্ঞেস করে বসবে্ন -"বিয়ে করবেন কবে?" "সন্তান নিবেন না?" "দেরি হয়ে যাচ্ছে তো" "নাকি সন্তানই নেবেন না?" " কেন সন্তান নেবেন না?"

অল্প কিছুক্ষণের পরিচয়, একটু হেসে কথা বলা হয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন। এখন প্রশ্ন হল, কিভাবে এমন প্রশ্ন থেকে নিজেকে এবং অপরকে আমরা রক্ষা করতে পারি?

আসুন আজ থেকে মেনে নেই- একজনের জীবন উদ্দেশ্য আরেক জন থেকে আলাদা হতেই পারে। এই ধরনের পার্থক্য কে সহজ ভাবে দেখার চেষ্টা করি।
নিজের ছোট ছোট সফলতা /বিফলতাতে মনোনিবেশ করি। আমরা যা সফলতা ভাবছি তা আরেক জনের জন্য সফলতার মাপকাঠি না ভাবি। তাকে তার সফলতা/বিফলতার/পূর্ণতার মাপকাঠি নিজে নির্ধারণ করতে দিই।
কাউকে হঠাৎ এমন উপদেশ দেবার আগে ভেবে নেই মানুষটি আদতেও উপদেশ চাইছেন কিনা। অন্তত তাকে একাধিক মানুষের সামনে এই ধরনের প্রশ্ন না করি।
কেউ এই ধরনের প্রশ্ন করলে স্পষ্ট করে বলে দেই, এটা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার এ সিদ্ধান্ত নিজে থেকে বেছে নিয়েছি এবং আমি আমার এই সিধান্তে সুখি। নিজের জীবনের কষ্ট বা না পাওয়ার গল্প সবাইকে না বলে, কাছের মানুষদের শুধু বলি। যে কিনা বুঝবে বা সত্যিকারের গঠনমূলক উপদেশ দিতে পারবে।

যাই হোক, কিছু দিন আগে মারিয়া একটা বেশ ভাল বৃত্তি নিয়ে নিউইয়র্কে পারি জমালেন। সে এই অল্প সময়েই তার লেখা একটা গল্পকে মঞ্চ নাটকে রূপান্তর করতে পেরেছেন। বেশ, ভুল হয়ে গেল। ওর একটা অটোগ্রাফ নিয়ে রাখা উচিত ছিল আসলে।