আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৩

মাঘ এখনও শেষ হয়নি। ফালগুন আসতে আরও দিন ছয়েক বাকি। তখন শুরু হবে বসন্ত। কিন্তু এরই মধ্যে প্রকৃতিতে একটি মিষ্টি পরিবর্তন এসেছে। বাতাসে পরিবর্তন, রোধে পরিবর্তন, আলো-আধাঁরে পরিবর্তন। শীত আর বসন্তের সন্ধিক্ষণের এই পরিবর্তন গায়ে এসে যত না লাগে, তার চেয়ে বেশি লাগে মনে। প্রকৃতির এই নতুন আয়োজন দেহকেই তৃপ্ত করে না, মনকেও কোনো এক মধুর আমেজে মুগ্ধ করে তোলে। প্রচুর পোশাক-পরিচ্ছদ পরে গুটিসুটি মেরে বসে থাকার যে জড়তা, তা থেকে চমৎকার একটি মুক্তি ও আনন্দের পরিবেশ তৈরি হলো মাঘের এই শেষ সপ্তাহ থেকেই। মন কেমন যেন করে! কার যেন অপেক্ষায় আছি, কিসের জন্য অপেক্ষায় আছি, কোথায় যেন ঘুরতে যাব, কোথায় যেন কার সঙ্গে দেখা হবে— এইসব ভালোলাগার বোধগুলো অন্তিম মাঘের বাতাসে ভর করে আমার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।

 

এই সময় অবশ্য শীত আর গরমের পোশাকের একটি টানাপড়েন তৈরি হয়। কম পোশাক পরলে শীত অনুভূত হয়, আর বেশি পরলে গরম লাগে। বিশেষ করে সকাল আর সন্ধ্যায় তৈরি হয় এই দ্বন্দ্ব। কিন্তু দ্বন্দ্ব খুব জরুরি কোনো বিষয় নয়। সন্ধ্যার পরে শীত তার মাতব্বরি ফলানোর চেষ্টা করে, কিন্তু খুব যে বেশি সুবিধা করতে পারে, তা নয়। কারণ শরীর ও হৃদয়ের অনেকটা জুড়েই তখন বসবাস করে বসন্তের আগমন বার্তা। এই আগমন বার্তা শুধু যে মানুষের হৃদয়ে প্রেম আর বিরহের এক ধরনের অদ্ভুত বোধ জাগ্রত করে তোলে তা নয়, প্রকৃতির মধ্যেও শুরু হয় নতুন এক আলোড়ন। সেই আলোড়ন গাছে গাছে নতুন কুড়ি ফুটিয়ে তোলার আলোড়ন; নতুন পাতা, নতুন প্রাণ, নতুন উচ্ছ্বাস, নতুন আলো, নতুন বাতাসের আলোড়ন।

 

এই নতুন আয়োজনে, কলরবে মেতে ওঠতে পাখিদের মধ্যেও সৃষ্টি হয় নতুন প্রণয়ের আহ্বান। প্রণয়ের সেই নতুন রঙে রাঙিয়ে ওঠে একটি প্রণয়িনী কাক। তার গায়ের কালো রঙে অনেক রং ধরে। পাতাহীন একটি ন্যাড়া গাছের ডালে ডিম ফুটানোর জন্য সে বাসা বাঁধে। ওই গাছে বাসা বাঁধতে দেখে বুদ্ধিমান মানুষদের মনে হতে পারে, বোকা কাক! কোথায় বাসা বাঁধে? আড়াল-আবডাল কোথায়, প্রণয়ের নির্জনতা কোথায়? কিন্তু মানুষ না জানলেও প্রকৃতি ওকে জানিয়ে দিয়েছে প্রণয়ের বার্তা। ওর সৃষ্টিকে নিবিড় করে তোলার জন্য সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পত্রপল্লবে বাসাটি আড়াল হয়ে যায়। আমাদের প্রেম, আমাদের সান্নিধ্য, আড়াল-আবডাল আমাদেরই নির্মাণ করতে হয়। কারণ আমরা আর প্রকৃতির সন্তান নই। প্রকৃতি থেকে বিতাড়িত হয়েছি আমরা। মা কি কম দুঃখে সন্তানকে কোলছাড়া করে! আমরা অনেক কষ্ট দিয়েছি প্রকৃতিমাকে। অনেক কষ্ট! তাই আমরা আজ প্রকৃতির ত্যাজ্য সন্তান। কিন্তু পাখিরা এখনো প্রকৃতির সন্তান। তাই ওদের প্রণয়ের গৃহ এখনো রচনা করে প্রকৃতি।

 

এই সময় আমি যখন-তখন ঘরের বাইরে চলে যাই। ঘরে থাকতে আমার একদম ভালো লাগে না। আমার তখন পথ খুব ভালো লাগে। পাতাঝরা পথ খুব ভালো লাগে। ধুলিওড়া পথ খুব ভালো লাগে। আর পাতাঝরা পথে পাতার উপরে পা রেখে ভেতরে যে মরমর করে সঙ্গীতের শব্দ হয়, তাও আমার খুব ভালো লাগে। পাতাগুলো যখন বোঁটা থেকে ছিন্ন হয়ে ঝরে পড়তে থাকে, তখন ওই পাতাদের আনন্দ ও মর্মবেদনা আমাকে খুব আলোড়িত করে। ওই পাতাগুলো যেন তার মাতৃস্তনের বোঁটা থেকে কিছুতেই খসে যেতে চায় না। কেউ কি চায়! চায় না। খুব কষ্ট হয়। পাতারা ওই বোঁটার মাথায় রেখে আসে শেষ অশ্রুবিন্দু, বেদনার শেষ চিহ্ন। বিপুল বাতাসে আশ্রয় নেয় সে— অবাধ, অগাধ। তারপর আমি দেখি, পাতাগুলো বাতাসে ওড়ে, ভালোবেসে বাতাসকে বুক দেখায়, পিঠ দেখায়। এবং এভাবে বুক আর পিঠ দেখিয়ে দেখিয়ে আর বাতাসে ঢেউ তুলে তুলে ক্রমেই নামতে থাকে মাটিতে। আলতো করে মাটিতে পা রেখেই বাতাসের টানে, প্রেমে-প্রণয়ে আবার একটু ওড়ে যায় বাতাসের কাছে। এভাবে বাতাস আর মাটির টানে শেষ পর্যন্ত মাটিতেই সে আশ্রয় নেয়।

 

আমারও মনে হয় আমাদেরও এরকম একটি আশ্রয় দরকার—নিশ্চিন্ত, নির্বিঘ্ন। বসন্তের এই আহ্বানের মধ্যে আমাদের আশ্রয়বোধ কি তীব্র হয়ে ওঠে? জানি না। পথ চলতে চলতে আমি বৃক্ষদের দিকে তাকাই। দেখি, বৃক্ষরা পাতাবিহীন শরীর নিয়ে দাঁড়িয়েয়ে আছে। কিন্তু ওদের দাঁড়ানোর মধ্যে কোনো হতাশা নেই, হারানোর কোনো বেদনা নেই। অধিকন্তু নতুন এক সৃষ্টির প্রেরণায় ও আনন্দে পত্রপল্লবহীন গাছগুলো মুখর হয়ে ওঠে। ভেতরগত এক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বৃক্ষরাজি। সেই আনন্দ আমি টের পাই। আমার মনে হয়, মানুষের মতো সংবেদনশীল, সচেতন ও বুদ্ধিমান প্রাণীদের চেয়ে গাছগুলো, বৃক্ষগুলো, লতাপাতাগুলো আরও অনেক বেশি আনন্দিত হতে পারে। আরও অনেক বেশি খুশি হতে পারে। কেননা তাদের নিরানন্দিত হওয়ার কিছু নেই, অখুশি হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু মানুষের সুখ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস এত নির্ভেজাল নয়। মানুষকে অনেক ভেবেচিন্তে খুশি হতে হয়। আনন্দিত হতে হলে মানুষকে অনেক ভাবতে হয়। ভাবতে হয়, তার খুশি হওয়া উচিত কি না, আনন্দিত হওয়া উচিত কি না। মানুষ তাই প্রকৃতির মতো খুশি হতে পারে না।

এই যে আমি পথ চলছি, এই পথের কোনো ঠিকানা নেই; কোনো ঠিকানায় যেতে চাই না। আমি ঠিকানা থেকে মুক্ত হতে চাই। এই জন্যই কি রবি ঠাকুর লিখেছেন, অমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,/আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘসে ঘাসে।

 

আমার এই নিরুদ্দেশ পথ চলায় আমার সঙ্গী অনেক আলো, বিপুল আকাশ আর পথের ধুলো। ন্যাড়া গাছগুলোর ফাঁকফোকর গলিয়ে রাজ্যের আলো এসে লাগছে আমার গায়ে, আর শীত আর উষ্ণতা মিশানো বাতাস। আমার ভেতরে অন্য এক আমি জেগে আছে। আমার সেই নতুন আমিকে নিয়ে কোনো ঠিকানায় পৌঁছোতে চাই না আমি। কেউ আমাকে নেবেন না দয় করে। আমাকে আমার কাছে থাকতে দিন।

 

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ