নিতির গল্প

উপন্যাস ২৮

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ০৩, ২০২০

ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছিল ওরা। রেস্টুরেন্টটা পাঁচতলার উপরে, ভীষণ নিরিবিলি। প্রথমে ঢুকলে ফাঁকা ভেবে ভ্রম হয়। রিসিপশনের সাথে কিছু চেয়ার-টেবিল রাখা আছে, সেখানে তেমন কেউ বসে নেই। রেস্টুরেন্টে বড় কোনও হলরুম নেই। অনেকগুলো ছোট ছোট এসি রুম নিয়ে রেস্টুরেন্টটির অবয়ব তৈরি। সেসব রুমে অ্যাটাস্ট বাথরুম। রুমের কর্ণারে একটা বেডের মতো প্লেন সোফা পাতা, তার সামনে টি টেবিল, একপাশে ড্রেসিং টেবিল, এমনকি রাউন্ড আলনা পর্যন্ত রাখা আছে। কয়েকটা রুমে একটা করে স্বচ্ছ কাচের জানালা রয়েছে। পর্দা ঠিকঠাক দেয়া না থাকলে বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যায়।

রুমে রুমে ছেলেমেয়েরা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। দু`একটা দরজা ভেতর থেকে লক করা, দু`একটা এক-দুই ইঞ্চি ফাঁকা। একটা আলো-আঁধারের পরিবেশ।এটা আবাসিক হোটেল না রেস্টুরেন্ট? প্রথমে এসে ধন্দে পড়ল রিমি। আবাসিক হোটেল বলা যায় না, এতকাল রেস্টুরেন্টের যে চেহারা মানসপটে আঁকা আছে তার সাথেও মেলে না। রেস্টুরেন্টের রিসিপশন বা ক্যাশ কাউন্টার বারের মতো করে সাজানো, অথচ কোনও অ্যালকোহলের বোতল রাখা নেই।

এই বিল্ডিংয়ে এমন ককটেল মার্কা রেস্টুরেন্টে থাকতে পারে, ভাবাই যায় না! নিচের ফ্লোরগুলোতে দেশীয় নামি-দামি ব্র্যান্ডের পোষাকের শোরুম। শত শত ক্রেতা সপরিবারে এসে শপিং করে নিয়ে যাচ্ছে। তারই উপরে এমন অদ্ভুতুড়ে রেস্টুরেন্ট! রিমির বিস্ময়ের সীমা নেই। আদনানের পছন্দে এখানে আসা। শোভা এর আগে অনেকবার এখানে এসেছে, ও বেশ সাবলীল। রিমির একটু অস্বস্তি হচ্ছে। পূর্বাশ্রমের সংস্থা তাড়া করে ফিরছে। তবুও স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছে সে। জীবনের অনেক কিছুই তো দেখা হয়নি, হয়তো এটাও দেখার বাকি ছিল।

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আদনান এলো। আদনান আসতেই শোভা আদনানকে অনেকটা জড়িয়ে ধরে রুমে নিয়ে এলো। দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিল। আদনান আসার কয়েক মিনিট পর ওয়েটার এসে দরজায় নক করল। রিমি এখানেও অবাক, রেস্টুরেন্টে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করেই একটা গোপনীয়তা বজায় রাখছে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকা বা অনাবশ্যক বিরক্ত করার বিষয় নেই। আদনান তিনটা কফির অর্ডার করল। রিমি মেনুকার্ড উল্টেপাল্টে দেখছিল। হট কফি প্রতিকাপ চারশো পঁচানব্বই টাকা করে, ভাবা যায়! নিচে নামলেই এই সাইজের কাপে কফির দাম সর্বোচ্চ পঞ্চাশ টাকা হবে। এমনকি সুস্বাদু কফি ছোট ছোট কফি কাপে বিশ টাকাতেও পাওয়া যায়।

এখন শোভার সাথে আদনান যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। দু’একবার কিসটিস হয়ে গেল। পাশে রিমি বসে রয়েছে এ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। আদনানের সাথে রিমির কথা হয়েছে, সেই আসতে বলেছে, শোভা এখানে মুখ্য নয়, শোভার পরিচিত তাই শোভাকে নিয়ে আসা, অথচ আদনান রিমির সাথে একটা কথাও বলছে না, যেন রিমিকে চেনেই না। রিমির অস্বস্তি গাঢ় হচ্ছে। আদনান এখনও শোভার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। এতটা ঘনিষ্ঠ, যেটা রিমির কাছেও বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে, একটু রাগও হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর শোভার ফোন এলো, রিমি, আমার জন্য নিচে একজন অপেক্ষা করছে, তোরা বসে একটু কথা বল আমি আধাঘন্টার মধ্যেই চলে আসব।

শোভা কথা ক’টা বলে আদনানের কপালে শব্দ করে একটা চুমু খেয়ে বিদায় নিল। এখন এ রুমে ওরা দুজন। একটা থমথমে পরিবেশ। রিমির বুঝতে অসুবিধা হলো না, আদনানকে সুযোগ করে দিতে, শোভা ইচ্ছে করেই বেরিয়ে গেল। এটা কি পূর্ব পরিকল্পিত, রিমির সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। শোভা যাবার সময় দরজা ভেজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। আদনান উঠে গিয়ে ছিটকিনি তুলে দিল। রিমির ভেতরটা কেঁপে উঠল। সে এসে রিমির বাহু সংলগ্ন হয়ে বসল। একটা প্রায় অপরিচিত মেয়ের কাছে প্রথম দিনই এভাবে কেউ বসতে পারে? ভাবা যায় না। আদনান একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে রিমির ডানহাতটা আলত করে ধরে বলল, ভয় পাচ্ছ?

রিমি কি বলবে, ভয় পাচ্ছি বলা যায় না। সে ঘরে দু্লিয়ে বলল, না।
বেশ, ভয় পাচ্ছ না এটা ভালো কথা, কিন্তু এমন হেজিটেট ফিল করছ কেন?
না, কই, আপনি কথা বলুন। রিমির চোখ পায়ের নখ দেখছে। আদনান রিমির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এভাবে কারো সাথে কথা বলা যায়? শামুকের মতো গুটিয়ে যাচ্ছ?

রিমি চোখ তুলে তাকাল। আদনানের চোখে শিকার ধরার হাসি। রিমির চোখ ফাঁদে পড়া অসহায়ের মতো সন্ত্রস্ত। আদনান বলে উঠল, মিডিয়াতে কাজ করতে গেলে স্বাভাবিক হতে হয়। এমন করে গুটিয়ে রাখলে এখানে কাজ করবে কি করে? রিমি বিস্ময় গোপন রাখতে পারল না, আমাকে কি করতে হবে?
মেনে নিতে হবে। মানিয়ে নিতে হবে। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নিতে হবে?
মানিয়ে নেয়ার অর্থ?
খাস বাংলায় বললে, শুতে হবে। পরিচালক-প্রযোযকের সাথে।
নাটক শুরু হোক তখন দেখা যাবে। কথা ক’টা বলে রিমি নিজেই নিজের ঠোঁটে কামড় দিল।

কী বলল সে? তাহলে কি তার নিজেরও ইচ্ছে আছে এসবের। ডিভোর্সের পরে অবশ্যই খারাপ লাগত। শরীরের অভ্যাস একদিনে ভুলে যাওয়া যায় না, সময় লাগে। তারও সময় লেগেছে। নিজেও একটু একটু করে বোঝাতে হয়েছে। ধীরে ধীরে অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। তাহলে কি প্রকৃত অর্থে ভোঁতা হয়নি? রিমির ভেতরে গোপন বাসনা ফনা তুলে আছে? রিমি নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজের কাছেই খুঁজছে। রিমি ভাবনার সাগরে ডুবে ছিল। আচমকা আদনান জড়িয়ে ধরে একটা কিস করল। রিমি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আজ না। আজ প্রথম দিন। আমার প্রস্তুত হতে সময় লাগবে।

আদনান কথাটার কোন উত্তর দিল না, সরে গেল। রিমি ভয় পাচ্ছিল, আদনান যদি জোর করে কিছু একটা করে। আদনান জোর করেনি। রিমি স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। কিছুক্ষণ পর শোভা ফিরে এলো। এবার আর বাড়াবাড়ি কিছু হলো না। তিনজন মিলে আগামী শুটিং নিয়ে আলাপটা সেরে নিল। আলাপের রেজাল্ট হলো এমন, ওদের শুটিং লোকেশন হবে কক্সবাজার। আগামী মাসে দিনতারিখ ঠিক হবে। ততদিনে ওদেরকে সব জানিয়ে দেয়া হবে। ওরা যেন মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে।

নিতি ঢাকায় আসার পর পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করেছে। নিয়মিত ক্লাস করছে। ক্লাস পড়াশোনার বাইরে একটুও সময় নষ্ট করছে না। জীবনের কিছু কিছু পরিবর্তন জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়, ওলট-পালট করে দেয়। তখন জীবনের নতুন মানে খুঁজে নিতে হয়। নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। জীবকে নতুনভাবে শুরু করতে হয়। নিতির নিয়তির কাছে আগের জীবন হার মেনেছে। আগের সময় পালিয়ে গেছে। সেই উচ্ছ্বল হাসি, সেই জীবনের উচ্ছ্বাস, দীপের সাথে স্বপ্নের রংমিছিলে হেটে যাওয়া, এখন আর নেই। এখন রবী ঠাকুরের গান সঙ্গী হয়েছে নিতির:

সদা থাকো আনন্দে, সংসারে নির্ভয়ে নির্মলপ্রাণে
জাগো প্রাতে আনন্দে, করো কর্ম আনন্দে
সন্ধ্যায় গৃহে চলো হে আনন্দগানে

সঙ্কটে সম্পদে থাকো কল্যাণে,
থাকো আনন্দে নিন্দা-অপমানে।
সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে,
চির-অমৃতনির্ঝরে শান্তিরসপানে

কবিগুরু এত দুখের মাঝেও আনন্দে থাকতে বলছেন। নিন্দা-অপমানে আনন্দে থাকতে বলছেন। সবাইকে ক্ষমা করে আনন্দে থাকতে বলছেন। নিতির চোখ অশ্রুপূর্ণ হলো। কাকে ক্ষমা করবে সে? কীভাবে করবে? কি এমন ঘটেছে, দীপ তার সাথে যোগাযোগ করছে না? কি এমন অন্যায় করেছে সে, দীপ সবকিছু ভুলে গেল? নিতির চোখের জলে বালিশ ভিজে গেল। কণ্ঠ শুকিয়ে এলো, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে মাথাটা ঘুরে গেল। নিতি চোখ বন্ধ করল। মোবাইলে এখনো রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে। আগের গান চেঞ্জ হয়ে নতুন গান এসেছে:

ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু

এই যে হিয়া থরো থরো
কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো,
ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু

এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
পিছন-পানে তাকাই যদি কভু

দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায়
শুকায় মালা পূজার থালায়,
সেই ম্লানতা ক্ষমা করো,
ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু

মানুষের মনের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত কষ্ট, রবীন্দ্রনাথ যেন কাছ থেকে দেখেছেন। হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। কবিগুরুর ভাবনার সংস্পর্শে এসে নিতির মন নতুন করে সেজে উঠছে। বুকে সাহস বাড়ছে। অশ্রুপূর্ণ চোখে অনেক দূরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। সে দৃশ্যে মাঠ ভরা শস্য আছে, সমুদ্রের কলকল্লোল আছে, সবুজ পাহাড় আছে, নির্মল আকাশে সকালের সোনা রোদের আবেশ আছে। নিতি মন দঢ় হচ্ছে। আগামী দিনের সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার শপথে উজ্জ্বল হচ্ছে, বলিষ্ঠ হচ্ছে। নতুন গান বেজে উঠল:

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে।

যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভ-
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে।

যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে।

যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে।

গান থামতে থামতেই ফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার। ফোন ধরতেই দীপের গলা, হ্যালো নিতি, আমি দীপ। চলবে