
অবরোহী
উপন্যাস ৪
আশাজ যুবায়েরপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৭, ২০১৯
সেই যুগটাই ছিল অন্য রকম। খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যে, বলা যাবে যুগ-যুগ আগে; আবার এত কাছেরও নয় যে, বলতে পারি এই মাত্র সেদিন, কিংবা কয়েক বছর আগে। সময়ের দূরত্ব আর কতখানিই-বা! একশো বছরও তো পেরোয়নি এখনো। তবু তখনকার সময় আর এখনকার সময়ের মধ্যে যে আকাশ সমান তফাৎ রয়ে গেছে। সেদিনের সে দেশটাই তো আর মনে পড়ে না। তখন যা ছিল একটা গোটা দেশ, আজ অনেক দিন হলো তা ভেঙে হয়েছে দু`টুকরো। একটার নাম হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, আর অন্যটা বাংলাদেশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান।
তখনকার মানুষজন ছিল ঠিক আজকের মতোই। দুটো চোখ, দুটো কান, একটা নাক, কিছুই বদলায়নি, কেবল বদলেছে আবেগের তারতম্য। এদেশের সবাই প্রায় গাঁয়ের মানুষ। শহরে ক`জন লোকই বা থাকে, আর তাছাড়া শহরের সংখ্যাই আর কত? গাঁও-গেরামের মানুষ, চালচুলো নেই, শিক্ষার সুযোগ নেই। খরা হয়, বৃষ্টি হয়। মাঠ জ্বলে পুড়ে যায়, ফসল হয় না। ঘরে অন্ন নেই। আকাশে কালো মেঘ, বৃষ্টি নামে... বৃষ্টি নামে অঝোর ধারায়; খালবিল ভরে যায়, ফুলে ফুঁসে ওঠে নদ-নদী। বৃষ্টিতে প্লাবনে হেজেপচে মরে যায় সব। ফসল হয় না। ঘরেতে অন্নের অভাব।
এইতো বঙ্গদেশ। সেই সময় মানে সাতষট্রি বছর আগে দেশে তখন এত বেশি লোকও ছিল না। বঙ্গদেশ তখনও পরাধীন,পাকিস্তানি শাসন চলছে। যদিও সামান্য কলকারখানা ছিল, কিন্তু চাষবাসই মানুষের মূল সম্বল। চাইলেই একজায়গায় থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে হলেই তখন ছুটে যাওয়া যেত না। কারণ রাস্তাঘাট এত হয়নি। যানবহনের অবস্থা বড়-বেগতিক। উড়োজাহাজ চোখে দেখতে ছোট-বড় সকলেই ভুরু ওপরে হাত রেখে রোদে দাঁড়িয়ে থাকত। রেলগাড়ি চড়া তো জীবনের এক বিড়াট অভিজ্ঞতা। মটরগাড়িও তাই। ড়েছে আর কে? যদিও চড়েছে শহুরে কিছু বাবুরা।
গাঁয়ের মানুষ এমন বিষয়গুলো চোখে দেখতে পেলেও ওদের নয়ন স্বার্থক। গ্রামের মধ্যে যারা ধনী তারা বেশিরভাগই শহরে থাকত। কিছু গ্রামেও থাকত তাদের মধ্যে অন্যতম ডাক্তার বাবু। ডাক্তার সাহেব এমবিএস কিনা সেটা জানবার প্রয়োজন কখনও অনুভব করেনি গ্রামবাসী। আপদের বেলায় অমন মানুষ সহসা খুঁজে পাওয়াও চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। ডাক্তার বাবুর বাড়িটা মোঘলি ঢঙে গড়ানো। দূর থেকে থেকে দেখে, ভূতের বাড়ি মনে হওয়াটা ন্যায়সঙ্গত। বাড়ির সামনে সুপারি গাছ সারিবদ্ধভাবে গোছানো একদম রাস্তা অবধি। বাড়ি ছাদ থেকে গ্রামটাকে দেখতে, একদম সবুজ স্বর্গ লাগে।
মনে হয়, কোনো এক দক্ষ শিল্পীর রংতুলিতে সবুজ ক্যানভাসে আঁকা। গাঁয়ের গা ঘেঁষে একটা নদী বয়ে গেছে। নদীর ঠিক পাজরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝাপড়ি চুলের মতো ডালপালা নিয়ে বয়জ্যেষ্ঠ এক বটবৃক্ষ। গাঁয়ের মানুষের নিয়তির অনেককিছুই নির্ভর করছে এই বটবক্ষকে কেন্দ্র করে।
চলবে