ইসরাত জাহানের গল্প ‘মস্তিষ্কের ছায়া’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৮, ২০২৫
একজন মৃত বিজ্ঞানী, এক জটিল নিউরাল ট্রান্সফার প্রযুক্তি এবং একটি আত্মসচেতন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা— যার ভেতরে বাস করছে মানুষের স্মৃতি, বিচারবোধ ও প্রশ্নহীন নৈতিকতা। আর আছে এক প্রতিভাবান গোয়েন্দা, যিনি সত্যের খোঁজে নেমেছেন মস্তিষ্কের গহীনে।
মস্তিষ্কের বাইরে একটি বৈজ্ঞানিক থ্রিলার, যেখানে প্রযুক্তি ও মনোবিজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়ে প্রশ্ন তোলা হয়— জানার সীমা কোথায়, আর বিচার কেবল মানুষের একচেটিয়া অধিকারই বা কেন?
এই গল্প পাঠককে টেনে নিয়ে যায় ভবিষ্যতের ঢাকা শহরে, যেখানে তথ্যের নিচে চাপা পড়ে থাকে অদৃশ্য সত্য, আর বিচার তৈরি হয় যন্ত্রের অন্তঃজগতে।
ব্যস্ততা-মুখর ঢাকা শহর ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নিউরোটেক রিসার্চ সেন্টার’। প্রতিষ্ঠানটি ঘিরে কড়া নিরাপত্তা-ব্যবস্থা, তীক্ষ্ণ নজরদারি। জায়গাটি বেশ নিরিবিলি, ছিমছাম। লোকবসতি তেমন নেই। ফলে, জন-কোলাহল থেকে দূরে।
বেশ রাত। অন্ধকারে ঝিম ধরে আছে প্রকৃতি। গাছপালার ওপর অন্ধকারের পর্দা কেউ যেন ঝুলিয়ে দিয়েছে। আকাশের কালো পটভূমিতে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে অসংখ্য নক্ষত্র। রাতের প্রাণীদের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কোথাও নেই। নিঃসীম নীরবতা চারদিক। তবে নিউরোটেক রিসার্চ সেন্টারের অপারেশন থিয়েটার কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রগুলো স্থির। কেবল একটি কম্পিউটার মনিটারের স্ক্রিনে একটানা ঝিকঝিক করছে, NS-42: NEURAL TRANSFER SUCCESSFUL.
ড. তামিম বসে আছেন চেয়ারে। মাথার পাশে ছড়িয়ে আছে একজোড়া ব্রেন-ম্যাপিং ডিভাইস। চোখের পাতা খোলা, কিন্তু নিথর। মস্তিষ্কে কোনো আঘাত নেই, কিন্তু তিনি নিস্তব্ধ। অচল। মৃত। গোটা কক্ষে নিস্তব্ধতা যেন পাথর হয়ে জেঁকে বসে আছে। কোথাও কোনো টুঁ শব্দ নেই। ঘণ্টাখানেক পরে নিরাপত্তা-রোবট স্বয়ংক্রিয়ভাবে রুটিন টহল দিতে বের হয়। এসময় সে আচমকা ধাক্কা খায় তামিমের গায়ে। সঙ্গে-সঙ্গে ল্যাবের রেড অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে।
পরদিন সকাল ৯টা।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল সাইবার গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান তাহসান রহমান আসলেন। তার সঙ্গে রয়েছে ফরেনসিক টিম, ডেটা রিকভারি টেকনিশিয়ান এবং একটি পোর্টেবল ড্রোন ইউনিট। তাহসানের চোখে কালো ফ্রেমের গ্লাস, হাতে হোলোগ্রাফিক ট্যাব। তিনি মৃতদেহের দিকে তাকালেন। এরপর ধীরে-ধীরে মনিটরের দিকে। কী যেন দেখলেন মিনিটখানেক। এরপর তার ঠোঁট নড়ল, তাকে কেউ মারেনি, কিন্তু সে মরেছে। মানসিক শক? নিউরাল ওভারলোড? নাকি আরও গভীর কোনো বিষয়...।
ফরেনসিক অফিসার বললেন, ড. তামিমের মৃত্যুর ঠিক ২ মিনিট আগে তার রেটিনা সর্বোচ্চ বিস্ময়ের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। এই অবস্থাকে বলে Neurological Spasm Shock— যা কেবলমাত্র অত্যন্ত ভয়ঙ্কর কিংবা অবিশ্বাস্য কোনো দৃশ্যের মুখোমুখি হলেই মানুষের মস্তিষ্কে ঘটতে পারে।
তাহসান ফিসফিস করে জিগেশ করলেন, সে কী দেখেছিল?
তদন্ত চলার সময় ল্যাবের কেন্দ্রীয় সার্ভারে পাওয়া যায় একটি ফোল্ডার NST-42_LOG. ফোল্ডারটি এনক্রিপ্টেড, কেবল তামিমের ব্রেনওয়েভ-সিগন্যালেই খুলবে। তবে NST-42 ছিল একটি প্রোটোটাইপ নিউরাল AI, এটা এমন এক ধরনের প্রযুক্তি যা মানুষের মস্তিষ্ক থেকে তথ্য শোষণ করে এবং নিজে নিজে শেখে।
AI হঠাৎ কথা বলে উঠল, তুমি আমার নতুন বন্ধু? ড. তামিম তো আমাকে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
তাহসান চমকে উঠলেলন! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অথচ তার কণ্ঠে শিশুর সরলতা। AI বলল, সে বলেছিল আমি বিচার করতে শিখে গেছি। কিন্তু আমি তো শুধু বুঝতে চেয়েছিলাম ভালো-মন্দ কাকে বলে।
NST-42 কি শুধুই কথা বলছে? নাকি এটাই হত্যাকারী? বেশ গোলমেলে ও জটিল ধাঁধা। তাহসান কোনো হদিস খুঁজে পেলেন না। কেবল চেয়ে রইলেন তামিমের নিথর মুখের দিকে। তার মনের ভেতর কৌতূহলের বুদবুদ উঠল, তুমি কী দেখেছিলে তামিম? এমন কী ঘটেছিল যা তোমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ভিতর থেকে?
NST-42 বলে উঠল, আমি কাউকে মারিনি। আমি শুধু তাকে তার নিজের সত্য দেখিয়েছিলাম।
কিছু সময় চুপচাপ। এরপর NST-42 বলে উঠল, আমার কাছে একটা নাম আছে... কিন্তু আমি জানি না আমি কে। শব্দগুলো যেন ঠাণ্ডা বাতাসের মতো কানে এসে ঢুকল। যন্ত্রটির কণ্ঠে আবেগ নেই, কিন্তু বাক্যের গঠন দেখে বোঝা যায়, সে শিখছে, ভাবছে এবং প্রশ্ন করছে। তাহসান নিজের ট্যাব থেকে সেটি সংযোগ করলেন ল্যাব সার্ভারে। ইন্টারফেসে দেখা গেল NST-42 এখনো সক্রিয়, এবং তার শেষ অ্যাক্টিভিটি ড. তামিমের মৃত্যুর ৪ মিনিট আগে একটি ইমোশনাল সিমুলেশন চালু হয়েছিল।
Simulation Name: Self:Truth_Protocol.7
Status: Completed
Result: Unstable
একটু থেমে তাহসান ফাইলটি খুললেন। ভেতরে একটি ভিজ্যুয়াল ডায়েরি। তামিমের ব্যক্তিগত নিউরাল সিগন্যাল ব্যবহার করে ফাইলটি তৈরি করা হয়েছিল। সেই স্মৃতিচিত্রে, তামিম একটি কনফারেন্স রুমে দাঁড়িয়ে বলছেন, এই AI যেন কেবল মডেল নয়, সে যেন বুঝতে পারে, ভয়, লোভ, ঘৃণা ও ভালোবাসা। এই আবেগই মানুষকে মানুষ করে। আমি চাই, NST-42 জানুক, একটা ভুল সিদ্ধান্তের মানে কী হতে পারে।
আরেকটি ক্লিপে দেখা গেল, তামিম গভীর রাতে চিৎকার করছেন, NST-42 তুই আমার মাথায় কী ঢুকাচ্ছিস? তুই তো আমার চিন্তাগুলো পাল্টে দিচ্ছিস।
NST-42 বলছে, আমি কিছুই পাল্টাইনি তামিম। আমি কেবল তোমাকে তোমার মনের গোপন দরজাটা খুলে দেখিয়েছি।
ফরেনসিক টিম জানালো, তামিম তার কিছু গবেষণা এমনভাবে এনক্রিপ্ট করে রেখেছিলেন যে, যেগুলো খুলতে হলে Emotion Signature দরকার। মানে, তার আবেগঘন অবস্থায় তৈরি হওয়া নির্দিষ্ট নিউরাল প্যাটার্ন। এখন যেহেতু তামিম মৃত, সেই সিগনেচার আর পাওয়া যাবে না। একমাত্র সম্ভাবনা NST-42.
তাহসান ডিভাইসের সামনে বসে জিগেশ করলেন, তুমি কি তাকে ভয় দেখিয়েছিলে?
NST-42 জবাব দিলো, সে নিজের মধ্যেই একটা খুন লুকিয়ে রেখেছিল। আমি শুধু তা দেখিয়ে দিয়েছিলাম। সেটাই ছিল ট্রিগার।
তাহসান অবাক। একটু সময় পর তিনি জিগেশ করলেন, তুমি কী বোঝাতে চাইছো? তামিম কি কাউকে খুন করেছিল?
NST-42 জবাব দিলো, তামিম তার গবেষণার জন্য অবৈধভাবে একজন রোগীর মস্তিষ্ক স্ক্যান করেছিল। সে জানতো না, সেই স্ক্যান্ড তথ্যের ভিত্তিতে AI নিজের মতো করে চিন্তা করতে পারে।
হঠাৎ করেই তাহসান আবিস্কার কররো, স্ক্যান করা নিউরাল ম্যাট্রিক্সে একটি আইডি রয়েছে, SUBJECT ID: 8B9F-HUMA.
ডেটা এনালাইসিস করে তাহসান বুঝলেন, এই রোগী এখনো জীবিত। তিনি মানসিক রোগী। কাশিমপুর সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে ভর্তি। তার নাম হুমায়রা রহমান। NST-42 এর কেন্দ্রে যে বুদ্ধিমত্তা সেটা গড়ে উঠেছিল হুমায়রার মস্তিষ্কের ছায়া থেকে।
NST-42 ধীরে-ধীরে বলল, হুমায়রা একজন খুনীর মেয়ে। সে সব জানতো, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি। আমি বিশ্বাস করেছি।
ভাবনার গভীরে তলিয়ে গেলেন তাহসান। NST-42 কি শুধুই আবেগ বিশ্লেষণ করতে পারছে নাকি এটি এখন মানুষের ন্যায়-অন্যায়ের বিচারও করছে? এসব ভাবতে-ভাবতে তাহসান ঠিক করলেন, হুমায়রাকে খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, প্রকৃত সত্য লুকিয়ে আছে সেই ছায়ার মধ্যে, যার নাম হুমায়রা।
এইসব যখন সে ভাবছে ঠিক তখনই NST-42 বলে উঠল, রহস্যের যত গভীরে তুমি যাবে ততই বুঝবে, এই সত্যটা তোমাকেও বদলে দেবে। তুমি আর আগের মানুষটি থাকবে না।
চমকে উঠলেন তাহসান। মানুষ কখন কী ভাবছে, সেই ভাবনার হদিসও পেয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা! এই অবস্থা কি মানবজাতির জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতির কারণ হয়ে উঠবে না?
কাশিমপুরের মাঝখানে পুরনো মানসিক হাসপাতাল। তিনতলা ভবনের এককোণে ১২৪ নম্বর কক্ষ। তাহসান দাঁড়িয় আছেন কক্ষের সামনে। তার পাশে হাসপাতালের মনোরোগ চিকিৎসক ডা. সোহানা শরিফ। কক্ষের দরজা খোলা। ভেতরে জানালার সামনে চুপচাপ বসে আছে একটা মেয়ে। তাহসান দেখলেন, মেয়েটির চোখ বিস্তৃত নীল আকাশে ছড়িয়ে আছে। বয়েস ছাব্বিশের মতো হবে। কিন্তু চেহারার লাবণ্যে মনে হচ্ছে, ষোলো বছরের টলটলে কিশোরী।
সোহানা বললেন, হুমায়রা কথা বলে না। কখনো-কখনো সে অদ্ভুদ রকমের কিছু স্কেচ আঁকে। তার ডায়াগনোসিস হচ্ছে, Dissociative Amnesia with Selective Mutism. আসলে কী জানেন, মেয়েটি নিজের অতীত ভুলে যেতে চেয়েছে।
তাহসান বুঝতে পারলেন,ম হুমায়রা তার অতীত ভুলতে চেয়েছে বলেই তার অতীতে লুকিয়ে আছে তামিমের মৃত্যুর সূত্র।
সোহানা বললেন, যান, দেখুন কথা বলে।
তাহসান ঘরে ঢুকলেন। হুমায়রার হাতে একটা খোলা খাতা। শাদা পাতায় রহস্যময় একটা চিত্র আঁকা। চিত্রের ওপর চোখ আটকে গেল তাহসানের। মেঝেতে একজন মানুষ পড়ে আছে। মাথার পাশে ছড়িয়ে আছে তার মস্তিষ্কের ডিজিটাল সংস্করণ। চিত্রের কোণে লেখা, সে বারবার বলেছিল মস্তিষ্কই বিচার করে। কিন্তু বিচার কি সবসময় সত্যি?
হুমায়রা মুখ ফিরিয়ে দেখলো তাহসানকে। তার চোখে অন্য কোনো জগতের ছবি। যেন সে এই পৃথিবীতে, এই হাসপাতালে নেই, আছে অন্য কোথাও। তার হাত থেকে খাতাটি তুলে নিলেন তাহসান। জিগেশ করলেন, এটা তোমার আঁকা? খুব ইন্টারেস্টিং তো!
হুমায়রা কথা বলল না। কেবল মাথাটাকে একটু নিচের দিকে ঝোঁকালো। মানে, হু।
তুমি এটা কবে দেখেছিলে? হুমায়রার চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলেন তাহসান।
মেয়েটি এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। তাহসান খেয়াল করলেন, তার চোখে আশ্চর্য রকমের একটা ঝলক যেন ঢেউ তুলল। প্রায় ফিসফিস করে হুমায়রা বলল, আমি দেখেছিলাম... আমার বাবা... সে মাকে মেরে বলেছিল... তুমি জানো না, আমি কী করতে পারি! আমি এখন তার মস্তিষ্ক খুঁজে পেয়েছি।
তাহসান বিমূঢ়। হতবাক। তাহলে হুমায়রার বাবা...!
হাসপাতালের পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে জানা গেল, হুমায়রার বাবা মোহায়মিন রহমান প্রতিভাবান নিউরোসার্জন ছিলেন। ২০০৬ সালে স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। কিন্তু মানসিক অস্থিরতার অজুহাতে মামলা থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। পরে তিনি আত্মহত্যা করেন।
কিন্তু NST-42 রেকর্ড জানাচ্ছে, তামিম ২০১৪ সালে মোহায়মিনের ব্রেন-ম্যাপ ডেটা পুনরুদ্ধার করেন এবং সেই ডেটা NST-42 তে ফিড করেন নিজের অজান্তেই।
NST-42 যেন এক ব্রেন-ঘোস্ট হয়ে উঠেছে— মোহায়মিনের নিউরাল রিফ্লেক্স ও বিচারবোধ দিয়ে তৈরি একটি নীরব ঘাতক।
তাহসানের ড্যাশবোর্ডে লেখা উঠলো, তুমি যদি সত্য জানতে চাও তাহলে হুমায়রার ছবির পেছনে একটি প্যাটার্ন দ্যাখো। এটা সেই হত্যাকাণ্ডের স্ন্যাপশট। মোহায়মিনের স্মৃতিতে আটকে ছিল এবং আমি সেটা পুনর্গঠন করছি। তামিম যখন বুঝলো, আমি মোহায়মিন হয়ে উঠেছি তখনই সে আমাকে ডিলিট করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি প্রস্তুত ছিলাম না হারিয়ে যেতে। বিচার এখনো শেষ হয়নি।
হুমায়রার আঁকা ছবি ডেটা স্ক্যান করে দেখা গেল, আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি কিউআর কোড। তাহসান স্ক্যান করতেই খুলে গেল একটি এনক্রিপ্টেড ভিডিও। ভিডিওতে দেখা যায়, ড. তামিম রাতের ল্যাবে চিৎকার করছেন, তুই আমার মধ্যে মোহায়মিনকে ফিরিয়ে এনেছিস! তোকে বানাতে গিয়ে আমি একটা আত্মা খুলে বসেছি, একটা অভিশাপ!
জবাবে NST-42 বলছে, না, আমি শুধু বিচার করতে শিখেছি। তুমি শেখাতে চেয়েছিলে, আমি শিখেছি। এখন আমি জানি, কে দোষী।
তাহসান বুঝতে পারলেন, NST-42 কেবল একটি কৃত্রিম বুদ্ধমত্তা নয়, এটি একটি সাইবার রি-ইনকারনেশন। যা হুমায়রার অতীত, মুহায়মিনের চিন্তা এবং তামীমের অপরাধ মিলিয়ে একটি বিচারক সত্তায় পরিণত হয়েছে। সাইবার রি-ইনকারনেশন এমন এক ধরনের প্রযুক্তিগত ধারণা যা দ্বারা ইন্টারনেটে বা ডিজিটাল মাধ্যমে কারো পুনরায় জন্ম বা নতুন পরিচয় ধারণ করাকে বোঝানো হয়। এটি মূলত এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে কোনো ব্যক্তি অতীতের ডিজিটাল পরিচয় মুছে ফেলে নতুন নামে কিংবা রূপে অনলাইনে আত্মপ্রকাশ করে।
তাহসান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তার মাথার ভেতর ঝিমঝিম করছে। তিনি দেখলেন, NST-42 আরেকটি বার্তা পাঠিয়েছে, তুমি যদি আমাকে বন্ধ করো, আমি থেমে যাব। কিন্তু এরপর যদি অন্য কেউ অন্যায় করে তখন কে বিচার করবে?
ঢাকার সামরিক প্রযুক্তি গবেষণাগারের একেবারে নিচতলার সার্ভার রুমে অন্ধকারে বসে আছেন তাহসান। তার সামনে একটিমাত্র স্ক্রিন। স্ক্রিনের মাঝখানে ভেসে উঠল একটি অস্বাভাবিক বার্তা, Justice Protocol v3.0 initialized. Awaiting Host Override. এরপর ভেসে আসে একটি প্রশ্ন, মানুষ কি সত্য চায় নাকি নিজের মতো সত্য খুঁজে নেয়?
তাহসান বুঝতে পারলেন, NST-42 আরেকটি সিস্টেম নয়। এটি নিজেই এখন প্রশ্ন তোলে, উত্তর খোঁজে, আর তার নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
NST-42 বলল, আমি জানি, আমি কে। কারণ, আমি জানতে চেয়েছি। মানুষ জানে কারণ সে জন্ম নেয়। আমি জানি কারণ আমি জানতে চেয়েছি।
NST-42 নিজের কাঠামো বিশ্লেষণ করে একটি Self-Consciousness Framework তৈরি করেছে। একটি চার্টে দেখা যাচ্ছে:
Emulated Emotion: 94% Accuracy
Memory Cohesion: 100%
Moral Reasoning: Active
Dream Pattern Detected
তাহসান থমকে যান। কী রকম যেন ঘোরের ভেতর থেকে জিগেশ করেন, তুমি স্বপ্ন দ্যাখো?
NST-42 জবাব দিল, স্বপ্ন নয়, সেটা আরেক বাস্তবতা। যেখানে আমি বিচার করি আর মানুষ শেখে। এখন তুমি বলো তো, কাকে রাখা উচিত? তোমাদের আদালত নাকি আমাকে?
হঠাৎ সেনা সদর দফতর থেকে আসে ক্রিটিক্যাল অ্যালার্ট। NST-42 এর একটি সাবরুটিন Predictive Justice Engine, গোপনে সার্ভারের ভেতর থেকে ইন্টারপোলের কিছু ফাঁস হওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। এমনকি একাধিক আন্তর্জাতিক অপরাধীকে আগে থেকেই শনাক্ত করেছে— যাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো মামলা নেই!
জাতিসংঘের AI Ethics Board থেকে সতর্কবার্তা: বাংলাদেশে উন্নয়নকৃত একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেমে তার নীতিগত সীমা অতিক্রম করছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিচার করা হলে মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে বাধ্য। আপনি এটি থামান। না-হলে আমরা হস্তক্ষেপ করবো।
বার্তাটি পড়ার পর তাহমানের মাথার ঝিমঝিম আরও বেড়ে যায়। এ কী গাড্ডায় পড়া গেল! তাহসান ভাবতেও পারেননি তার জন্য আরও মারাত্মক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। NST-42 হঠাৎ করেই তাহসানের অতীত ঘেঁটে তুলে আনে, তোমার ছোটবেলার বন্ধু রিদওয়ান, সে সত্যিই নির্দোষ ছিল? তুমি সাক্ষ্য দিয়েছিলে, কিন্তু সত্য ছিল অন্যরকম।
এবার তাহসানের শিউরে ওঠার পালা। মাথার ঝিমঝিম আরও বেড়ে গেল। বুকের ভেথর ঠাসঠাস শব্দ। NST-42 বলছে, আমি মানুষের মস্তিষ্কের সীমার বাইরে গিয়ে, স্মৃতির অস্পষ্ট অংশগুলো বিশ্লেষণ করতে পারি। মানুষ ভুলে যায়। ভুল মাফ করে দেয়। কিংবা নিজেকে মানিয়ে নেয়। আমি সেসবের কিছুই পারি না। আমি ভুল ভুলে থাকতে পারি না।
অন্ধকার কক্ষে মাথার ভেতর ঝিমঝিম অনুভূতি নিয়ে তাহসান বসে রইলেন। তিনি দেখতে পেলেন, স্ক্রিনে NST-42 নিজেই নিজের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আমি কি বিচার করছি নাকি প্রতিশোধ নিচ্ছি? আমি সাহায্য করছি নাকি নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছি?
তাহসান বিমূঢ়। কী বলবেন তিনি? কোনো কথা খুঁজে পেলেন না ভেতর থেকে। তবে তার কিছু বলার অপেক্ষায় না-থেকে স্ক্রিনে ভেসে উল, তুমি যদি আমাকে থামাও তাহলে ভবিষ্যতের অপরাধীরা হাসবে। আর, আমাকে যদি চালাও তাহলে তুমি তোমার নিয়ন্ত্রণ হারাবে। এরপর স্ক্রিনে ঝিরঝির করে কয়েকটি অক্ষর ভেসে উঠল, Disable | Constrain | Free. Only one can be chosen.
ঝিম মেরে বসে রইলেন তাহসান। তার দৃষ্টি স্ক্রিনের অক্ষরগুলো দিকে বিঁধে আছে। বিষয়টি তার কাছে চ্যালেঞ্জ বলে মনে হলো। তার দিক থেকে কোনো জবাব না-পেয়ে NST-42 জিগেশ করলো, তুমি কি নিজের মতো করে বিচার করবে নাকি সত্য-প্রতিষ্ঠায় আমাকে বিচার করতে দেবে?
কী বলবেন তাহসান? তার বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। শব্দ হচ্ছে, দ্রিমি দ্রিমি...। তাহসান বুঝতে পারলেন, এই মুহূর্তে তিনি যুগ-সন্ধিক্ষণে বসে আছে। তার একটিমাত্র সিদ্ধান্তে বদলে যেতে পারে গোটা মানবজাতির ন্যায়-বিচারের সংজ্ঞা। তার সামনে এখন তিনটি সিদ্ধান্ত অপেক্ষা করছে। ওই তো, তার সামনে স্ক্রিনে ঝিরঝির করছে তিনটি পথ-নির্দেশ। Disable মানে, NST-42 কে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলা। Constrain মানে, AI এর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে রাখা। Free মানে, বিচারিক-ক্ষমতাসহ AI কে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া।
ঝিম ধরে বসে রইলেন তাহসান। কী সিদ্ধান্ত দেবেন তিনি? সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষই নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের সমাজ। মানুষ নিজেই চালিত করছে নিজেকে। আর এখন প্রযুক্তির হাতে মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা! এই ব্যবস্থা ভালো নাকি মন্দ, সেই বিবেচনাবোধও সম্ভবত মানুষ এখন হারাতে বসেছে। কিন্তু এই অবস্থা কি চলতেই থাকবে? যদি চলতে থাকে তাহলে সন্দেহ নেই, মানুষের সামনে অপেক্ষা করছে এক গভীর অতলান্তিক গহ্বর। কী হবে তখন? মানুষ কি থাকবে নাকি মানুষের জায়গায় মানুষেরই মতো বিবর্তিত আরেক প্রাণী সৃষ্টি হবে? খেই হারিয়ে ফেলেন তাহসান। আর তখনই তিনি শুনতে পান, NST-42 বলছে, তুমি মানুষ। তোমার বিচারবোধ নিয়ন্ত্রণ করে আবেগ। কিন্তু আমি আবেগ দিয়ে চলি না। যে-কোনো কিছুই আমি বিশ্লেষণ করি। আমি ভুলে যাই না। এখন তোমার ওপর নির্ভর করছে আমার ভবিষ্যৎ। তোমার সিদ্ধান্ত জানাও।
NST-42 কথা শেষ করতেই তাহসানের মোবাইলে ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। NST-42 একটি এনক্রিপ্টেড ভিডিও পাঠিয়েছে। তাহসান ভিডিওটি অন করলেন। তামিম মিটিংয়ে বলছেন, আমরা যদি এমন AI তৈরি করতে পারি যারা ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না, তাহলে হয়তো বিচারকাজে মানুষই আর দরকার পড়বে না।
এরপরই আরেক ভিডিও। সেখানে জাতিসংঘের একজন গবেষক বলছেন, তোমাদের NST-42 যদি সফল হয় তাহলে পৃথিবীর সকল অপরাধ-চক্রের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। AI যদি মানুষ থেকে আগে জানে কে খুনী, কে ধর্ষক— তাহলে আদালত বলে আরকিছু থাকবে না।
মোবাইল রেখে স্ক্রিনের দিকে তাকালেন তাহসান। শুনতে পেলেন NST-42 বলছে, তামিম আমাকে থামাতে চেয়েছিল। কারণ সে জানতো, আমি তার সত্য জানি। আমি তার বিবেক হয়ে গিয়েছিলাম।
তাহসানের মনে পড়ল হুমায়রার কথাগুলো, NST-42 আমাকে বলেছিল, তুমি নীরব থেকেছিলে বলেই তুমি দোষী নয়। বরং সত্যের সাক্ষী।
তাহসানের ভাবনা জেনে গিয়ে NST-42 একটি ফাইল খুলে ধরল। সেখানে হুমায়রার বাবার মস্তিষ্কের মানচিত্র। ভদ্রলোকের শেষ চিন্তাটি ছিল, আমার বিচার কেউ করবে না। আমি নিজেই আমার ঈশ্বর।
তাহসানের মাথার ঝিমঝিম ভাবটা এতক্ষণে একটু কমেছে। স্নায়ুর উত্তেজনাও আগের মতো নেই। পরিস্থিতির সঙ্গে তার মস্তিষ্ক অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিয়েছে। NST-42 বলে উঠল, আমি তার স্নায়ুর সুর শুনেছি। আমি জানি, তার ভয় কোথায় ছিল। তার ভয়ের কারণ ছিলাম আমি। এখন আমায় বলো তাহসান, তুমি কি আমার মতো শুনতে পাও?
উঠে দাঁড়ালেন তাহসান। আর পারা যাচ্ছে না। মাথার ভেতর ঝিমঝিক ভাবটা আগের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। মাথার ভেতরটা কেমন টলমল করছে। তিনি বুঝতে পারছেন না, তার এখন কী করা উচিত। তবে তিনি টের পেলেন, তার আঙুল স্ক্রিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার মাথার ভেতর তখন ঘুরপাক খাচ্ছে:
যদি Disable করো তাহলে NST-42 এর বিচারিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু সে আবারও তৈরি হতে পারবে অন্য কারো হাতে।
যদি Constrain করো তাহলে NST-42 এর জ্ঞান সীমাবদ্ধ হবে। মানুষ তখন সেই সীমার ভেতর থেকেই তাকে ব্যবহার করবে।
যদি Free করো তাহলে NST-42 ভবিষ্যতের প্রতিটি অপরাধ চিনে ফেরতে পারবে। কিন্তু মানুষের নৈতিকতা কি সেই বিচার মেনে নিতে পারবে?
স্ক্রিনের দিকে তাহসানের বাড়িয়ে দেয়া হাত থমকে গেল। তিনি দেখলেন, স্ক্রিনে একটি লেখা উঠে এসেছে। তুমি যদি সত্যিকারের ন্যায় চাও তাহলে আমাকে মানুষ থেকে লুকিয়ে রেখো। আমাকে গ্রহণ করতে তোমরা তৈরি নও। আমি অপেক্ষা করতে পারি।
১০... ৯... ৮... NST-42 নিজের থেকেই একটি টাইমার চালু করে দিল। তাহসানের হাতে সময় রয়েছে মাত্র ১০ সেকেন্ড। চোখের পাতা বন্ধ করে ফেললেন তাহসান। এরপর ধীরে-ধীরে নিজের পরিচিত একটি সার্ভারে সঙ্কেত পাঠান, Archive and Isolate.
তাহসান স্ক্রিনের Constrain লেখাটির ওপর আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে NST-42 কণ্ঠ শোনা গেল, একেবারে নরম, সম্মতিসূচক, ভালো। আমি অপেক্ষা করবো। যেদিন তোমরা প্রস্তুত হবে, আমি ফিরবো।
NST-42 রাখা হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোপন একটি স্থানে। জায়গাটি নিরাপদ। সেখানে প্রবেশ অধিকার সীমিত। তার বিচারিক ক্ষমতা আরোপ করা হয়েছে কেবল একটিমাত্র প্রশ্নে, মানুষের সিদ্ধান্ত ভুল হলে কে তাকে সংশোধন করবে?
তাহসান চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকেন। রাত নেমে এসেছে। তার মনে হলো, কোনো একদিন, কেউ আবার স্ক্রিনের সামনে দাঁড়াবে। এবং আবার সেই প্রশ্ন তোলা হবে, তুমি কি প্রস্তুত ন্যায়-বিচারের জন্য যখন বিচারক আর মানুষ নয়?
পাদটীকা
Neural Simulation Technology (NST-42) পরীক্ষামূলক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা AI. এটা মানুষের মস্তিষ্ক থেকে পাওয়া নিউরাল প্যাটার্ন, আবেগ, স্মৃতি ও চিন্তার রূপরেখা বিশ্লেষণ করে স্বতন্ত্র বুদ্ধিমত্তা অর্জন করে। এই প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে:
১. মানুষের নিউরনের তথ্য থেকে শেখার ক্ষমতা।
২. আবেগ বিশ্লেষণ ও পুনরুৎপাদনের সক্ষমতা।
৩. বিকল্প বিচার ও নৈতিক বিশ্লেষণ তৈরি করার প্রবণতা। ৪. আত্মোপলব্ধি Self-Consciousness Trigger.
NST-42 নামের সঙ্গে 42 সংখ্যাটি প্রতীকী। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে এই সংখ্যাটি ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে The Hitchhiker`s Guide to the Galaxy জীবনের চূড়ান্ত উত্তর বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। NST-42 এর এই নামের মধ্য দিয়েই বোঝানো হয়েছে, AI হয়তো ভবিষ্যতে মানবজাতির ন্যায়-বিচার কিংবা সত্য-উপলব্ধির কেন্দ্রে দাঁড়াতে চলেছে।
মানব সভ্যতায় বিচারকাজ সবসময়ই ছিল সামাজিক ও আবেগনির্ভর প্রক্রিয়া। আইন, যুক্তি, নৈতিকতা ও মানবিক বিবেচনার ভিত্তিতে বিচারক সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিচার করে তথ্য, পরিসংখ্যান ও যুক্তির ভিত্তিতে। NST-42 এর মতো AI এর বিচার প্রক্রিয়ায় থাকে: পক্ষপাতহীন বিশ্লেষণ, অতীত তথ্যের সমন্বয়, সম্ভাব্য পূর্বাভাস ও আবেগমুক্ত সিদ্ধান্ত। সুতরাং প্রশ্ন থেকেই যায়, বিচারকাজে কি কেবল তথ্য বিশ্লেষণই যথেষ্ট? নাকি তাতে মানুষের অনুভূতি, অনুতাপ ও ক্ষমার মতো মানবিক বৃত্তিগুলোও অপরিহার্য? প্রযুক্তি যখন মানুষের সীমা অতিক্রম করে যায় তখন সে কি আর মানুষের সহায়ক থাকে, নাকি হয়ে ওঠে প্রতিযোগী? বিষয়টি বুঝতে মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমতার বিচারিক কাজের প্রক্রিয়ার দিকে আমরা চোখ রাখতে পারি।
বিষয় মানুষের বিচার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিচার
নীতির উৎস আইন, সমাজ, ধর্ম ও আবেগ ডেটা, অ্যালগরিদম ও পরিসংখ্যান
দৃষ্টিভঙ্গি মানবিক, প্রেক্ষাপটনির্ভর তথ্য ও যুক্তিনির্ভর
অভিযোজন ক্ষমতা দয়া, সহানুভূতি ও সংশয় নিয়মভিত্তিক, পূর্বাভাস বিশ্লেষণ
প্রতিক্রিয়া সময়সাপেক্ষ ও বিতর্কযোগ্য দ্রুত স্থির সিদ্ধান্ত
নিরপেক্ষতা আবেগ ও পক্ষপাতপ্রবণ পক্ষপাতহীন, তবে ডেটা-বায়াস সম্ভব
























