উনিশতম অশ্বারোহী

পর্ব ২

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৮

প্রশ্ন হল, এই যে ক্ষমতা তা আসে কোথা থেকে? যে গোষ্ঠী শাসন করে, তারাই ক্ষমতার উৎসসূত্র। ক্ষমতা দখলের জন্য ভোটাভুটির নামে কতো খুনোখুনি হয় তা আমরা প্রতিটি নির্বাচনে দেখি । যারা ক্ষমতা দখল করে তারাই শাসক। শাসকের মূল্যবোধ চেপে বসে সমাজের সর্বত্র। বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাকাডেমি-প্রশাসন-রাজকোষ তাদের মূল্যবোধকে এবং মূল্যবোধপ্রসূত অনুশাসনকে, মানদণ্ডকে, ক্যাননকে, মাপকাঠিকে, নানন্দনিকতাকে প্রতিষ্ঠা দান করে। এই ক্ষমতাকেন্দ্রটিই প্রতিষ্ঠান। রাজকোষ যাদের, উৎপাদনক্রিয়ার মালিকানা এবং ভোগের সুযোগ তাদের। সমঝোতার বুদ্ধিবৃত্তি আকৃষ্ট হয় সেইদিকেই। কিন্তু শাসকবর্গের মধ্যে নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তাদের আধিপত্য প্রয়োগ করে ক্ষমতাকেন্দ্রটি নিজেদের দখলে রাখতে চায়, যার ফলে বিকল্পের সম্ভাবনা দেখা দেয়। বিকল্পগুলোর অবিরাম টানাপোড়েন চলতে থাকে। সাংস্কৃতিক বিকল্পের যাতে উদ্ভব না হয়, বা হলেও তাকে দাবিয়ে দেয়া যায়, তাই রাষ্ট্রকাঠামো নিজেকে নাৎসি, ফ্যাসিবাদী, সাম্যবাদী, হিন্দুত্ববাদী, বৌদ্ধ বা ইসলামি, অথবা যে-কোনও ভিত্তিবাদী দর্শন ঘোষণা করতে পারে, এবং করেও, যেমন সাম্প্রতিক কালের চীন। পাকিস্তানের কথাও বলা চলে, যেদেশে শিয়া, বোহরা, আহমদিয়া, ফকির, সুফি ইত্যাদিকে ধ্বংস করার প্রয়াস চলে, যদিও তারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এইসব ক্ষেত্রে মূল্যবোধটির মাল-মশলা আগে থাকতে তৈরি পাওয়া যায়। নৈতিক এবং বৌদ্ধিক উৎকর্ষের প্রতিষ্ঠা বিভিন্ন উপায়ে করার চেষ্টা করে শাসকগোষ্ঠী, বা আধিপত্যের কর্তৃত্বধারী ব্যক্তিগণ। উৎকর্ষের সংজ্ঞা তাদেরই বানানো । সংজ্ঞাটির বাইরের ব্যক্তিকে তখন বাধ্যহয়ে বিরোধী ভাবধর্ম ও শৈলী থেকে সূত্র আহরণ করতে হয়। এর দরুণ সংস্কৃতি বিশেষটির চেহারায় ফুটে ওঠে বহুত্বের আভাস, আর ক্ষমতায় চোট লাগার ভয়ে, সে-সমস্ত বিরোধিতাকে নাকচ করার প্রয়াস হয়।

আইডিওলজি ব্যাপারটা তো কোনও বিমূর্ত, ওপর থেকে চাপানো প্রত্যয়ের বিন্যাস নয়। আর আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুমানসমূহ এবং ভাবনা ও অভ্যাস কেবল অন্যের দ্বারা কলকাঠি নাড়ার ফলাফল নয়। কিংবা তা প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ নয়, যে, যখন ইচ্ছে থামিয়ে দেয়া চলে বা গুটিয়ে নেওয়া যায়। তা যদি হতো তাহলে সংস্কৃতিকে যেদিকে যেমন ইচ্ছে চালনা করা যেতো। ইরানের শাহ শত চেষ্টা করেও নিজের ইচ্ছেমতন চেহারা দিতে পারেননি সেদেশের সংস্কৃতিকে। আবার খোমেইনিও সফল হননি। সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত চাপের দরুণ পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেল। সোভিয়েত দেশও ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল এবং টুকরোগুলো নিজের সংস্কৃতিতে ফিরে গেল। যোগোস্লাভিয়া ছিৎরে গেল। অথচ চাপিয়ে দেয়া নান্দনিকতার রেশ থেকে সংস্কৃতিটির বিশুদ্ধ মুক্তি বেশ কঠিন, বলা যায় অসম্ভব— পদাবলী বা মঙ্গলকাব্যে আর ফেরা যায় না। পক্ষান্তরে, তৃণমূল স্তরে প্রতিরোধগুলো যতদিন টিকে থাকে ততদিন সংঘর্ষ চালিয়ে যায় ।

নিচুতলাটিকে তাঁবেদারির কাছে আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াটি হল হিগেমনি। এই হিগেমনি শব্দটি কিছু বিদ্যায়তনিক মহলে উচ্চারিত হয় ‘হেজিমনি’, কেননা আমেরিকানরা বলে হেজিমনি, আর বর্তমান দুনিয়া জুড়ে আধিপত্য তো আমেরিকার । শব্দার্থ যার মুলুক তার। অবশ্য প্রান্তিক ইংরেজিভাষী দেশগুলো যে পপতিরোধ তুলেছে, তা থেকে উদ্ভূত হয়েছে গ্লোবাল ইংলিশ, যে ইংরেজির মালিকানা কারোর একচেটিয়া নয়। হিগেমনি একটা লাগাতার সংঘর্ষের প্রক্রিয়া যা চলতেই থাকে। চলতেই থাকবে। যারা ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে, তারা অধস্তন, তারা নিচুতলার, তারা নিম্নবর্গের। নিচুতলা মানেই দারিদ্র্য নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের তুলনায় সংখ্যালঘু থাকবে নিচুতলায়, বাংলাদেশে হিন্দুরা আর ভারতে মুসলমানরা নিচুতলার, উঁচু জাতের তুলনায় দলিতরা থাকবে নিচুতলায়, শাসকদলের ট্রেড ইউনিয়ানের সামনে বিরোধিদলের ট্রেড ইউনিয়ান হতে পারে নিচুতলার, পুলিশ প্রশাসনের আশ্রিত গুণ্ডা-মাস্তানের তুলনায় স্বনির্ভর গুণ্ডা। মাস্তান হতে পারে নিচুতলার। ব্রাহ্মসমাজের মূল্যবোধ যদি সমাজটিতে ছেয়ে থাকে তবে ব্রাহ্ম কবি হবেন উঁচুতলার, বামপন্হী শাসকের রাজত্বে বামপন্হী লেখক-কবিরা উঁচুতলার এবং শাসকের পুরস্কারগুলো তাঁদেরই প্রাপ্য। সমাজটি উর্দুভাষীর কিংবা হিন্দিভাষীর নিয়ন্ত্রণে থাকলে তাদের ভাবুকরা অন্য ভাষাভাষীর তুলনায় হবে ওপরতলার। একটি সমাজব্যবস্থার যেমন-যেমন ব্যতিহার্য অনুমোদনের আচরণ গড়ে ওঠে, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জন্মায় অর্থবোধকতা এবং মূল্যমানের বিন্যাস। ফলে এককালের ভালো পরবর্তীকালে তেমনকিছু আহামরি মনে হয় না। ও যে মানে আর মূল্যায়ন, সেটাই কিন্তু সমাজের বেশির ভাগ লোকের কাছে বাস্তবতা। ক্ষমতাকেন্দ্রটি যদি ঘোষণা করে শতফুল বিকশিত হোক, তাহলে তার বাইরে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ হবে যে একরকম ফুলের নাম বুঝি শতফুল।

ক্ষমতাকাঠামো সম্পর্কে প্রাগুক্ত বক্তব্যের সমর্থনে একটি ছোট উদাহরণ দেয়া যাক। ইকবাল ও নজরুল দুজনেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইকবাল প্রদত্ত ভাবকল্প থেকে পাকিস্তান তত্ত্বের জন্ম। তিনি কবি অথচ সাম্প্রদায়িক। তিনি রুটমার্চের গান লেখেননি। অথচ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে তাঁর লেখা গান (সারে জহাঁ সে অচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা) নেয়া হয়েছে। সেতারবাদক রবিশঙ্কর তাতে সুর দিয়ে কুচকাওয়াজের উপযোগী করে তুলেছেন। নজরুলের বহু গান আছে রুটমার্চের, এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে তা উৎসাহ-উদ্দীপনার জন্য ব্যবহৃত। নজরুল পাকিস্তান চাননি। ধর্মান্তরিত অন্ত্যজ হিন্দু পরিবার তাঁর অতীত নয়। তিনি ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার তুমুল বিরোধী। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে তাঁর গান নেওয়া হয়নি (বাংলাদেশে নেওয়া হয়েছে কিনা জানি না)। পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর কোনও গানের সঙ্গে সম্পর্কে গড়ে তোলেননি। সম্ভবত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কর্তারা তাঁর নামই শোনেননি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-উত্তর ক্ষমতাকাঠামোটিতে সুভাষচন্দ্র বসুর হাত থাকলে, ব্যাপারটা হয়তো অমন হতো না। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পরেই, যে নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক নীতিমূল্য দিল্লির মসনদ থেকে স্ফূরিত হয়েছিল, তাতে সুভাষচন্দ্র বসু ও কাজী নজরুল ইসলাম, উভয়েই পর্যবসিত হয়েছিলেন নিচুতলায়। তাছাড়া বাংলা, যে ভাষাটিতে গান লিখেছিলেন নজরুল, সেটি ভারতের মসনদ দখলকারীদের ভাষা নয়। দেশভাগের পর পূর্বপাকিস্তানের, অর্থাৎ বাঙালিদের, মসনদের ভাষা বেশ কিছুকাল ছিল উর্দু। হিগেমনিটির বিরুদ্ধে তাঁদের সংশস্ত্র সংগ্রাম করে মসনদে বাংলা ভাষাকে বসাতে হয়েছে।

ভারতবর্ষে, শিক্ষিত বাঙালি বালক-বালিকারা, ‘সারে জহাঁসে অচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হমারা’ গানটির সঙ্গে যতোটা পরিচিত, ততোটা নন ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’-এর সঙ্গে, যদিও প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টিতে ভাষা, শব্দবিন্যাস ও ধ্বনিক্রীড়ার আধিক্য নজরুলকে প্রথম থেকেই বিতর্কিত করেছিল, কেননা তাঁর অহং-পাত্রটিকে সংজ্ঞায়িত করা তাঁর নিজের পক্ষেও (বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার ও লেটোর দলের ঢোলক-বাজিয়ের শৃঙ্খলায় গঠিত) কঠিন ছিল। জীবনযাপনের উচ্ছৃঙ্খলতার ভারসাম্য গড়ে তুলতে ঢোলবাদক ও কুচকাওয়াজকারীর শৃঙ্খলাবোধ কাজ করে থাকবে যা পরবর্তীকালে গানের বিমূর্ত নান্দনিকতায় হয়ে গিয়ে থাকবে জটিল। রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে তাঁর ফোটোগুলো আচার্য-সুলভ পোজ দিয়ে তোলাচ্ছিলেন, সেসময়ে নজরুল কমনীয় কবি-কবি পোজ দিচ্ছিলেন, এই জন্যে যে, বঙ্গসমাজে ঢোলবাদক ও হাবিলদার নিচুতলার। বস্তুত নিচুতলার তকমা দিয়ে সমগ্র বেঙ্গল রেজিমেন্টকেই ভেঙে ফেলা হয়েছিল, যদিও অন্যান্য রাজ্যের নামে রয়েছে বিভিন্ন রেজিমেন্ট। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের দরুন কবো ও গায়কের তুলনায় একজন সাধারণ মানুষকে নিকৃষ্ট মনে করার চল আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। তদানীন্তন সাহিত্য আলোচকদের নজরুল-বিরোধী উপপাদ্য ছিল যে, তাঁর পদ্যের ধ্বনিক্রীড়াটি শহুরে বাঙালি অভিজাত সমাজকে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিব্রত করে। লক্ষণীয় যে তদানীন্তন কলকাতাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ক্ষমতাকেন্দ্রটি অভিজাতবর্গের কুক্ষিগত থাকার দরুন, বাঙালির কোনও নিজস্ব নাচ গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি, যেভাবে অন্যান্য ভাষাভাষীদের ভাঙড়া, বিহু, লাওনি, কুচিপুড়ি, কথ্থক, ওড়িসি, কথাকলি, গরবা, ডাণ্ডিয়া ইত্যাদি নাচগুলো, সেই ভাষাভাষী নারী-পুরুষকে  শ্রেণি নির্বিশেষে দৈহিক বিভাস দিয়েছে। বাঙালি সমাজের ছৌ, সাঁওতাল এবং রায়বেঁশে উপেক্ষিত থেকেছে খালি গায়ে ছোটলোকদের নাচ হিসাবে, এবং দেশভাগের পর এই তিনটি নাচকে পর্যটক আকর্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়।

নাচ ব্যাপারটি ধ্বনিক্রীড়াকে শরীরের মাধ্যমে রূপায়িত করে। বাঙালি জমিদারবাবুরা নাচের জন্য বঙ্গসংস্কৃতির আওতার বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে নর্তকীদের আমদানি করে ধ্বনিক্রীড়ার আশ মেটাতেন। এখনও নৃত্য বঙ্গসমাজে তুলনামূলকভাবে অপাঙক্তেয়, শরীরকে ধ্বনিক্রীড়ার কাছে সোপর্দ করতে হবে বলে। নৃত্যানুষ্ঠান নামের ব্যাপারগুলো ঘটে শহরের মঞ্চে, মধ্যবিত্তের খোরাকের জন্য। পুরুষের নাচ তো আজও প্রায় নিষিদ্ধ বলা চলে। নাচের গুরুত্ব না থাকায়, উচ্চবিত্তের অধিকাংশ বাঙালির শরীর মেদবহুল এবং শরীরের ফর্ম বীভৎস। উনিশ শতক ও বিশ শতকের শুরুতে নাটকে নারীচরিত্রে অভিনয়ের জন্য সমাজ বাধ্য হয়ে মঞ্চে এনেছিল বারবনিতাদের। বস্তুত সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিগুলোকে নিচুতলার হাত থেকে কেড়ে নেয়ার পরই সেগুলোকে শিল্পের খেতাব দেয়া আরম্ভ হয়। কারণ ওই হিগেমনি। শিল্প নামক তথাকথিত ব্যাপারটির মালিকানা উচ্চবর্গের, কেননা কাকে শিল্প নামে অভিহিত করা হবে তার একচেটিয়া জ্ঞান তো তাদের। এই জ্ঞান এনেছিল সাম্রাজ্যবাদীরা। উপনিবেশগুলোয় শিল্প নামের ভাবকল্প তারাই জাহাজে চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

কাজী নজরুল ইসলামের কাজকে শিল্প নামে অভিহিত করা হবে কিনা, তা তাঁর আবির্ভাব থেকেই তর্কের প্রসঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছিল, এবং সে সংশয় আজও মধ্যবিত্ত-নিয়ন্ত্রিত বিদ্যায়তনিক মহলে বজায় আছে, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্হীদের সাড়ে তিন দশকের মৌরসিপাট্টা সত্বেও যায়নি। যদিও ইতোমধ্যে সমাজ তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় নাপিত, ছুতোর, দর্জি, স্যাকরা, পেইনটারের দোকানে দোকানে আর্ট বা শিল্পের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। তাঁরা বাধ্য হয়েছেন আর্ট বা শিল্পের ভাবকল্পকে এভাবে আক্রমণ করতে, কেননা বাজারচালু মূল্যবোধ অনুযায়ী শিল্প হল ওপরতলার কিন্তু লোকসংস্কৃতি নিচুতলার। আসলে বাঙালির মূল সংস্কৃতির নামে গত দেড়-দুশো বছরে যা চালানো হয়েছে, তা হল শিক্ষিত ও হাফলিটারেট মধ্যবিত্তের কাজ-কারবার, যা সমগ্র বাঙালিসমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। কাজ-কারবারটি গড়ে উঠেছে আধুনিকতার তাগিদ, জাতয়তাবাদ আর ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে। নজরুলের ক্ষেত্রে বক্তব্যটির প্রাসঙ্গিকতা আমরা পরে আলোচনা করব।

১৯২৭ সালে ইব্রাহিম খাঁকে লেখা চিঠিতে নজরুল এই সংশয়টির মোকাবিলা করেছিলেন এইভাবে, প্রাতিস্বিক স্তরে: “আমি আর্টের সুনিশ্চিত সংজ্ঞা জানিনে, জানলেও মানিনে। এই সৃষ্টি করলে আর্টের মহিমা অক্ষুন্ন থাকে, এই সৃষ্টি করলে আর্ট ঠুঁটো হয়ে পড়ে, এমনিতরো কতকগুলি বাঁধা নিয়মের বলগা কষে-কষে আর্টের চরম সুন্দর নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ হলো— একথা মানতে আর্টিস্টের হয়তো কষ্টই হয়, পরান হাঁপিয়ে ওঠে। জানি, ক্লাসিকের কেশো রুগিরা এতে উঠবেন হাড়ে-হাড়ে চটে, তাঁদের কলম হয়ে উঠবে বাঁশ। এর মধ্যে হয়েও উঠেছে তাই । তবু আজ একথা জোর গলায় বলতে হবে নবীনপন্হীদের। এই সমালোচকদের নিষেধের বেড়া যাঁরাই ডিঙিয়েছেন, তাঁদেরই এঁদের গোদা পায়ের লাথি খেতে হয়েছে, প্রথম শ্রেণি হতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে নেমে যেতে হয়েছে।… আমার হয়েছে সাপের ছোঁচো গেলা অবস্থা। ‘সর্বহারা’ লিখলে বলে কাব্য হল না, ‘দোলনচাঁপা’, ‘ছায়ানট’ লিখলে বলে ও হল ন্যাকামি! ও নিরর্থক শব্দঝংকার দিয়ে লাভ হবে কী? ও না শিখলে কার কী ক্ষতি হত?”

চলবে