উনিশতম অশ্বারোহী

পর্ব ৩

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৮

নজরুলের ক্ষোভ থেকে টের পাওয়া যায়, বহুকাল সাম্যবাদী নেতা মুজফফর আহমেদের সংস্পর্শে থাকলেও, ‘কবি’, ‘আর্টিস্ট’ ইত্যাদি নতুন গড়ে ওঠা এবং সাম্রাজ্যবাদ-উদ্ভূত তকমার আগ্রহ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি তিনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আরও নানা তকমা এনেছিল যা সনাতন ভারতীয় অথবা ইসলামি চিন্তায় ছিল না, যেমন ‘প্রতিভা’, ‘মাস্টারপিস’ ইত্যাদি।

দুই.
মানবেতিহাস প্রকৃতপক্ষে লাগাতার সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বহুমুখী ইতিহাস। তা সিংহাসনে রাজা-রানি বদলের গল্প নয়। ইতিহাসকে রাজা-রানি বদলের গল্পতে সীমিত রাখলে তা কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রের ছত্রপতিদের কেচ্ছা নিয়ে মেতে থাকে। অবহেলিত থেকে যায় বিস্তীর্ণ ভূগোলের জনমানব। ঔপনিবেশিকতা আসার আগে বাঙালির বিশাল ভূগোলের অজস্র ঘটনা-এলাকা ছিল, এবং সেসব স্থানের নিজস্ব সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার নাট্যস্ফূরণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গৌড়, রাঢ়, বঙ্গ, বরেন্দ্র, পুণ্ড্রবর্ধন ইত্যাদি এলাকার সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতি একে আরেকের থেকে পৃথক ছিল বলে অনুমান করা যায়; স্থাপত্য ও হাতের কাজ থেকে তেমনটাই মনে হয়। জনসমাজের প্রতিটি বর্গের জীবনকাহিনি ছিল আলাদা। শিক্ষাকেন্দ্রগুলো, যেমন ভাসুবিহার, জগদ্দল বিহার, বিক্রমপুরী বিহার, পণ্ডিত বিহার, কণকস্তূপ বিহার, দেবীকোট বিহার, সোমপুর বিহার ছিল বাঙালির ভূগোলের নানা এলাকার স্থানিক বৈভিন্ন্যে ছড়িয়ে। ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে বিপুল ও গভীর রদবদল সূচিত হয়। সাংস্কৃতিক নকশা এবং সামাজিক কাঠামোটিকে ছিৎরে দেবার মাধ্যমে বহিরাগত সমাজটি তার কর্তৃত্ব কায়েম রাখে। কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য সমাজের সাংস্কৃতিক নকশা পালটানো যায় না। পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, বিকাশ, পরিব্যপ্তি ও সংঘর্ষ দেখা যায় তা সাম্রাজ্যবাদী কত্তাত্তির কারণে। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবদী অধিপতি-সমাজটি ফেরত যাবার পর উপনিবেশের মননবিশ্বে নিজের এমন সমস্ত ছাপ ছেড়ে যায় যা আর কখনও সম্পূর্ণ মুছে ফেলা যাবে না। অথচ কর্তার সংস্কৃতি থেকে যায় উৎকৃষ্ট চেহারায়, এবং বাঙালির আদি ও সনাতন সংস্কৃতি নিকৃষ্ট চেহারায়। ক্ষমতার চরিত্রই অমন। এর কোনো স্বকীয় নান্দনিক যুক্তি নেই। ফলে মর্সিয়ার চেয়ে এলেজি হয়ে ওঠে উৎকৃষ্ট, যাত্রাপালার চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রতীয়মান হয় প্রসেনিয়াম থিয়েটারকে, লেটোর গানের চেয়ে রক অ্যান রোলকে, পয়ারের চেয়ে স্প্রিং রিদমকে, অগুরুর চেয়ে ইন্টিমেটকে, এবং নিদারুণ গ্রীষ্মেও জুতোমোজা পরে চাকরি করতে যায় লোকে, লোডশেডিং আক্রান্ত দপতরে।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের গ্রেকোরোমান অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বটি যেহেতু প্রজ্ঞাকে কৌম-নিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষ্ণ মনে করত, সেহেতু সমাজের সুফলকে আত্মসাৎ করে সৃজন-কর্মকে ব্যক্তি মালিকানাধীন মেধাজাত পণ্যে পর্যবসিত করা হয়েছে। লোকসংস্কৃতির কাজগুলো তো সৃষ্টিকারী ব্যক্তি-মালিকের নয়। তা স্বতঃস্ফূর্ত যৌথতার অভিব্যক্তি। অথচ ব্যক্তিপ্রজ্ঞার কাজ না হলে সে-কাজের মৌলিক  হবার সম্ভাবনা নেই। ‘মৌলিক’ নামের ভাবকল্পটিও ইউরোপের। অধিপতির অনুমোদন ছাড়া কোনও কাজ ‘মৌলিক’ তকমা পায় না, কেননা মানদণ্ড, অনুশাসন, ক্যানন তৈরি করার অধিকার কেবল কর্তার, মসনদের। উপনিবেশগুলোর স্থানিক সংস্কৃতির ওপর ইউরোপ থেকে আমদানি-করা সংস্কৃতি চাপানোর ফলেই চাটগাঁর বাঙাল, পাকিস্তানের বালুচ, আমেরিকার নাভাহো, অস্ট্রেলিয়ার মাওরি, আফ্রিকার জুলু, চিলির উপজাতি সবাই একইরকম লিরিক, এলেজি, সনেট, তের্জারিমা, ভিলানেল লিখে আহ্লাদে আটখানা হয়েছেন।

পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, ফরাসি উপনিবেশবাদীরা যখন বাংলা ভূখণ্ডে এসে ভিড়েছিল, তখন তাদের উদ্দেশ্য কেবল রোজগার করা আর আর স্বদেশে লভ্যাংশ পাঠানোয় সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত যে, তারা আদিম কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশের লোকগুলোকে (ফ্রেডরিক হেগেল যাদের মনে করতেন ‘বর্বর’) সুসভ্য এবং সংস্কৃতিবান করতে এসেছে। তাই তাদের নিজেদের বিশ্বাস, ধর্ম, আচার-আচরণ, রুচি তারা সুপরিকল্পিতভাবে, এবং শুরুতে অসহ্য জোরজুলুমসহ, চাপিয়ে দিয়েছিল শাসিত সমাজটির ওপর। শাসক যাকে সমর্থন করেছে তাকে উৎকৃষ্ট বলে গ্রহণ করেছে উপনিবেশের লোকেরা। তাদের ভাষায় তারা যে সমস্ত ব্যাপারকে ভালো বলে মনে করেছে, সে সমস্ত তারা চারিয়ে দিয়েছে শাসিতের ভাষায়। বস্তুত ব্রিটিশরা এসে গদিতে জমিয়ে বসার কিছুকাল পরেই আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্র লোপাট হয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদের জাহাজ সুতানুটি-গোবিন্দপুরে নোঙর না ফেললে, স্বদেশের নিজস্ব অনুশাসন ও অলঙ্কারশাস্ত্র প্রয়োগ করে উপনিবেশের লোকেরা নিজেদের সাংস্কৃতিক উত্তরণের মূল্যবোধ নির্ধারণ বহুলাংশে বজায় রাখতে পারত। কিন্তু নবাগত ইউরোপীয় হস্তক্ষেপে তাদের চাপিয়ে দেয়া কাজগুলো হয়ে গেল ‘সংস্কৃতি’ এবং ভূমিপুত্রদের নিজস্ব কাজগুলো হয়ে গেল ‘কৃষ্টি’। তাদের সরবরাহ করা নান্দনিকতার নকল করলে তা হল ‘আর্ট’, কিন্তু বাঙালির ভূমিজ নান্দনিকতা রূপায়িত হলে তাকে বলা হল ‘ক্র্যাফ্ট’। কেননা সংস্কৃতি এবং আর্টের তুলনায় কৃষ্টো ও ক্র্যাফ্ট নিকৃষ্ট। ইংরেজরা যেহেতু সমাজের মানদণ্ড নির্ধারণের মালিক, এবং আর্ট ও সংস্কৃতি উৎপাদনের নেতৃত্বটি তাদের, অতএব বাঙালি সমাজের যে অংশটি তাদের ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত, সেই অংশের লোকগুলোর কাজই আর্ট ও কালচার দাবি করার যোগ্যতা পেল। আর ইংরেজদের সংস্কৃতির কাছাকাছি থাকার জন্য জরুরি হল কলকাতায় থাকা, এবং সামর্থ থাকলে বিলেতে গিয়ে থাকা, অন্তত কিছুদিনের জন্যে। বাইরে যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল, সেখানের বাঙালিদের কাজগুলো হয়ে গেল অপাঙক্তেয়। আর্থিক মানদণ্ডের পরিবর্তে, সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে নির্ধারণ করা হল কারা ছোটলোক, নির্ধারণ হল ভদ্র ও অভদ্র, সভ্য ও অসভ্য, সুরুচি ও কুরুচি, বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধ, সংস্কৃতিবান ও ‘আনকালচার্ড’-এর সীমা।

ঔপনিবেশিক আমলের গোড়াপত্তন থেকেই, বাঙালির সংস্কৃতিতে, পাশ্চাত্য নান্দনিকতার জ্ঞান ব্যতীত, স্বীকৃতি পাওয়া, উনিশ শতকে ও বিশ শতকের প্রথম দিকে প্রায়-অসম্ভব তো ছিলই, এখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে গেছে। স্বদেশি নন্দন-অনুশাসনের কাঠামো গ্রহণ করলেও, তাতে পাশ্চাত্য নান্দনিকতার মিশেল ছাড়া কোনও কাজকে ‘আর্ট’ হিসাবে মেনে নেয়া যাবে না। আসলে সাম্রাজ্যবাদ হল ভূমিপুত্রের স্মৃতিবিপর্যয়। ভূমিপুত্রের ইতিহাসকে বেমালুম লোপাট করে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল ইউরোপীয় মননবিশ্বটি। জেমস লঙ ভারতচচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’কে বলেছিলেন ইতে ও অশোভন, এবং বাঙালির উচিত চসার-মিলটন পড়া। দেড়শো বছর যাবত তাইই করছে বাঙালি, এবং ভারতচন্দ্রকে ভুলে গেছে। প্রচলিত পাঁচালিগুলোকে জেমস লঙ বলেছিলেন নোংরা, লালসা উদ্রেককারী, মোটাদাগের কাজ। তারপর থেকেই অভিজাত বাঙালির পারিবারিক ধর্মকর্ম থেকে বিদেয় করা হল পাঁচালিগুলোকে। আজ সেগুলো নিম্নবর্গের নগণ্য পরিবারে কোনও রকমে টিকে আছে। বাঙালি বিদ্ব্যজ্জনদের মাথার ওপরে চেপে বসে গেছে ভিকটোরীয় আমলের ঔপনিবেশিক হাউসকোট।

ইংরেজরা আসার আগে, ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাবে, বাঙালির জীবনে সনাতন ভারতীয় সভ্যতা একটি নবতর দার্শনিক আধেয় গ্রহণ করেছিল, যার দরুন উন্মেষ ঘটে একটি লৌকিক বাঙালি সংস্কৃতির। সারা বাংলা জুড়ে, গড়ে ওঠে স্থানিক ছোট-ছোট ইতিহাস, যা, অভিজাত মুসলমান সমাজের বাইরে জন্ম দিয়েছিল ধর্ম, আচার-আচরণ, সাহিত্য, সঙ্গীতের তৃণমূল কৌমসংস্কৃতি। তুর্কি, আফগান, মোগল, ইরানি, বাগদাদিরা সেই অর্থে কোনও ব্যক্তি-প্রজ্ঞাবাদী মননবিশ্ব আনেনি, যেমনটা এনেছিল ইউরোপীয়রা। তাঁদের ব্যক্তিনির্মাণ প্রকল্পটি ছিল সম্পূর্ণ ধর্মনির্ভর। কাজী নজরুল ইসলামের উন্মেষ ঘটেছিল এই খাঁটি বাঙালি কৌমদর্শনের পৃষ্ঠভূমিতে। সম্ভবত তিনিই তার শেষ প্রতিভূ। ওই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাইরে নজরুলের মূল্যায়ন যে কেবল ভুল, তাইই নয়, তা অসম্ভব। ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে এই ধরণের ভূমিজ মনীষার উদ্ভব বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে সমাজচিন্তনের প্রকাশরূপে: থিরু ভাল্লুভার, মীরাবাই, তুকারাম, কবিরদাস, লালন প্রমুখ।

১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ থেকে শিক্ষার বাহনরূপে ইংরেজি, এবং ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, বাঙালির জীবনে একটা স্ট্যাণ্ডার্ড সংস্কৃতির সুযোগ তৈরি করে দিতে পেরেছিল, যা তার লৌকিক সংস্কৃতি থেকে মধ্য ও উচ্চবর্গকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন-বিযুক্ত করে দিলো। ইয়ং বেঙ্গল এবং অন্যান্য সম্প্রদায় আবির্ভূত হলেন, বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রধানত নিম্নবর্গের, সংস্কৃতির বিপরীতে। ইংরেজদের সংস্কৃতিকে মান্যতা দেয়া এবং গ্রহণ করে নেয়াটা শিক্ষিত ও সবর্ণ বাঙালির বৈধতা পেল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ‘অনুকরণ’ নামের প্রবন্ধে। ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “পশ্চিম আজ খুলিয়াছে দ্বার/সেথা হতে সবে আনে উপহার/দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে— এই ভারতের মহামানবের/সাগরতীরে”। এই বিরাট মিলনযজ্ঞের উচ্চবর্গের হোতারা খেয়াল করলেন না যে, কলকাতা সাংস্কৃতিক ক্ষমতাকেন্দ্রের বাইরে অজস্র ছোট ছোট লৌকিক সংস্কৃতির গ্রামীণ ও নিম্নবর্গ মানবনদী ইতোমধ্যে শুকিয়ে যাচ্ছে। তাদের সজীবতা ও উৎকর্ষের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে পড়েনি কারোর। ক্রমাগত অবহেলিত থাকার পর তা কালক্রমে তামাদি হয়ে গেল। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির আদি সংস্কৃতিটি নিকৃষ্টতার তকমায় ভূষিত হল। ইউরোপের অনুকারকরাই ছিলেন বঙ্গসংস্কৃতির নিয়ন্তা। অনেকে নিজের নামপদবিরও ইংরেজিকরণ করে ফেলেছিলেন। ইসলামের একেশ্বরবাদের চাপ ছিল না অভিজাত হিন্দু সমাজে, যদিও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের চাপ ছিল অবহেলিত নিম্নবর্গের ওপর। কিন্তু ইউরোপীয়দের প্রভাবে ব্রাহ্মসমাজের প্রয়োজন অনুভূত হল, আইনের ঘোষণার মাধ্যমে জানিয়ে দিতে হল যে ব্রাহ্মরা হিন্দু নয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, ইউরোপীয়দের নকল করা কাজগুলোকে বলা হতে লাগল ‘ভালো’, এবং বাঙালির সনাতন কাজগুলোকে বলা হতে লাগল ‘খারাপ’। এরকম পরিমণ্ডল সত্ত্বেও, ইংরেজি কবিতার কোলাবোরেটর হিসাবে নতুন উরনের যে বাংলা কবিতার উন্মেষ ঘটছিল, নেটিভ লোকসত্তার কারণে সেই দলে ভিড়তে পারেননি কাজী নজরুল ইসলাম। বহিরাগত রাজা কণ্ঠস্বরের ফর্মের পরিবর্তে নিজের চারপাশের সাধারণ জনগণের কণ্ঠস্বরের ফর্ম তাঁর শ্রেয় মনে হয়েছিল।

চলবে