উনিশতম অশ্বারোহী

পর্ব ৫

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৮

তিন
তাঁর কবিতা ও গানের রচয়িতা-অহংটি আদপে কে এবং কী, এই দার্শনিক সংকটটি নজরুলের সময়কাল থেকে হয়ে উঠেছে জটিলতর। মোহিতলাল মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ বিদ্বজ্জনেরা কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যপ্রতিষ্ঠার মূল্যায়ন সম্পর্কে দোনামনা করেছেন, একটা কিন্তু-কিন্তু ভাব দেখিয়েছেন। মূল কারণটি হল, বাংলা ভাষাসাহিত্য তখন ইউরোপীয় আধুনিকতায় আক্রান্ত হয়েছে। পরিশীলিত শিল্পবোধের ধুয়ো তুলে, যা ছিল পপধানত হেলেনিক (হেগেল ভাবতেন যে শিল্প বলতে যা বোঝায় তা কেবল প্রাচীন গ্রিসেই জন্মেছে), বাদ দেয়া হয়েছে আদি ভূমিজ বাঙালির ডিসকোর্স, যে বাঙালিদের ইংরেজরা নেটিভ হিসাবে চি্হ্ণিত করেছিল। সে-সময়ে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজানো আরম্ভ করেছিল আধুনিকতার কাড়া-নাকাড়া, যেন ইউরোপীয় আধুনিকতাই সত্য, বাদবাকি সব মিথ্যা। অমন একটা ধারণার রমরমায় নজরুলকে যে কোথায় খাপ খাওয়ানো হবে, তা একটি জ্ঞানতাত্বিক সমস্যা হয়ে উঠেছিল বাঙালি সাহিত্য আলোচকদের কাছে, কেননা তাঁকে প্রাগাধুনিক  বা আধুনিক কোনো বর্গীকরণেই ফেলা যাচ্ছিল না। কল্লোলের নীল নকশা নজরুল অগ্রাহ্য করেছিলেন, আবার সেই সময়ের প্রথাবাহিত কবিতা ও গানের ঐতিহ্যকেও করেছিলেন অস্বীকার। তিনি জানতেন যে তিনি একজন দ্রোহী, কিন্তু সেই দ্রোহটিকে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চালিত করেননি, যেমনটা ইউরোপে সাহিত্য ও ছবি আঁকার নানা আন্দোলনে ঘটতে দেখা গেছে। দ্রোহ ব্যাপারটাই তাঁর চেতনায় একটা ‘ঘোর’ তৈরি করেছিল, আর সেই আত্মসত্তাটিতে মগ্ন থাকার উৎসারণ ঘটেছে বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা, ধূমকেতু, লাল সালাম, সর্বহারা ইত্যাদি দ্যোতকে। দ্যোতকগুলো আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর চিত্তবৃত্তিতে যেহেতু লোকরঞ্জনের ক্ষমতা ও দক্ষতা ছিল, সেগুলো পড়ে গেছে উচ্চবর্গের সংস্কৃতি ও জনপ্রিয় সংস্কৃতির টানাপোড়েনের ফাঁদে।

বঙ্গসংস্কৃতিতে পপুলার কালচারের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার আরম্ভ হয় বিশ শতকের ছয়ের দশক থেকে। কবিতার গ্রামোফোন রেকর্ড, কবিতার অডিও ক্যাসেট, মঞ্চসফল কাব্যপাঠ, পেশাদার আবৃত্তিকার, কবিতাপাঠের সঙ্গে সঙ্গীতযন্ত্র ইত্যাদি লোকরঞ্জনী প্রক্রিয়ার সুদূরপপসারী সূত্রপাত ঘটে। পপুলার কালচার বলতে আমি বোঝাতে চাইছি এমন সাংস্কৃতিক পরিস্হিতি ও পরিবেশ যখন খবরের কাগজের মালিক, রেডিও ও টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তা, টিভি টাইকুন ও প্রযোজক, গ্রন্হ প্রকাশক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক, রেকর্ড ও ক্যাসেট কোম্পানি, আর্টগ্যালারি, বাণিজ্যিক পত্রিকার স্বত্বাধিকারী, স্টুডিও মালিক, সঙ্গীতযন্ত্র প্রযুক্তিবিদ, গণমাধ্যম ব্যবস্থাপক, মিছিলে ভিড় সাপলাইকারী প্রমুখ লোকজন সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এই প্রেক্ষিতে বোঝা যায় কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সময়ের অনেক আগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পপুলার কালচারের পৃষ্ঠপটে, কবিতায় ছন্দের বদলে ধ্বনিক্রীড়ার প্রবর্তন একটি অত্যাধুনিক নিরীক্ষা। এ এক অভূতপূর্ব নিরীক্ষা যা একাধারে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডটির সর্বসন্মতিক্রমের বিরোধিতা করে, আবার সেই সঙ্গে তার মধ্যে রয়েছে লোকরঞ্জনের প্রাণশক্তি। জ্ঞান, রাজনীতি, নান্দনিকতা ও নৈতিকতার বহুত্বকে এইভাবে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

খ্রিস্টধর্মের বাহকরূপে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ যখন এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় পৌঁছেছিল, তখন অষ্টাদশ শতকে পাওয়া তাদের নতুন দার্শনিক উদ্দীপনাকে তারা চারিয়ে দিতে চেয়েছিল তথাকথিত আবিষ্কৃত ভূখণ্ডের জনসাধারণের জীবনে। ইউরোপ তার কৌশল ও সামরিক ক্ষমতার গরিমায় নিজেকে মনে করেছিল, আজও করে, আলোকপ্রাপ্ত প্রগতির দূত। বাদবাকি পৃথিবীকে নিজের মতন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। নিজের সমান নয়, বলাবাহুল্য। কিন্তু তাদের সবাইকে পিটিয়ে একইরকম করতে চেয়েছিল। চেয়েছিল সর্বজনীন করে তুলতে। ইতিহাসকে, সময়কে, তারা মনে করেছিল একমুখী আর একরৈখিক। আধুনিকতাকে ভিত্তি করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বঙ্গসমাজে যে প্রাতিষ্ঠানিক বোধের প্রবর্তন ঘটায়, তার প্রক্রিয়া ও প্রভাবে আমজনতার সাহিত্য সঙ্গীত সংস্কৃতির বাইরে গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টধর্ম-প্রভাবিত রাজধানির বন্দনাকারী মুষ্টিমেয় উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালির একটি কেন্দ্রাতিগ আধিপত্যবাদী একমুখী একরৈখিক দোভাষীর খাস সাহিত্য সঙ্গীত সংস্কৃতি। বঙ্গসমাজের অজস্র রূপকে তা ঢালাই করতে চেয়েছিল এবং তাতে সফলও হয়েছিল, একরূপতায় বা সমরূপতায়। অনেক স্বরকে পালটাতে চেয়েছিল একক স্বরে এবং তাতে সফল হয়েছিল। নজরুল গ্রাম ও পাড়ার নানাধর্মী নেটিভ নান্দনিকতাকে বদলে ফেলতে চেয়েছিলেন শাসকর কেন্দ্রাভিগ নান্দনিকতার বিরুদ্ধবাদী স্ফূরণে, ইতিহাসের সর্বজনীনতার বিরুদ্ধে, ভাষার উচ্চবর্ণ গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, মানবেতিহাসকে একটিমাত্র আখ্যানের অন্তর্গত মনে করার বিরুদ্ধে, বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক সত্তার ধারনার বিরুদ্ধে। এ কারণেই মোহিতলাল মজুমদার যখন তাঁকে শেলি, কিটস, টেনিসন, ওয়র্ডসওয়র্থের কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলেন, তখন নজরুল ওই ব্রিটিশ কবিদের কাজকে অসহ্য মনে করে প্রত্যাখ্যান করেন। ইউরোপের সরবরাহ করা আলোকপ্রাপ্তির দর্শনটিকে সর্বজনীন নৈতিক ও বৌদ্ধিক প্রগতির প্রতিভূ বলে মেনে নিতে পারেননি কাজী নজরুল ইসলাম। তাই বলে নজরুল দেহাতি নন বা স্কিৎসোফ্রেনিকও নন।

ত্রয়োদশ শতকে বর্তমান ইরাকের রাজধানী বাগদাদ শহর থেকে এসেছিলেন নজরুলের পূর্বপুরুষ মহম্মদ ইসলাম। ঘরসংসার মা-বাপ ফেছনে ফেলে অজানার উদ্দেশ্যে এই বেরিয়ে পড়ার আরবিক ইন্দ্রিয়চেনতা ও নারীসৌন্দর্যে স্তম্ভিত হওয়ার (যে জন্য আবায়া পরার প্রথা) সংবেদন নজরুলকে কৈশোর থেকে আটপৌরে বাঙালিদের থেকে আলাদা করেছিল। ওল্ড টেস্টামেন্টের চরিত্রদের সঙ্গে তাঁর রক্তসম্পর্ক ছিল। গৌরবর্ণ মজবুত চওড়া হাড়ের নজরুল, ময়লা চেহারার পাঁচফিটের রোগাটে বাঙালিদের মধ্যে নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেয়েছেন কবিজনোচিত নম্রতার খোলোশ দিয়ে। তাঁর ইন্দ্রিয়চেনা তাঁকে যোদ্ধা হতে প্ররোচিত করেছে এবং সেকারণে তিনি গর্ববোধ করেছেন হাবিলদার পদের আখ্যায়। যা তদানীন্তন সাহিত্যজগতে ছিল অকল্পনীয়। আমরা ফরাসি কবি গীয়ম অ্যাপোলোনিয়ারের কথা জানি, যিনি সাহিত্যিক মহলে সামরিক পোশাকে ঘুরে বেড়াতেন। ঘরকুনো কলকাতাবাসী কবিমহলে নজরুলের প্রাগুক্ত বাড়িহীনতাকে বোহেমিয়ান বলে ভুল করা হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বাঙালি ছিলেন না, সেকারণে তাঁর বোধে হীনম্মন্যতা কাজ করেনি কখনও।

বাঙালিবাড়ির আদ্দামড়া খোকারা মায়ের আঁচল ছেড়ে অন্যত্র যেতে চান না। কিন্তু আমরা আজও দেখি বাড়িঘর ছেড়ে ইরাক-ইরান-লিবিয়ার যুবকেরা মতাদর্শের লড়াই লড়তে চলে যাচ্ছে আলজেরিয়া সুদান সিরিয়া ইরাক আফগানিস্তান লেবানন চেচনিয়া বসনিয়ায়। এ এক আত্মআবিষ্কারের কৌম-প্রক্রিয়া যা বস্তুজগতের লাভ-লোকসান দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। অথচ একদা-ধর্মান্তরিত পরিবারের বাঙালি যুবকেরা নিজের দেশের মানুষের মাথায় বোমা ফাটাতে ব্যস্ত। নিজের তৃণমূল বোধের জন্য নজরুল আর্থিক দৈন্যে বিপর্যস্ত হয়েছেন বারংবার, গুছিয়ে বসার ব্যাপারটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর কবিত্ব-প্রতিস্বের দুর্বার প্রাণস্রোত, একই সময়ে বিভিন্ন আঙ্গিকের কবিতা ও গান লেখার অনর্গল ক্ষমতা, সামনের সমস্তকিছু জয় করে যেদিকে ইচ্ছে চলে যাবার আকাঙ্ক্ষা, তাঁর অশ্বারোহী পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া। এই কারণেই তাঁর সমকালীন বাঙালি কবিরা ব্রিটিশ রোমান্টিসিজমের ভাষা-জটিলতায় আচ্ছন্ন হলেও, নজরুল এড়িয়ে গেছেন সেই জগৎটিকে। পয়গম্বর হজরত মহম্মদের বিরোদ্ধে বিদ্রোহকারী খালেদ সম্পর্কে ১৯২৬ সালে একটি কবিতা লেখেন নজরুল। পরবর্তীকালে হজরত মহম্মদের সেনাপতি হয়ে খালেদ রোমক শাসকদের কবজা থেকে উদ্ধার করেছিলেন পবিত্র মক্কা নগরীকে।

আরবিক ইন্দ্রিয়চেতনা সঞ্জাত প্রতিস্বকে নজরুলও, খালেদের মতন, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমিপুত্রের সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধারের কাজে লাগাতে চেয়েছেন। তাকে মুক্ত করতে চেয়েছেন ইউরোপীয় মননবিশ্বের কোড লোগো প্রতীক চি্হ্ণ দ্যোতক রূপক ইত্যাদির জেলখানা থেকে। তাঁর সারা কাব্যদুনিয়ায় পাওয়া যাবে বিলম্বিত ও দ্রুতলয়ের অশ্বখুরধ্বনি, যা বাবু-মিয়াঁ বাঙালিকে বিব্রত করে। অমন অন্ত্যজ ভাবদুনিয়ায় ঢুকতে অপ্রস্তুত বোধ করেন অভিজাত বাঙালি। তাঁর প্রতিবাদের মুহুর্মুহু আধিপত্যবাদবিরোধী আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয় তাঁর কাব্যভাষার সন্ত্রাসে। মোলায়েম প্যানপেনে ন্যাকান্যাকা অভিব্যক্তির হীনমন্যতা থেকে তিনি ছিনিয়ে বের করতে চেয়েছেন কবিতাকে, কবিত্বকে। আরবি রূপকল্প ও শব্দাবলির অন্তর্ঘাতই কেবল নয়, তলে-তলে কাজ করেছে বিকল্প মূল্যবোধ সৃষ্টির অভিঘাত, যে-অভিঘাতের সূত্র ছিল মারফতি ও মুরশিদা, নৌরচকা ও গজল, নিকউবানা ও ভাটিয়ালি, লাউনি ও ঝুমুর, সারি ও রামপ্রসাদী, তোড়ী ও কীর্তন। সাহিত্য সংস্কৃতির ইউরোপীয় মানদণ্ডটি তিনি ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন ঔপনিবেশিক কালখণ্ডেই, যখন কিনা এই স্ট্র্যাটেজি বিভিন্ন দেশে উৎসারিত হতে দেখা গেল উত্তরঔপনিবেশিক আমলের সাহিত্য সংস্কৃতিতে।

চলবে