উনিশতম অশ্বারোহী

পর্ব ৬

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৮

নজরুল তাঁর গানের স্বরলিপির কপিরাইটের ধার ধারেননি। তিনি চেয়েছেন মীরাবাই, রহিম, লালন, রামপ্রসাদের মতন তৃণমূলে নিজেকে চারিয়ে দিতে, যাতে যে গাইবে তারই যেন হয়ে ওঠে তাঁর গান। যাতে তাঁর গানকে কেন্দ্র করে কোনও আধিপত্যবাদী শাসন-কাঠামো না জন্মায়, যাতে না তা অভিজাত নিয়ন্ত্রকদের স্বার্থান্ধ বিধিবিন্যাসের কবজায় স্থবিরতা লাভ করে, যাতে না তা স্থিতাবস্থার আরোপিত অভ্যাস গড়ে তোলে, যাতে না তা মুষ্টিমেয়র সুবিধাভোগের চক্রব্যূহ বানিয়ে, যা গাইতে চায় তাকে ঘিরে ধরে বোবা করে দেয়। বাজার না হলে আধুনিকতার পপকল্প সম্পূর্ণ হয় না, অথচ প্রভূত জনপ্রিয়তা সত্বেও বাজারকে উপেক্ষা করেছেন নজরুল। তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি তাঁকে আপনা থেকেই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের মডেলটির বিরোধী করেছিল।

আধুনিকতাবাদের  সঙ্গে নজরুলের সংঘাত কেবল আরব ইন্দ্রিয়চেতনার জন্য নয়। ঔপনিবেশিকতাকে সহ্য করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ মুসলমান সমাজ, অভিজাত ও মধ্যবিত্ত তো বটেই, হিন্দু নিম্নবর্ণ থেকে ধর্মান্তরিত মানুষও, আধুনিকতাকে সরাসরি গ্রহণ করতে চাননি। নজরুল কর্তৃক আধুনিকতাবাদ প্রত্যাখ্যানের উৎসসূত্র হল বহু জনমানস-সম্ভূত সাংস্কৃতিক ভূমিপুত্র হিসাবে অন্ত্যজ ও প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব। তাঁর আগে ও পরে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বঙ্গসমাজের একটি ক্ষুদ্র বর্গ-বিশেষের কণ্ঠস্বর নিয়ে এসেছিলেন। তা হয় এলিটের নয় পাতিবুর্জোয়ার বা নিচুতলার। তা পূর্ববঙ্গের বা পশ্চিমবঙ্গের। তা ব্রাহ্ম বা হিন্দু বা মুসলমানের। এই সূক্ষ্ম ভারসাম্যের দারুণ চাপ যে কোনও সুস্থ মানুষকে উন্মাদ করে দিতে পারে। অথচ নজরুলের জনপ্রিয়তার ভিত্তি ছিল এই ভয়ঙ্কর ভারসাম্য, যাকে তিনি ব্যক্তিগত স্তরে সামলাবার চেষ্টা করেছেন অযথা অট্টহাস্যের দ্বারা, দিলখোলা কথাবার্তার দ্বারা, জীবনযাপনের নোঙরহীনতার দ্বারা, গানের সর্বভূক  ব্যাপকতার দ্বারা। নজরুলের কীর্তিকে বিচার করতে হলে আলোচককে কেবল প্রান্তিকের প্রতিনিধিত্ব করলেই চলবে না, তাঁকে হতে হবে বহুত্ববাদী যৌগিক সংস্কৃতির ভূমিপুত্র। প্রান্তিক ও অন্ত্যজ বাঙালির জ্ঞানতাত্বিক অবয়বটির উপলব্ধি থাকা তাঁর প্রয়োজন। দেশভাগের পর দুই বাংলার গ্রামীণ কমিউনগুলোর কাঠামো ভেঙে পড়ায় সেই ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। জনৈক মুসলমান যুবক শ্যামাসঙ্গীত গাইছেন ও সুর দিয়ে তাকে রামপ্রসাদের গানের চেয়ে জনপ্রিয় করে তুলছেন, আজকের ঐক্যবুকনির যুগে, পদ্মা-গঙ্গা ড্রামাবাজির দিনকালে, সংহতি-বক্তিমে ঝাড়ার দিনে, স্রেফ ভয়াবহ। বাংলাদেশে তো আরও বিপজ্জনক। বাজারের খোরাকের ব্যাপার না হলে, তা যদি কবির নির্মল ব্যক্তিপ্রতিস্বের উৎসার হয়, তাহলে বর্তমান কালখণ্ডে সমাজ তা অনুমোদন করবে বলে মনে হয় না। নজরুল যে তাঁর সমসাময়িক কবি ও সঙ্গীতকারদের ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তা ওই প্রাণস্পন্দিত ভারসাম্য সৃষ্টির ক্ষমতার দরুণ। তাঁর নির্মাণপ্রকল্পের তাৎক্ষণিক অভাবনীয় সফলতার মধ্যেই ছিল ভবিষ্যতে উপেক্ষিত হবার বীজ। রবীন্দ্রনাথের কর্মকাণ্ড দেখেও তিনি শিখতে পারেননি।

সমগ্রের পৃষ্ঠপোষক নজরুল বাদ দিতে চাননি কোনও কিছু, এবং সেকারণেই সমর্থন করেননি কবি ইকবালের রাজনীতিকে। একথা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘সভাকবি হতে হলে এসট্যাবলিশমেন্টের কাছে মাথা নোয়াতে হয়, নজরুল কখনও নোয়াননি।’ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিজে পরবর্তীকালে বেমালুম এসট্যাবলিশমেন্টে সেঁদিয়ে গেলেও, নজরুল কিন্তু রফা করেননি। ভারতীয় এসট্যাবলিশমেন্টের কাছে তাই ইকবাল ও গালিবের তুলনায় উপেক্ষিত ছিলেন, এবং থেকে গেছেন। ভারতবর্ষে, বহুকাল পর্যন্ত, শিক্ষা দপতরটির নিয়ন্ত্রণ ছিল মৌলানা আবুল কালাম আজাদের হাতে। কেবল জিন্নার পাকিস্তানে নয়, ভারতবর্ষেও মুসলমান বাঙালির সাহিত্যসঙ্গীতকে মুসলমান উর্দুভাষীর কীর্তির চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করেছে এসট্যাবলিশমেন্ট। বাঙালি মুসলমান ছিল নিম্নবর্গের, অর্থাৎ মেট্রপলিটান ক্ষমতাজোটের বাইরের লোক। প্রাগাধুনিক আমলে, মোগল এসট্যাবলিশমেন্টে, এবং তার ভাঙনের সময়েও, অভিজাত মুসলমান সমাজের ভাষা ছিল ফারসি-আরবি-উর্দু। ওই ভাষাভাষি সাহিত্যিক কোড অমান্য করা ছিল গর্হিত, কেননা আধিপত্যের আহ্লাদের মুসলমানি উৎসসূত্র ছিল সেই ডিসকোর্স। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের উর্দুভাষীরা বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে চোখা-চোখা গালমন্দ উপহার দিয়েছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত তাদেরই নব্বুই হাজার সেনা ল্যাজগুটিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচে। নজরুল তা অমান্য করেছিলেন, এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেকারণেই মৃত নজরুলের দাবিদার হয়ে ওঠে। প্যান ইসলামিক সমাজে বাঙালি মুসলমান অবশ্য এখনও প্রায় প্রান্তিক। আর নজরুল যে সেই মঞ্চে রবাহুত, তা না বললেও চলে। ব্যাপারটা বিস্ময়কর এইজন্যে যে, মসনদের পপাগাধুনিকতা এবং আধুনিকতাকে একযোগে প্রতিরোধ করে একেবারে নিজস্ব আধার ও আধেয় গড়েছিলেন তিনি। মনে রাখা দরকার যে, বঙ্কিম যেমন ইংরেজিতে ‘রাজমোহনস ওয়াইফ’ এবং মাইকেল যেমন ইংরেজিতে ‘ক্যাপটিভ লেডি’ লিখে যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেরকম নজরুল শুরু করেছিলেন আরবি-ফারসি-উর্দু নগমা-শায়রি দিয়ে। আধুনিকতার দ্যোতকগুলোর চাপে তাঁর সময়কার বাংলা কবিতা যদিও ইউরোপীয় আদলটি গ্রহণ করেছিল, তিনি কিন্তু প্রাচীন ও নবীনের মাঝে নেটিভ যোগসূত্রটির একচ্ছত্র মালিকানা বজায় রাখলেন। কিন্তু খ্রিস্টধর্মের তল্পিবাহকরূপে আধুনিকতাবাদ আসার আগেও বাংলা কাব্য ছিল প্রধানত অ্যাপোলনীয়। প্রথমে মাইকেল মধুসূদন এবং পরে নজরুল ইসলাম প্রবর্তন করেছিলেন ডায়োনিসীয় মেজাজের। ডায়োনিসীয় মেজাজটা বাঙালি পাঠকের কাছে বেশ অস্বস্তিকর। নজরুলের কবিতায় ভাষার নৃত্যভঙ্গিমা বাঙালি বাবু ও মিয়াঁ সমাজের মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটায়। বস্তুত মনস্তাত্বিকদের উচিত বিশ্লেষণ করে দেখা যে, ‘দে গোরুর গা ধুইয়ে’ সংলাপটি কোনও ব্যক্তিগত ইশারা বহন করছে কি না। বাক্যটিকে অর্থহীন কথার কথা মনে করা ভুল।

প্রাগাধুনিক সমাজটি যখন আধুনিকতার ভান করেছে, তার ঘুর্ণিতে পড়তে হয়েছে নজরুলকে। একাধিকবার মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্যের দরুণ আচমকা সম্পর্ক ছিন্ন করে মেনে নিলেন রহস্যময় চিরবিচ্ছেদ। সিয়ারশোল স্কুল থেকে উৎখাত হলেন, কেননা প্রাগাধুনিক প্রকৃতিবাদী প্রধানশিক্ষক গিয়ে তাঁর জায়গায় এলেন আধুনিক সংস্কৃতিবাদী প্রধানশিক্ষক। রেলের খ্রিস্টান গার্ডের খোঁড়া সৎ-মেয়েটিকে তার আশ্রয়স্থলে পৌঁছে দেবার বদান্যতা দেখাতে গিয়ে কৈশোরেই কুড়োলেন ইলোপ করার বদনাম। প্রণয়িনীর চুলের কাঁটা পকেটে নিয়ে যোগ দিলেন সৈন্যবাইনীতে। ফিরে এসে, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাদুড়বাগানের মেসে দিনকতক থাকার পরের উৎখাত হলেন হিন্দু আবাসিকদের হল্লায়। ডেরা বাঁধলেন কাগজের অফিসে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নিচে থেকেই ‘গুরুজি গুরুজি’ বলে হাঁক পাড়লেন। মোহিতলাল মজুমদারের বিরুদ্ধে চাপালেন চাপান উতোর। তাঁর ক্রুদ্ধ রচনার দরুণ ‘নবযুগ’ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। দেওঘরে যাঁর বাসায় আশ্রয় পেলেন, সেখানে স্বামী-স্ত্রী নয় এমন যুবক-যুবতীকে রাতভর থাকতে দিয়ে উৎখাত হলেন। দৌলতপুর গিয়ে অতিদ্রুত সৈয়দ আসাব খানের প্রেমে পড়লেন এবং কাবিনামার শর্ত মনঃপূত না হওয়ায় বিয়ের আসর থেকে উঠে চলে গেলেন।

‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করলেন, এবং তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি বাজেয়াপ্ত হলো। ‘ধূমকেতু’ প্রকাশের দায়ে কুমিল্লা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে এনে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। মেদিনীপুরে তাঁর গান ও কবিতা আবৃত্তিতে মুগ্ধ একটি হিন্দু যুবতী নিজের গলার সোনার হার খুলে নজরুলকে পরাবার পর পারিবারিক ও সামাজিক ধিক্কার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করে নিল। ঢাকার রানু সোমের সঙ্গে তাঁর নৈকট্য আঁচ করে তাঁকে প্রহার করেন সমাজের কর্তাবাবারা। তেইশ বছরের নজরুল আহলে-কেতাব মতে বিয়ে করলেন ষোলো বছরের প্রমীলা সেনগুপ্তকে। নলিনাক্ষ সান্যালের বিয়েতে মুসলমান বরযাত্রী হওয়ার দরুণ বিতাড়িত হলেন বিয়েবাড়ি থেকে। হিন্দু মেয়ে বিয়ে করায় কলকাতার কোথাও বাড়ি ভাড়া না পেয়ে শেষে থাকতে বাধ্য হলেন হুগলির মুসলমান গেটো মোগলপুরায়। তারপর সেখানেও টিকতে না পেরে বাসা নিলেন কৃষ্ণনগরে, এবং এমন দারিদ্রে আক্রান্ত হলেন যে বন্ধুবান্ধবদের ‘নজরুল সাহায্য রজনী’ অনুষ্ঠান করে চটজলদি টাকা তুলতে হলো। উত্তরোত্তর হিন্দু দেবী দেবতার প্রসঙ্গ তাঁর গান ও কাব্যে বৃদ্ধি পাওয়ায়, বিরাগভাজন হলেন মুসলমান সমাজের রক্ষণশীল বর্গের। ‘মোহম্মদি’ পত্রিকা তাঁকে ‘কাফের’ আখ্যায় ভূষিত করল। গণিতে স্নাতকোত্তর যুবতী ফজিলতুন্নেসার প্রতি আকৃষ্ট ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে টের পেলেন যে কবিতা ও গানের জনপ্রিয়তার বাইরে একটি আত্মাভিমানের জগৎ আছে যেখানে তাঁর স্বীকৃতি সম্ভব নয়। অকস্মাৎ একদিন, তাও বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানে, তাঁর উচ্চারণ ক্ষমতা তিরোহিত হল, এবং বাকহীন হয়ে গেলেন বাকি সারাটা জীবন। তাঁর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল। তাঁর শাশুড়ি একদিন কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। ‘নজরুল সাহায্য কমিটি’ দুশো টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু জনৈক ঈর্ষান্বিত কবি কলকাঠি নাড়িয়ে তা বন্ধ করে দিলেন। তাঁর স্ত্রী আক্রান্ত হলেন পক্ষাঘাতে। জীবনের শেষ কয়েকদিন মৌন সম্রাটের মতন ঢাকায় কাটালেন নজরুল। নজরুলের প্রতিষ্ঠার জন্য তা ভালোই হল। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে-ওঠা সংস্থার সংগঠকরা যে-যার আখের গুছিয়ে কেটে পড়লেন, এবং সংস্থাটি লাটে উঠে গেল। তাঁর রচনাসমগ্রের ফাইল লোপাট হয়ে গেল সরকারি দপতর থেকে। একুশ শতকের পোস্টমডার্ন দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, প্রাগুক্ত ঘটনাবলীকে একটি ভয়াবহ ত্রাসিত রূপকথা মনে হয়, অধিবাস্তব মনে হয়। কিন্তু প্রাগাধুনিকতা ও আধুনিকতার বঙ্গীয় সাঁড়াশিতে আটক নজরুল ভুগেছেন ওই অনৈক্য, ওই অনিশ্চয়তা, ওই হাহাকার, ওই আক্রমণ, ওই অনপনেয় জীবন।

চলবে