
ফাইল ছবি
এক বিকেলে আজিজ সুপার মার্কেটে
মুজিব মেহদীপ্রকাশিত : অক্টোবর ০৯, ২০১৮
বিকেল-সন্ধ্যায় শাহবাগে আসা হয় না বহুদিন। জ্যাম ফ্যাক্টর। বলতে কী, ভয়ই লাগে। আজ আসতে হলো। অফিসিয়াল কাজ ছিল টিএসসির শিক্ষক লাউঞ্জে। ওখান থেকে চারুকলা। আশিক আকবরকে মিস করলাম। জায়গাটা আছে, বইয়ের দোকানও আছে, নেই কেবল আশিক ও তার বন্ধু তাপসী। শাহবাগ মোড়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ব্যানারে দর্শকসহ মাত্র জনাতিরিশেক লোকের একটা জটলা দেখা গেল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকুরিতে ৩০ শতাংশ কোটা বহালের দাবিতে।
আজিজ মার্কেটে এসে একটা জনমনিষ্যিও পেলাম না, যার সঙ্গে দাঁড়িয়ে বা বসে এক কাপ চা-কফি খাওয়া যায়। অবশ্য মার্কেটে ঢোকার মুখে রোড ডিভাইডারের ওপরে কামরুজ্জামান কামুকে পেয়ে দুজনের ঠোঁটই খানিকটা প্রসন্ন হয়েছিল। ওর অভিমুখ ছিল উলটোদিকে, ওপাশে ওর অপেক্ষায় আছেন একজন। ফলে মিনিট তিনেক ওখানেই কুশলাদি বিনিময় হলো। কামুর এফবি লাইভ ঘটনার ম্যালাদিন আগে থেকেই ওর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। কামু ভালো থাকুক।
ঢোকা গেল জনান্তিকে। চোখে লাগল না কিছুই। প্রথমায় শঙ্খ ঘোষের নির্বাচিত গদ্যরচনার একটা সংগ্রহের প্রতি পরকীয়ার মতো প্রেমবোধ হলো! তাঁর বিভিন্ন গদ্যগ্রন্থের অনেক প্রিয় গদ্য একসাথে। কিন্তু বইয়ের আয়তনের তুলনায় অযৌক্তিক দাম দেখে আমি উত্থানরহিত। বাংলা টাকায় বারোশ`রও বেশি। এরকম বই উপহার পেতেই বেশি ভালো লাগে! কেউ দিলে ভালো লাগত, কিন্তু দেবে না জানি।
তক্ষশীলায় নির্মল হালদারের `কবিতা সংগ্রহ`-এর দুই খণ্ডের প্রথমটা পাওয়া গেল। এই সংগ্রহে কবির তেরোটি বই অন্তর্ভুক্ত। মাটি-ধান-জলের গন্ধমাখা খাঁটি কবি আমাদের প্রায় নেই। সবাই আমরা উন্মূল হতেই ভালোবাসছি বড়ো। এ কবিকে পড়লে নিজের জাত চেনা যায়। বইটা বাগে পেয়ে আরাম বোধ হলো।
দোতলায় গিয়ে লোক-এর ঠেক বন্ধ পেলাম। এফবিতে দেখেছি শ্রাবণ নতুন অফিসে চলে গেছে। তবু শ্রাবণের দীর্ঘদিনের ঠেক ছেড়ে যাওয়াটাই দেখতে ইচ্ছে হলো। আমার প্রথম বইয়ের প্রকাশক বলে কথা। বিস্ময়ের সাথে দেখলাম যে, শ্রাবণ শ্রাবণেই আছে! নতুন অফিসটা আদতে শ্রাবণের দোসরা অফিস। ভালো লাগল দেখে যে, রবীন প্রস্থেও বড়ো হচ্ছে!
ওর সম্পাদিত `বইনিউজ` গোছাচ্ছে একটা ছেলে। হাতে নিয়ে চমকে গেলাম। পঞ্চাশটি বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত বইয়ের নামধামের একটা তালিকা ছেপেছে বইনিউজ। সব মিলিয়ে তালিকাভুক্ত বইয়ের সংখ্যা ১৮৩৯। এ তালিকা নিঃসন্দেহে অসম্পূর্ণ। চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়, তালিকার একটা বড়ো অংশ বইই বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রেমবশত রচিত নয়, বরং রচিত বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। ফলে তালিকার একাংশ বই নিম্নমানের অখাদ্য চর্বিতচর্বণই হবে। কিন্তু কথা সেটা নয়। কথা হলো, রবীন যে একা একাই দেশব্যাপী ভ্রাম্যমাণ বঙ্গবন্ধু বইমেলা করে বেড়াচ্ছে, ওর এই অবদানের কোথাও কোনো তুলনা নেই।
আজিজের দোতলার উত্তর-পূর্ব প্রান্ত থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত অগণিত পোশাকের দোকানের ঢেউ পার হয়ে নিচে নেমেই একজন সাধু পুরুষকে ঘিরে তিন যুবককে ব্যস্ত থাকতে দেখলাম। খুব দ্রুত কথা বলছেন তিনি। চশমা ঠিক করে গভীর অভিনিবেশে তাকিয়ে দেখি দাড়ি-গোঁফে সয়লাব সাধু পুরুষটি আর কেউ নন, এ তল্লাটের এক কালের লিজেন্ড চলচ্চিত্রবোদ্ধা স্বয়ং খসরু ভাই। কম করেও এক যুগ পর তাঁকে সামনাসামনি দেখলাম। বয়সের ভারে অনেকটাই কুঁজো হয়ে গেছেন যদিও, তবু দারুণ স্মার্ট দেখাচ্ছিল তাঁকে। ঘিয়ে রঙা পাঞ্জাবি পরা, কাঁধে যথারীতি ঝোলা। কথা বলব বলব ভেবেও ফুরসত পাওয়া গেল না। ততক্ষণে পশ্চিম বারান্দা দিয়ে দুজন সাগরেদসহ নেমে যেতে গিয়েও একটু থেমে পেছনের জনকে কিছু বলতে থাকলেন। মনে হলো একটা ছবি অন্তত তুলে রাখি। মোবাইলটা রেডি করে কাছে গিয়ে বললাম, `এক্সকিউজ মি খসরু ভাই, একটা ছবি তুলবার অনুমতি পেতে পারি?` তিনি কিছু না ভেবেই দ্রুত জবাব দিলেন, `সরি, আপনাকে আমি চিনি না।` `আপনি আমাকে চিনতেন, আমি মুজিব, কবিতা লিখি` বললেও তিনি তড়িঘড়ি নামতে নামতে বললেন, `কবি-টবি আমি মারি না`!
থতমত খেয়ে দশ সেকেন্ডের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর নিষ্ক্রান্ত হওয়া দেখলাম। মনে হলো, আচরণটা আজো ঠিক আগের খসরু ভাইয়ের মতোই আছে। তিনি তো ঠিক কাজই করেছেন। অচেনা কাউকে কেন তিনি ছুবি তুলতে দেবেন? তা ছাড়া, দীর্ঘদিন পরে দেখে কারো না চিনবার মতো বাহ্য পরিবর্তন তো আমার আসলেই হয়েছে। দাড়ি ছাড়া মুখ, ক্যাপ-চশমা পরা আমাকে তো তিনি কখনোই দেখেন নি। তবু মনটা বিমর্ষ হলো খানিক।
কয়েক কদম হেঁটে বিদিত-এ ঢুকে আবার বইপত্রের মধ্যে হারাতে চাইলাম। রণজিৎ দাশের নতুন কবিতার বই `বিষাদসিন্ধুর কিছু লেখা` পেয়ে বর্তে গেলাম। পড়া তো দূরে থাক, বইটা যে বেরিয়েছে তা-ই জানতাম না পর্যন্ত। তাঁর সব লেখাই আমি পড়তে চাই। কপিটা কব্জা করে ঘুরতেই চোখে পড়ল সৈয়দ সাজ্জাদ আহমেদের এক ফর্মার গোলাপি পেপারব্যাক `ফিলোসফি আল্লাহ`। তাঁর ব্যক্তিগত সুফি বয়ান। আগ্রহী হলাম। এক ফর্মায় কীভাবে এক জীবনের সমস্ত সাধনভজন লিখে ফেলা যায়, তা পরখ করে দেখবার লোভ হলো। আমি যদি ভুল না শুনে থাকি, অতিসম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন। আশি-নব্বইয়ের অনেক লেখকের সঙ্গে তাঁর বেশ সখ্য ছিল। খুব সম্ভব সুব্রতদা, এবাদুর, রাইসু প্রমুখের সঙ্গেও তাঁর ওঠাবসা ছিল।
যাওয়া যেমন তেমন, শাহবাগ থেকে ফেরা মুশকিল। পথের দিকে তাকিয়ে রাত এগারোটার আগে ফেরার সাহসই হয় না। কিন্তু তবু সাহস করতে হলো। এমন সাহারাতুল্য খাঁ-খাঁ আজিজ মার্কেট কি এ জাতি চেয়েছিল কখনো! ওর ওয়েসিস তথা মরুদ্যানগুলো আজ কোথায়?