কাজী নাসির মামুনের গদ্য ‘জ্যোছনাবাড়ির ভ্রমণ পথে’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২০
জ্যোছনাবাড়ির ভ্রমণ পথে একবার চাঁদ দেখতে গিয়েছিলাম। ধুলোয় আবৃত কাঁচা মাটির সড়ক। দুই পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে ধানের জমি। এখনও শীষ ফোটেনি। সঙ্গে আমার বন্ধু ছিল। রিকশায় চেপে বেরিয়েছি দুজন। আকীর্ণ জ্যোছনায় দুজনই দিশেহারা। ধুলোর ওপর জ্যোছনা জমে দুধের সরের মতো লালাভ হয়ে আছে। যেন সরের একটা লম্বা পরত দূরের দিগন্তের দিকে হারিয়ে গেছে। আর আমরা হারাচ্ছিলাম অনন্ত আলোড়নে। আধিভৌতিক সেই আলোড়ন। ননীর পাতিল চুরি করে কৃষ্ণের কতটা আনন্দ হয়েছিল, জানি না। আমরা, জ্যোছনাতাড়িত দুই যুবক প্রায় কাঁদো কাঁদো বলেছিলাম, আহ, কী সুন্দর!
চাঁদের বুড়িটি অপলক তাকিয়ে দেখছিল আলো সমাগম। আর ছিল তারার পসরা নিয়ে মিটিমিটি মহাকাশ। বিশাল আনন্দগুলো এ রকমই হয়। খুব ক্ষুদ্র পরিসরে। বিশেষ কিছু তো নয়। রিকশায় চেপে দুই বন্ধু জ্যোছনা দেখতে বেরিয়েছি। এরই মধ্যে এত কেন আলোড়ন? আলোড়ন, কেননা অনন্ত ঐক্যের একটা রেশ অবচেতনে অনুভব করছিলাম আমরা। জাগতিক অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা তা উপমায় ধারণ করছিলাম মনে মনে। বিশেষত আমি নিজে। আর আমার মনে হচ্ছিল, কবিতা সেই অনন্ত ঐক্যের দিকেই যেতে চায়। তা নাহলে জীবনানন্দ কেন বলেন, উপমাই কবিতা? বোদলেয়ার কেন বলেন, কবি হচ্ছেন দ্রষ্টা।
দ্রষ্টা কবি তো আসলে অনন্ত ঐক্যকেই বিশ্লেষিত অবস্থায় দেখেন অথবা বিশ্লেষিত অবস্থাকে একটা অনন্ত সংশ্লেষের মধ্যেই পেতে চান। আর সেটাই তো বোধহয় অসীম ঐক্য, রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘মায়বন বিহারিনী হরিণী’ বলে তাকেই ধরবার ‘অকারণ’ পণ করেছেন। ‘অকারণ’ কেননা সেই অনন্ত ঐক্যের সঙ্গে সংশ্লেষিত হবার পরিণতি সম্পর্কে কবি একেবারেই দিশেহারা। যেমন আমরা ক্ষুদ্র পরিসরে পরিব্যাপ্ত অসীমের সামান্য জ্যোছনায় বিহ্বল হয়ে পড়েছি। আর ভাবছি, জ্যোছনা পরিবৃত এই ধুলোর সড়কটাই দুধের সরের মতো লোভনীয়। আমাদের লোভ আছে, অথচ সমগ্র ভোগের ক্ষমতা নেই। উপভোগের মধ্যেই দুধের সাধ ঘোলে মিটাবার চেষ্টা করি আমরা।
ফলে অপরিতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা জেগে থাকে। তৈরি হয় বেদনাবোধ। যতদিন তা টিকে থাকে, ভাব আর ভাষার সমন্বয়ে কবি লেখেন কবিতা। অন্যথায়, অসীম আনন্দভোগের সেই যে পরমালোক প্রাপ্তি, তখন তো মানুষ আর মানুষ থাকে না। আইনস্টাইনের E=mc2 এর মতো আলোর গতি প্রাপ্তিতে নিজেই শক্তি হয়ে যায়। আর কবি তো উপাসক। সুন্দরের, শক্তির। স্বীকারে, অস্বীকারে, কারণে, অকারণে, অর্থে অনর্থে কবি আসলে উপাসক। যদি সে শয়তানের উপাসক হয়, তবে সমাগ্রিক অর্থে তাকেই সে সুন্দর জানে। কবির জন্য সত্যের চেয়ে সুন্দর অনেক বেশি দামি। যদি তা সাময়িকও হয়। জ্যোছনাবৃত রাস্তাটা যতই সত্য হোক, দুধের সরের মতো লালাভ অসত্যটা না এলে সুন্দর বলতাম? হয়তো তাই রক্তপাতের মধ্যেও কবি রক্তজবার উপমা খোঁজেন। যে রক্তপাত আর ধ্বংসযজ্ঞকে কবির সংবেদনশীল মন মানতে চায় না, যে সংহারকে তিনি অস্বীকার করতে চান, তার-ই মধ্য দিয়ে জীবনের পূর্ণতায় আমাদের প্রতীতী জন্মে। অস্পৃশ্যের বর্ণনাও কবিতায় মহৎ হয়ে ওঠে। ধ্বংসের বর্ণনাও উপমায়, চিত্রকল্পে কবিতায় সুন্দর মনে হয়।
তার মানে অনেক বিরোধের মধ্যে ঐক্যের সংস্থান করেই শিল্পের আনন্দ, কবিতা নান্দনিক। কিন্তু আলেকজান্ডার গটলীব বাউসগার্টেন যখন বলেন, ‘সৌন্দর্যের ছলাকলায় নয়, সংবেদনের শাণিত জাগরণের ভিতরেই নন্দনতত্ত্বের নির্যাস’, তখন প্রশ্ন জাগে, সুন্দরহীন এই ‘শাণিত জাগরণ’ কোন প্রণোদনার দিকে? সে কি পাশবিকতায়? গভীর অর্থে সুন্দরের ছলাকলা ছাড়া ঐক্যের প্রশ্নটিই বৃথা হয়ে যায়। জ্যোছনাতাড়িত আমরা দুই যুবক কোন সংবেদনায় জেগেছিলাম সেদিন? আহ, কী সুন্দর! এই অস্ফুট শব্দের মধ্যে খণ্ডিতের বেদনাই কি পরিস্ফূট হয়নি সেদিন? অতৃপ্তির বেদনা? লালনের মতো অসীম সুন্দরে মিলবার মনোবাঞ্ছা হয়েছিল আমার। আমি গাইছিলাম, বাঞ্ছা করি দেখবো তারে, ক্যামনে সেথা যাইরে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে। আর গাইছিলাম, মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে...। তখন কীটসের মতো আমিও বিশ্বাস করলাম, সুন্দর বেদনা জাগায়। মনে মনে আবৃত্তি করলাম শেলীর কবিতা, Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.
তমসা নদীর তীরে শরবিদ্ধ দুইটি বকপক্ষীকে দেখে এমনই saddest thoght এ আক্রান্ত হয়েছিলেন মহাকবি বাল্মীকি। সেই বেদনা থেকেই তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম শ্লোক তথা কবিতা। কবির বেদনা অসীম। অসীম বেদনা তার অমল আনন্দে মেশে। সেই আনন্দের চরম পরিণতি প্রশান্তির বোধ। আমি তা অনুভব করলাম। মনে হলো, জ্যোছনার সমুদ্রে আমি ভেসে চলেছি। আজ অবগাহন নয়, আজ ভেসে বেড়াবার রাত। মন কেবল সাঁতরাচ্ছে। ধূমপান করছিল রিকশাঅলা। বিড়ির অভাবি গন্ধে আমি কেন বেদনাসিক্ত হলাম না? আমার কোনো অভাব নাই? আজ শুধু পূর্ণ পরিসর? সবকিছু টপকে গেলাম ঐক্য নির্মাণের দিকে। দেখলাম, একটা বড় খেজুর গাছ। ওপরের খানিকটা অংশ লতাপাতা জড়ানো। জ্যোছনার আবছায়ায় মনে হচ্ছে, কালোকেশ জড়ানো কোনো এক রমণীর মাথা। আর খেজুর পাতার লম্বা একটি ডাল নিচের দিকে চিরুনির মতো ঝুলে আছে। স্বতঃপ্রণোদনায় কবিতা এলো। মনে মনে
আওড়ালাম:
হাওয়ায় হাওয়ায় আজ ঘুম নেই
সারা রাত চিরুনি প্রহর।
আজও শেষ করতে পারিনি এই কবিতা। কিন্তু অপূর্ণতার কোনো গ্লানিও নেই। নারীর সিঁথির মতো লম্বা সড়ক ধরে জ্যোছনা দেখতে দেখতে দুই যুবক বাড়ি ফিরলাম। কেবল এক বোধ নাড়া দিল। সকল নৈরাজ্যের অনুভূতির মধ্যেও যে বোধে তাড়িত হয়েছেন ফ্রেডরিখ নীৎশে, Pain is also joy, a curse is also blessing... did you ever say yes to one joy?... all things are in love.
লেখক: কবি
























