কিতাব ও বাস্তবতার পারস্পারিকতা: তাজদিদ ও এহইয়া প্রসঙ্গে

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০১৯

যাকে বলে `তাজদিদ` বা সংস্কার, ইসলামের ইতিহাসে এ-প্রচেষ্টা সুপ্রাচীন। এমন কি ইমাম গাজ্জালিও লেখেন `এহইয়া উলুমুদ্দীন’ অর্থাৎ ‘এহইয়া" বা ধর্মীয় জ্ঞানের পুনরুজ্জীবনের কথা। কোনো শতকই একজন বা একাধিক সংস্কারক বা মুজাদ্দিদ থেকে বঞ্চিত হবে না বলে প্রোফেটিক ট্র্যাডিশনে (হাদিস) উল্লেখ আছে। এটা ইসলামের ভেতরকার গতিশীলতার প্রমাণ। যুগ বা কালের বস্তুগত পরিস্থিতির দাবি ধর্ম অস্বীকার করে না। কারণ গতিশীলতা মানবজাতির সম্মিলিত ফিতরাত বা স্বভাব। সংস্কারের মানে কিন্তু বদলে দেয়া নয়, বরঞ্চ পরিস্থিতি অনুযায়ী ধর্মের তাৎপর্যকে উদঘাটিত করা এবং বিবিধ আচার ও নীতিকে বুঝে নেয়ার চেষ্টা ও তদনুযায়ী কর্ম করা। সংস্কার নমনীয় বা কঠোর দুটোই হতে পারে। বস্তুগত পরিস্থিতি এমন এক আধার যেখানে `ঐশীত্ব` নিজেকে ক্রমাগত আনফোল্ড করতে থাকে। সংস্কারের উদ্দিষ্ট বহুবিধ। একটি বলছি।

প্রতিবেশ-পরিস্থিতি কোনো এক ভাবকে প্রধান করে তুলতে পারে, এবং সে অনুসারে গড়ে উঠতে পারে কোনো এক বিশেষ ধারাও। যেমন, যখন ধর্মের ভেতর দীর্ঘকাল রাজনীতির প্রাবল্য ও বুদ্ধির সর্দারি চলে এবং যখন মানুষ আত্মিক দিকে বেখেয়াল-বেনজর থাকে, তখন হয়তো প্রধান হয়ে উঠবে ধর্মের আধ্যাত্মিক দিক। আবার, যখন মানুষ শুধু মসজিদে জিকির-আজকারে ব্যস্ত তখন হয়তো ধর্মের ভেতরকার সামাজিক-রাজনৈতিক দিকের আলোচনাকে গুরুত্ব সহকারে সামনে আনবেন এক বা একাধিক সংস্কারক। দীর্ঘ বঞ্চনা ধর্মের লড়াকু ব্যাখ্যাকে সামনে আনে। ঔপনিবেশিক শাসনের অভিজ্ঞতা ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বপরিস্থিতির ভেতর `সংস্কারপ্রচেষ্টা` ধর্মের মোয়ামেলাতের ধারণাকে পুনর্ব্যাখ্যায় ব্রতী হয়। বিভিন্ন বিষয়ে ফতোয়ার বিবর্তনের ইতিহাস দেখলেও বোঝা যায়, কী করে বস্তুগত পরিস্থিতির অনুধাবনে ফতোয়া বদলে যায় বা সংস্কৃত হয়, পরিবর্তিত হয় বা সংশোধিত হয়। ধর্ম সবসময়েই এক ডিভাইন রিয়ালিটিকে বিলং করে, ও নিজেকে সম্পৃক্ত করে; এবং ওই ডিভাইন পারপাসকে বুঝবার ক্ষেত্র হচ্ছে বস্তুজগত। ইসলামে ডিভাইন রিয়ালিটি ও ম্যাটেরিয়াল রিয়ালিটি, অর্থাৎ কিতাব ও বাস্তবতা একে অপরকে নির্মাণ করে। কিতাব ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব-মধুর সম্পর্ক না বুঝলে ধর্ম কিংবা জগৎ— কোনটিরই ডিনামিক্স বোঝা যাবে না।

পরিবর্তিত বাস্তবতা— তা হোক সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক বা জ্ঞানগত— কিতাবের অন্যতর অর্থ ও বিবিধ তাৎপর্য ও ইশারা বুঝতে সহায়ক হয়। সেই অর্থে, ‘বাস্তবতা কিতাবকে নির্মাণ করে’ বলেছি, মানে বস্তুগত ও জ্ঞানীয় বাস্তবতা কিতাবের নব নব অর্থকে নির্মাণ করে। কিতাব যেহেতু অনাগত কালের জন্যেও, তাই অবশ্যই এর ভেতরে আছে অর্থের সম্প্রসারণশীলতা, আছে নতুন কালের জন্যে অপেক্ষমাণ নতুন নতুন ইলম ও হিকমাহ। আর কিতাব যে নতুন বাস্তবতা নির্মাণ করতে এসেছে, সেটির অর্থ তো স্পষ্টই। নতুন সভ্যতা নির্মাণের জন্যেই তো কিতাবের আগমন। দ্বীন শব্দের সবগুলো অর্থকে একত্র করে নকিব আল আত্তাস দেখাচ্ছেন, ইসলামের একটি সভ্যতাগত প্রকল্প আছে, দ্বীনের অর্থের ভেতরে সিভিলাইজেশন নির্মাণের বাসনা আছে। মদিনা, তমদ্দুন শব্দগুলোর ভেতরে দ্বীনের ব্যঞ্জনা ধ্বনিত হয়।

যেগুলো আমল বা আকিদা সম্পর্কিত আয়াত নয়, কিন্তু প্রকৃতি বা বিশ্বজগত বা সমাজ সম্পর্কিত— সেই সব আয়াতের ভেতরে ব্যাপক অর্থবোধক শব্দই কোরআনে আল্লাহতায়ালা ব্যবহার করেন। কারণ আরো হাজার বা লক্ষ বছর যদি এই পৃথবীর আয়ু হয়, তখনকার জ্ঞানগত অবস্থায়ও কোরআন সমান প্রাসঙ্গিক থাকবে তার অর্থগত প্রসস্ততার কারণে। কোরআনের প্রথম সম্মানিত শ্রোতাগণ জগৎকে যেভাবে জানতেন, আমরা কিন্তু এখন জগৎকে কিছুটা ভিন্নভাবে জানি। কোরআন থেকেই কিছুদিন আগে কে যেন যুক্তি দিলো, পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরে। পরে অবশ্য তিনি কোরআনেই অন্য তথ্য পেয়ে নিজের মত সংশোধন করলেন। সুতরাং, বিজ্ঞানের তথ্যকে প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার দরকার কোরআন দিয়ে করার প্রয়োজন নাই। বিজ্ঞান বিজ্ঞানের নিয়মেই চলবে। কোরআনের ‘আপাত অর্থের’ বিপরীত তথ্যও যদি বিজ্ঞান হাজির করে, তবে তখনো মুমিন নিজেকে অনিরাপদ ভাবেন না। সে ভাববে, হয় বিজ্ঞান ভুল, না হয় কোরআনের সংশ্লিষ্ট অর্থ আমরা বুঝতে ভুল করছি। সুতরাং মুমিন অধীর হয় না। সে ধৈর্যশীল ও অপেক্ষমান থাকে। কারণ সে এটা মনে করে যে, ইহকালে না জানলেও পরকালে সে সব সঠিক উত্তর জেনে যাবে। তাছাড়া, কোরআন তার অর্থ ধীরে ধীরে, শতাব্দি ও কালপরম্পরা ধরে নিজেকে উন্মোচিত করবে।

প্রকৃতিবিজ্ঞান সম্পর্কে কোরআনের অনেক বক্তব্যই হয়তো আরো কয়েক শতাব্দি পর আমরা নতুনভাবে বুঝবো, বা নতুন অর্থ উদ্ঘাটিত হবে কোরআন থেকেই। আর খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, প্রত্যেক যুগই তার নিজের যুগের সবটুকু জ্ঞান দিয়েই কোরআনকে (বিশেষত, কোরআনে আলোচিত প্রকৃতি, মহাবিশ্ব, রাষ্ট্র, সমাজ ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলো) বুঝতে চেষ্টা করে। আজ আমরা যেভাবে এই প্রসঙ্গগুলো কোরআন থেকে বুঝি, শতবর্ষ পরের মানুষ এটিকে আরেকটু ভিন্নভাবে বুঝবে। তাই তো শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে কোরআন ব্যাখ্যাত হয়ে আসছে। কোরআনের ব্যাখ্যা কিন্তু আল্লাহতায়ালা করে দেন না, মানুষই করে। আর ব্যাখ্যা মাত্রই `প্রকৃত অবস্থা`র পরিপ্রেক্ষিতে সত্য বা মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।

দুই.
এক সুফি বলছেন, ‘কোরআন ব্রহ্মাণ্ডের ঘনীভূত রূপ। আর এই মহাবিশ্ব কোরাআনের সম্প্রসারণ।’ সুরা ফুসিলাত বা হামিম সাজদায় উল্লেখিত আছে: ‘আমি দিকচক্রবালে দেখাতে থাকব আমার নিদর্শনগুলো এবং তোমাদের সত্তায়ও। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণিত না হয়, ইহা সত্য।” বিশ্বপ্রকৃতি, মানবসমাজ ও সভ্যতার গতিধারা, নিজ জৈবিক ও পরমার্থিক সত্তার অনুধাবন আর ‘কিতাব’ অনুধাবন সমার্থক যেনবা। একে অপরের প্রত্যয়নকারী। তাই, হোক তা ‘পুজি’, ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ বা মানবীয় সৃজনশীলতা বা প্রচেষ্টার অন্যকোনো উৎপাদ, তা যেকোনো পরম গ্রন্থেরই অর্থ উন্মোচনে/নির্মাণে সহায়ক। প্রজ্ঞাবান তাকাবে মহাবিশ্ব নামক এই আয়াতের (আয়াত মানে চিহ্ন) দিকে; সে নিদর্শন পরম্পরার পাঠ নেবে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠায়। সে পাঠ করবে যেকোনো পরম কিতাব ‘মানুষের’ চর্চা, সম্ভাবনা ও পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধানের আলোকে, আর অবশ্যই হেদায়াতের আকুল আকাঙ্ক্ষায়।

তিন.
কিছু ব্যাপারে ইসলাম আপনাকে নিজের মতো করে চিন্তার সুযোগ দেয়। যেমন, কোরআনে খুব কম অপরাধের শাস্তিই সরাসরি আছে, তো অন্য বেশিররভাগ অপরাধের শাস্তি আপনি রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন করে তৈরি করতে পারবেন। ইসলামে এটা এলাউড। এটাকে তাজির বলে। দুনিয়াবি প্রয়োজন মেটানোর জন্য বহু কিছু ইনোভেট করতে পারবেন। নিজের ইচ্ছা ও চিন্তা, যেটা প্রত্যক্ষভাবে ধর্মসম্পৃক্ত নয়, প্রয়োগের সুযোগ আছে। আমরা যখন সেকুলার শব্দটি ব্যবহার করি, তা সর্বদা রাষ্ট্র ও ধর্মের বিচ্ছিন্নতা বোঝাতে ব্যবহার করি না। আমরা নিজেরা চিন্তা করলে এমন অনেক ক্ষেত্র বের করতে পারব যেখানে আমাদেরকে নিজেদের আকলের উপর নির্ভর করতে হয়। ইসলাম যখন আপনাকে কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করতে বলে, তার মানে হচ্ছে, ওই ক্ষেত্রে ধর্মের নির্দেশনার প্রয়োজন সীমিত। এই আকল ব্যবহারের পরিসরকে চাইলে সেকুলার পরিসর বলা হয়। তবে মনে রাখি যেন, এই পরিসরও ইসলাম অনুমোদন করে বলে এটা ইসলাম বহির্ভূত নয়। ইসলামে এমন অনেক ইন্টারেস্টিং মোমেন্ট আছে, রসিকজন ছাড়া তা বুঝবে কে!

ইসলামে ইসলামের বরাত ছাড়াও স্বাধীনভাবে দুনিয়াবি বিষয় নিয়ে কল্যাণকামীতাসহ ভাবা ও রায় দেয়ার স্কোপ আছে। ইসলামের `সেকুলার` পরিসর এটিই। তবে মজা হচ্ছে, এই পরিসরটার অনুমতি ইসলামই দেয়। তাই এই পরিসরও ইসলামবহির্ভূত নয়।

চার.
সহিহ ইসলাম বইলা কিছু নাই, এমন কথা কিন্তু আজকাল বেশ জোরেসোরে প্রচারিত। তবে আমি এমন করে বলার পক্ষপাতী নই। বরঞ্চ আমি বলতে চাই, ইসলামের পরিসরের ভেতরেই একাধিক সহিহ-এর ধারণা বিদ্যমান। সহিহত্বের প্রসঙ্গে ইসলামে বহুত্ব রয়েছে। অনেক বিষয়েই একাধিক মতের অনুমোদন আছে ইসলামে। কী কী শর্তে কোনো কিছু `ইসলামি` পদবাচ্য হয় সেটার এলেম থাকলে সহিহ ও অসহিহ বোঝা দুরূহ নয়। তবে মনে রাখা খুব জরুরি যে, ইসলামি ঘরানার চিন্তায় সব কিছুকে ‘ঠিক-বেঠিক’ এই বাইনারিতে দেখা হয় না। এই দুয়ের মধ্যিখানে আছে মুস্তাহাব, মুবাহ, মাকরূহ, শাস্তিযোগ্য, অশাস্তিযোগ্য, প্রশংসনীয়-অপ্রসংশনীয় কাজ, অনর্থক বা নিরর্থক, তাওবাযোগ্য, ক্ষমার্হ’ কাজসহ বিবিধ এরিয়া। ইসলামকে শুধু বিধিবিধানের সমষ্টি মনে করা স্বল্প জ্ঞানের পরিচায়ক। ইসলাম একটি চিন্তা যেমন, তেমন অনুভূতি ও কর্মও। ইসালাম একাধিক চিন্তাকে মূল্য দেয়, আর চূড়ান্ত সত্যের প্রমাণকে `পারলৌকিক` ব্যাপার বলেও মনে করে। যেমন এই হাদিস, ‘কোনো মুজতাহিদ যদি ভুল করে তবে এক সওয়াব, আর শুদ্ধ হলে দুই সওয়াব পাবে।’ উল্লেখ্য, দুজনেই পুরুস্কারযোগ্য, একজন ভুল আরেকজন জন সঠিক হলেও। এই ভুল ও শুদ্ধের চূড়ান্ত হিশাব পারোলৌকি। একই বিষয়ে দুই বিপরীত মত আছে নাসিরউদ্দীন আলবানী ও শায়খ বাযের। তাদের মতভিন্নতা আবার ব্যাপক কিতাবি যুক্তিভিত্তিক, কাউকেই ফেলে দেয়া যায় না। তাহলে কে ভুল, কে সঠিক? সুতরাং, অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে ইহলোকে গ্যাঞ্জাম না পাকিয়ে পরলোকের অপেক্ষা করুন, ও আপনার বিবেচনায় যে বা যেমতগুলো সঠিক তা অনুসরণ করুন। মাথায় রাখবেন, অপর জনও ‘সত্য’ হতে পারে। ইমাম শাফেয়ীর এই উক্তি সর্বজন বিদিত, My opinion is correct but has the potential of being incorrect, and the opinion of my opponent is incorrect but bears the potential of being correct.

ইসলামে চিন্তার স্বীকৃত স্কুলগুলোর (মাজহাব) শত শত বছর ধরে উপস্থিতিই প্রমাণ করে এখানে চিন্তার বহুত্ব আছে, একাধিক সিদ্ধান্ত ও বিবেচনার অনুমোদন আছে। সুন্নি ইসলাম যে ইতিহাস পরম্পরায় এই চারটি মাজহাব গ্রহণযোগ্য হলো তা ইসলামে বাস্তবতাকে ডীল করার বিবিধতাকে স্বীকৃতি দেয়। বস্তুগত পরিস্থিতি তৈরি হয় ক্ষমতা সম্পর্ক দ্বারা, মুসলিম, অমুসলিম বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, শক্তিমান, দুর্বল, সৎ-অসৎ, কম মুত্তাকি-বেশি মুত্তাকি সব শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি, কর্মময়তা বা নিষ্ক্রিয়তা দ্বারা। সুতরাং, ইসলাম যখন বাস্তবতাকে ডীল করে, তখন তা ব্যক্তিক-সামাজিক সবগুলো পরিস্থিতিকেই নজরে রাখে। ফলে রাসুল (সা.) এক জেনাকারী নারীর হদ কায়েম করতে একাধিক পর্যায়ে বিলম্ব করেন, হযরত উমরকে (রা.) দেখি চুরির শাস্তি কিছু কালের জন্যে স্থগিত রাখতে।

পড়ে দেখুন, বনু কুরাইজার হাদিস নামে খ্যাত হাদিসখানা। ইসলামি ডিস্কোর্সে কিছু অনবদ্য মাইক্রো মোমেন্ট আছে, যেগুলোর নিবিড় পাঠ বহু বদ্ধচিন্তা ও রূদ্ধ অনুভব থেকে মুক্তির দিশা দিতে পারে আপনাকে। শুধু ইংগিত দিয়ে রাখি একটা হাদিসের। যেখানে আল্লাহর খুশি বুঝাতে এক বেদুইনের উট খুঁজে পাওয়ার খুশির প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। নিজের হারানো উট খুঁজে পেয়ে মরুচারী মুমিন বলে উঠেছিল, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার রব! তুমি আমার বান্দা!’ খুশিতে আত্মহারা হয়ে সে বলে ফেলেছিল উল্টো কথা, কিন্তু তার হৃদয়ে ঠিকই ছিল তার আব্দিয়াতের অনুভব। এ হাদিস থেকে উদাহারণ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহার, আর মানবীয় আবেগের রূপ ও তার প্রকাশের প্রায়শ ধরণ সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা যায়। স্মরণ করা যেতে পারে, মক্কার প্রায় সমরূপ সাংস্কৃতিক আবহের বিপরীতে মদিনার মাল্টিকালচারাল সমাজের কথা। মদিনার আনসারিরা গান পছন্দ করে বলে নবি এক আনসারির বিয়েতে গান গাইতে জানে এমন কাউকে পাঠানোর কথা বলেছিলেন। ইসলামকে যতটা কঠোর আর নিষ্প্রাণ মনে করা হয়, ইসলাম আসলে অনেক ক্ষেত্রেই তার উল্টা। ইসলামের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক, কিতাবের অর্থ উদ্ধারে ইতিহাস, আচার ও অপরাপর ডিসিপ্লিনারি জ্ঞানের ভূমিকা, ইসলামে চিন্তার পদ্ধতি, ইসলামের বহু মত কীভাবে কিতাব ও চর্চার ইতিহাসের নিরিখেই টিকে আছে ও টিকে থাকে তার টেক্সচুয়াল ও ফিলোসফিকাল আলোচনা, এ কালের জ্ঞানের ভিত্তিতে, আমাদের সমাজে নাই। ইসলাম নিয়ে ভাবতে জানা ও শেখা আমাদের সমাজের `বিকাশ` ও রূপান্তরের জন্য জরুরি।

পাঁচ.
খেজুর গাছের হাদিস বা ‘তাবিরে নাখাল’ নামে পরিচিত নবিজীর (সা.) একটি হাদিস আছে যেখানে তিনি মদিনার আনসারদের খেজুরের কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটাতে নিষেধ করেছেন। দেখা গেল, পরের বছর খেজুরের উৎপাদন কমে গেছে ব্যাপকহারে। তখন তারা নবিকে বাপারটা জানালেন নবি বললেন, ‘জাগতিক বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে অধিক অবগত।’ নবি করিম (সা.) তো স্বীকৃতিই দিলেন যে, জাগতিক বিষয়ের ব্যাখ্যা মানুষের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের উপরই নির্ভর করবে। এ হাদিসকে ইসরার আহমেদ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও গবেষণার স্বকীয়তার ইসলামি স্বীকৃতি হিশেবে দেখেন। হাদিসটি ধর্ম ও বিজ্ঞানের ভিন্ন অস্তিত্ব বা স্বাতন্ত্র্যকেও সামনে আনে বলে ইসরার আহমেদ মনে করেন।

বিশ্বাসে নিষ্ঠাবান হয়েও আত্মিক প্রশান্তি পেতে হযরত ইব্রাহিম (আ.) প্রাণীর মৃত্যুর পর তার পুনঃসৃজন প্রক্রিয়া জানার জন্য প্রশ্ন করেছিলেন স্রষ্টাকে, কি করে স্রষ্টা জীবন্ত করেন মৃতকে, কি করে তিনি প্রাণ সৃজন করেন? স্রষ্টাও কতক পাখির ছিন্নভিন্ন দেহ কয়েকটি পর্বতে রেখে জীবন্ত করে দেখালেন তার মহিমা, মেটালেন ইব্রাহিমের জ্ঞান পিয়াশা। ঈমানদারের হৃদয়ও ব্যাকুল থাকে এই ‘how’ টুকু বুঝবার জন্য। ঈমান শুধু নিশ্চেষ্ট বিশ্বাস নয়, নিশ্চয়তা পাওয়ার আকুলতাও বটে। ঈমানে নিহিত থাকে ‘প্রক্রিয়া’ বুঝবার ও প্রশ্ন করে জানবার বিনীত ব্যাকুলতাও। এই প্রশ্নশীলতা ও `হাউ` বুঝবার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা মানুষের সহজাত জ্ঞানপিপাসার নজির। অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে `জগৎ` বুঝবার মানবিক যে প্রচেষ্টাকে আমরা বিজ্ঞান বলে জানি, ইসলাম তার আলাদা কর্ম-পদ্ধতি স্বীকার করে।