
রফিকুল হক দাদুভাই
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ২৭
প্রকাশিত : আগস্ট ০১, ২০২৫
অভিনয় কুমার দাশ ও আবু বকর সিদ্দিক দুজনই খুব মজার মানুষ। ভীষণ আড্ডাবাজ। অনর্গল কথা বলতে পারেন। অভিনয় দা`র কথায় প্রচুর খিস্তি থাকে, গালিগালাজ ছাড়া তিনি কথাই বলতে পারেন না। তবে তার রচিত গল্পে পশ্চিমবঙ্গের প্রমিত ভাষারীতির পূর্ণ উপস্থিতি। প্রথম প্রথম তিনি জসীম উদদীন পরিষদের আইন-কানুন ততটা বুঝতেন না, ফলে তার গল্প নিয়ে কেউ বিরূপ মন্তব্য করলে তিনি তার নিজের আলোচনার সময় ব্যাখ্যা দিতেন, মাঝে-মধ্যে আলোচকের ওপর ক্ষেপেও যেতেন। এই অবস্থা থেকে তাকে বের করে এনে আমাদের একজন করে তুলতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
তিনি সাংবাদিকতা করতেন। বিভিন্ন কাগজের প্রধান প্রতিবেদিক, বার্তা সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক ইত্যাদি পদে কাজ করেছেন। একদিনের ঘটনা বলি, তখন তিনি মোজাফফর আহমদ পল্টুর একটি অখ্যাত দৈনিক পত্রিকার বার্তা সম্পাদক, সম্ভবত পত্রিকাটির নাম পরিক্রমা। এক ছেলেকে পল্টু সাহেব পাঠিয়েছেন পত্রিকায় চাকরি দেবার জন্য। তিনি তাকে কিছু নিউজপ্রিন্ট শিট হাতে দিয়ে বলেন, যান, একটা `চাকরি চাই` বিজ্ঞাপন লিখে নিয়ে আসেন। অভিনয় দা ছোট-বড় সবাইকে আপনি করে বলতেন এবং কথায় কথায় নাটকির পো, খানকির পো ইত্যাদি বলে গালি দিতেন।
ছেলেটি নিউজপ্রিণ্ট শিটে বিজ্ঞাপন লিখে নিয়ে আসেন। তিনি দেখে বলেন, বায়োডাটা চাইলেন, ছবি তো চাইলেন না। ওই নাটকির পো, ছবি ছাড়া চাকরির দরখাস্ত হয়? যান, পাসপোর্ট সাইজের ছবির কথাটা লেইখা নিয়া আহেন।
ছেলেটি আবার লিখে নিয়ে আসে। সেটি হাতে নিয়ে তিনি পুরো অফিস কাঁপিয়ে হাসতে থাকেন। কারণ ছেলেটি `পাসপোর্ট সাইজের ছবি`র জায়গায় লিখে নিয়ে এসেছিল `পাঁচ ফুট সাইজের ছবি`। আমি সেদিন ঠিক সেই মুহূর্তে ওখানে উপস্থিত ছিলাম, আমাকে কাকরাইলের সেই ফরিদপুর বিল্ডিংয়ের পরিক্রমা অফিসে নিয়ে যান সাংবাদিক দুলাল খান। এটি অবশ্য তার জসীম উদদীন পরিষদে প্রথম আগমনের বেশ কিছু বছর পরের একটি ঘটনা। অভিনয় কুমার দাশের প্রসঙ্গ আসাতে একটু ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে ঘটনাটি বলে ফেললাম। সেই ছেলেটি কিন্তু পরে সাংবাদিক হয়েছিল। হয়তো সে ইচ্ছে করেই অভিনয় কুমার দাশকে ক্ষেপানোর জন্য `পাঁচ ফুট` সাইজের ছবি লিখেছিল। ওই তরুণ সাংবাদিকের নাম স্টালিন সরকার।
আবু বকর সিদ্দিক কবি হিসেবে এরই মধ্যে যথেষ্ঠ নাম করেছেন। বাংলার অধ্যাপক। জসীম উদদীন পরিষদের মতো পাঠশালায় তার আগমণ আমাদের জন্য যথেষ্ঠ আনন্দের ঘটনা। কিন্তু দেখা গেল, তিনি যখন গল্প বা কবিতা পড়েন সেগুলোও সমালোচকদের নিন্দাবাণের বাইরে থাকছে না। কোথাও কোনো অসঙ্গতি, কী ভাষার, কী বক্তব্যের, পেলেই সমালোচকেরা খপ করে ধরে ফেলছেন। তিনি তো বড়ো লেখক হিসেবে প্রথম প্রথম শুধু প্রশংসা শোনার জন্যই কান খাড়া করে রাখতেন, পরে দেখলেন, এরা তো সাংঘাতিক চিজ, কাউকেই ছাড়ে না। এক পর্যায়ে তার স্বভাবসুলভ বিনয়ানুভবতা দিয়ে সব কিছু মেনে নেন এবং আমাদেরই একজন হয়ে ওঠেন।
আবু বকর সিদ্দিক মাঝে মাঝে এলেও অভিনয় কুমার দাশ বেশ কয়েক বছর নিয়মিতই আসতেন। তারা দুজন প্রায়শই সাহিত্যসভা শুরু হওয়ার অনেক আগেই চলে আসতেন, সভার আগে যে অনানুষ্ঠানিক আড্ডা হত, তারা সেটাই বেশি উপভোগ করতেন। আবু বকর সিদ্দিক কলকাতার মানুষের কৃপনতা নিয়ে তার মজার মজার অভিজ্ঞতার কথা বলতেন।
একেবারে প্রথম দিকেই একটি দারুণ গল্প বলেন। অবশ্য ঠিক এই রকম গল্প কলকাতার মানুষদের সম্পর্কে আরো বহুজনের কাছে শুনেছি। তাই তার গল্পটি নিজের গল্প বলে আমার কোনো কালেই বিশ্বাস হয়নি। তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে গল্পটি বলেন। আবু বকর সিদ্দিকের কন্যা বিদিশা পরবর্তী সময়ে এরশাদের প্রেমে পড়েন এবং বিয়ে করেন, সেই সুবাদে তিনি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শ্বশুর।
খুলনার বাগেরহাটে তার জন্ম হলেও জন্মের প্রায় পরপরই পিতার বদলির চাকরির সুবাদে হুগলি এবং বর্ধমানে শৈশবকাল কাটান। পরে দেশে ফিরে আসেন এবং এক পর্যায়ে দেশভাগ হয়ে গেলে তো বাগেরহাটেই সেটেল করেন। দেশভাগের সময় এপারের বহু হিন্দু ওপারে চলে গেছে। এই নির্মম, অনিচ্ছাকৃত, অভিবাসের শিকার হন তার বাল্যকালের এক প্রিয় বন্ধু রতন মণ্ডল।
গল্পটা তার ভাষায়ই বলি। আমার কৈশোরকালের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু রতন মণ্ডল দেশভাগের সময় পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে যায়। আমি যখনই কলকাতায় গিয়েছি ওকে খুঁজেছি কিন্তু কেউ ওদের ঠিকানা দিতে পারেনি। ৩৫ বছর পর ১৯৮২ সালে আমি তার ঠিকানা জোগাড় করতে পারি। আমি তো পাগলের মত কলকাতায় ছুটে যাই আমার কৈশোরকালের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটিকে দেখার জন্য। ওর বাড়ি খুঁজে পেতে বেলা গড়িয়ে গেছে। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল। ও আমাকে দেখেই চিনে ফেললো। জড়িয়ে ধরলো। আমরা দু`বন্ধু দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম।
গল্পের এ পর্যায়ে দুই বন্ধুর মিলনের আনন্দে আমাদের চোখেও আনন্দাশ্রু গড়াতে লাগলো। কিন্তু এর পরের গল্পটা কী হলো তা শুনুন। উঠোনে দুটো মোড়া পেতে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করছি। শৈশব-কৈশোরের কত স্মৃতি। এদিকে ক্ষিদেয় আমার পেট চো চো করছে। ভাবছি গোসল করবো, ফ্রেশ হবো, খাবো-দাবো তারপর গল্প করবো। এর মধ্যে ওর বৌ এলো, তার সঙ্গে পরিচয় হলো। সন্ধ্যা হয় হয়, তখন ও চিৎকার করে ওর বৌকে বলে, কই গো চা টা কিছু দাও, বেলা পড়ে এলো, আমার বন্ধু তো এখন চলে যাবে।
আমার মেজাজ তখন আগুন হয়ে গেল। ছোটোবেলার বন্ধু, এত আবেগ উত্তেজনা নিয়ে ওকে খুঁজে বের করলাম। ভেবেছি কটা দিন ওর ওখানেই থাকবো, সে কি-না বলে, চা টা কিছু দাও, ও তো এখন চলে যাবে। আমি লাফ দিয়ে উঠে ব্যাগটা নিয়ে সোজা বেরিয়ে চলে আসি। আসার সময় কষে ওকে কটা গালি দিতে একটুও ভুল করিনি।
আমরা কবি আবু বকর সিদ্দিকের এই গল্প শুনে হো হো করে হেসে উঠি এবং সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার লোকদের কৃপণতা বিষয়ক গল্প যার ঝুলিতে যা ছিল সব একে একে বের হতে লাগলো। আমার যত দূর মনে পড়ে অভিনয় কুমার দাশের সঙ্গে শিল্পী বীরেন সোম আমাদের কয়েকটা সাহিত্যসভায় এসেছিলেন। তিনি তখন ব্র্যাকে চাকরি করতেন।
জসীম উদদীন পরিষদ যখন পূর্ণ যৌবনের রসে টইটম্বুর তখন একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। নতুন কমিটি হবে। কে হবেন প্রেসিডেন্ট কে হবেন মহাসচিব এই নিয়ে প্রচণ্ড দলাদলি শুরু হলো। একটি পক্ষ পকেটের টাকা দিয়ে প্রচুর নতুন সদস্য ভর্তি করতে শুরু করে। সদস্য সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কয়েক`শ হয়ে যায়। আমিনুল হক আনওয়ার বর্তমান কমিটির সভাপতি এবং সাইদুর রহমান কামরুজ মহাসচিব। কামরুজ ভাইয়ের হঠাৎ খায়েশ হয়েছে তিনি সভাপতি হবেন। সমস্যাটা এখানেই। পরিষদের সভাপতি হবেন একজন সিনিয়র লেখক এটিই সকলের প্রত্যাশা কিন্তু কামরুজ ভাই এমন গো ধরলেন, তাকে কিছুতেই তার অবস্থান থেকে নাড়ানো যাচ্ছে না। দুটি প্যানেল হলো, এক প্যানেলে সাইদুর রহমান কামরুজ সভাপতি, মুস্তফা ফারুক মহাসচিব, অন্য প্যানেলে আমিনুল হক আনওয়ার সভাপতি এবং ডাক্তার জিয়াউদ্দিন মহাসচিব। এসবের মধ্যে বর্ষিয়ান মহাতাব উদ্দিন বলতে শুরু করেন, যে প্যানেলই জেতে আমার কোনো আপত্তি নেই, আমাকে শুধু সহসভাপতি পদটা দেবেন।
অবশেষে এই ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটা মধ্যস্ততা হয়। সাইদুর কামরুজকে সভাপতি এবং ডাক্তার জিয়াউদ্দিনকে মহাসচিব করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ডাক্তার সাহেব মহাসচিব হয়ে যে কাজটি করেন তা হচ্ছে সাহিত্যসভা সবুজ সেনা কিণ্ডারগার্টেন থেকে সরিয়ে তার বৈঠকখানায় নিয়ে আসেন। এতে অবশ্য আমরা সবাই খুব খুশি হয়েছি। তখন সাহিত্যসভার খবরগুলো পত্রিকার, বিশেষ করে ইত্তেফাকের, আজকের ঢাকা কলামটাতে ছাপা হত। সকালে পত্রিকায় এই সংবাদ দেখে অনেকেই চলে আসতেন।
একদিন লম্বা এক ভদ্রলোক, মাথায় ক্যাপ পরা, এসে বৈঠকখানায় বসে আছেন। তখনও কেউ আসেনি। আমি গিয়ে দেখি লোকটি একা একা বসে আছেন। আমাকে দেখে বলেন, আপনি কি সাহিত্যসভায় এসেছেন?
জি।
আপনি কি এখানকার কোনো কর্মকর্তা?
জি না। আমি একজন সদস্য।
তাহলে তো আপনাকে বলে কোনো লাভ নেই।
লাভ আছে, বলেন।
পত্রিকায় দিয়েছেন ৪টায় সভা, এখন তো সোয়া ৪টা বাজে, কেউই তো আসে নাই। এভাবেই চালান নাকি আপনারা?
আপনি সেই জোকটা শুনেন নাই, বাঙালি জন্মের সময় এক ঘণ্টা দেরিতে জন্মায়? আমরা আসলে ৫টায় শুরু করি কিন্তু পত্রিকায় দেই ৪টায়।
এটা একদমই ঠিক নয়। কেউ কেউ তো টাইম মেন্টেইন করে, তাদের কথা আপনাদের বিবেচনায় রাখা উচিত।
জি অবশ্যই। আমিও আপনার দলে।
আমার দলে মানে, আপনি কি ইয়ার্কি করছেন?
ছি ছি কী বলেন। আপনার দলে মানে, সময় মেনে আসার দলে, দেখেন না, আমি মাত্র ১৫ মিনিট লেইট করেছি।
কি লেখেন আপনি?
কবিতা লিখি। আপনি?
আমার নাম রফিকুল হক দাদু ভাই। নাম শুনেছেন?
না, শুনি নাই।
আপনি দাদু ভাইয়ের নাম শুনেন নাই?
ভদ্রলোক অবাক হন এবং কিছুটা রেগেও যান।
রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের নাম শুনেছি। আপনি কি সেই দাদাভাই?
আরে ধ্যাৎ, আমি দাদা ভাই না, দাদু ভাই। ঠিক আছে বাদ দেন। আপনার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। দেখি আর কেউ আসে কিনা।
আস্তে আস্তে অনেকেই আসে এবং আমরা ঠিক ৫টায়ই সাহিত্যসভা শুরু করি। দাদু ভাইকে আমি না চিনলেও আমিনুল হক আনওয়ার, সাঈদ আখন্দ, ডাক্তার জিয়াউদ্দিন, হেলাল মাহমুদ, মুনির হাসান চৌধুরী তারা, সাইদুর রহমান কামরুজসহ অনেকেই চিনেছেন এবং তাকে সকলেই বেশ সম্মান করেছেন।
এরপর হঠাৎ হঠাৎ তিনি এসে হাজির হতেন। এমনি করে ঢাকার অনেক বিখ্যাত কবি, লেখক, ছড়াকার জসীম উদদীন পরিষদে আসতেন। চলবে