চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৪

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৯

তেমন করে আমার কোনো নেশা নেই। মদ সিগরেট গাঁজা কিংবা বিড়ি কোনোটাই নয়। পার্টিতে আড্ডায় কিংবা সেলিব্রেশনে, খুব ঘনিষ্ঠ দু একজন বন্ধুর অনুষঙ্গে, গাঢ় হতে দু এক পেগ চলে। ওইটুকুই। কোনো কিছুর অবলম্বনে কিংবা প্রশ্রয়ে অন্য অনেক কিছুকে ভুলে থাকার নির্ভরতা নেই আমার কোনো কিছুর ওপরেই। আমি বরং মনে রাখতে চাই, সব, পুঙ্খানুপুঙ্খ। আই হ্যাভ আ কমপালশন ট্যু বি অ্যালার্ট অল দ্য টাইম। সবসময় সচেতন থাকতে চাওয়াটা হয়তো আমার অসুখ, অথচ একই সঙ্গে অবচেতনের সাথে আমার সংযোগ খুব নিবিড়। নিজেকে খুব কম মানুষই হয়তো এত ভালো করে জানে, যেমন আমি জানতে চেয়েছি।

সেদিন একজনের বাড়ি গেলাম, আমি ও সুদীপ্ত। যার বাড়ি গেলাম তিনি একজন শিল্পী, বছর চল্লিশের সুদর্শন যুবক। তিনি ওনার স্টুডিও কাম অফিসে আমাদের বসালেন। চা অফার করলেন। আলাপ একটু গভীর হতেই উনি নিজে সিগরেট ধরালেন, তারপর আমাকে ও সুদীপ্তকে একই অন্তরঙ্গতার সাথে সিগরেট অফার করলেন। উনি তো ওসব খান না কোনোকালেই। আমিও না। কিন্তু ভদ্রলোকের অন্তরঙ্গতায় বুঝলাম, তিনি মোটেও বাড়াবাড়ি করেননি, আজকাল একই সোফায় পাশাপাশি বসা পুরুষ ও নারীকে একই সাথে সিগরেট অফার না করাটাই আসলে অভদ্রতা।

আমি নিজে খাই না বলে অন্য কোনো মহিলা যদি সিগরেট মদ বিড়ি বা অন্যান্য নেশায় আসক্ত হন তার মানেই যে ধরে নেয়া যায় যে, সেই মহিলা বদ তা আমি মনে করি না, ঠিক যেরকম শুধু ওই দিয়ে পুরুষ চরিত্র বিচার হয় না, সেরকম। মানুষের নানা ধরনের নির্ভরতা থাকে বৈকি। অনেকে আবার যত না আসক্ত তার থেকে বেশি সেই আসক্তির ছবি শেয়ার করতে ভালোবাসে, জানি না তারা মদ সিগারেট কম্পানির থেকে এর দরুণ কিছু সাবসিডি পান কিনা, যদিও কি পেলে কি দেবেন বা কি দেবেন না সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার।

তবে পাবলিক প্লেসে যারা স্মোক করে, মুখের ওপর ভোঁসভোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ে তাদের ওপর আমি খুব বিরক্ত হই বৈকি। যেমন হই তাদের ওপরেও চার পেগ গলা দিয়ে নামতে না নামতেই যারা মানুষ থেকে অবতার হয়ে যান, তারপর ফোন তুলে বা মেসেজে যাকে যা খুশি বলে দেন বা লিখে ফেলেন, যেন যত অবদমিত কামনা বাসনার সাম্রাজ্যে এন্ট্রি পাশ হলো ওই মদ। খুন বা রেপের আগে অনেকেই তাই ইচ্ছে করেই চাড্ডি মদ গিলে নেন, যাতে ওই সবার আড়ালে লুকিয়ে রাখা `আমি` টাকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন। নেশার মধ্যে সবাই আসলে ওটাই খোঁজে, ভদ্দরলোক থেকে ছোটলোক, শিক্ষিত বিবেকওলা মানুষ থেকে ক্রিমিনাল, একটাই জিনিস চায়। তা হলো, `মুক্তি`, নিজেকে নিজে প্রতিনিয়ত আঘাত করে চলা থেকে, নিজের হাতে নিজে রোজ রোজ পরাস্ত হওয়া থেকে, নিজের দ্বারা নিজে দ্বন্দ্বে আক্রান্ত হওয়া থেকে দুপলকের মুক্তি।

কিছু কিছু মানুষ আবার ভাবেন নেশার মধ্যে একটা স্মার্টনেস আছে, সবকিছু এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়ার মতো স্মার্টনেস, যাবতীয় যন্ত্রণার মুখে লাথি মেরে প্রবল ঔদ্ধত্যের সাথে বিস্মৃতিতে ডুবে যাওয়ার মতো স্মার্টনেস। বেসিক্যালি ওর মধ্যে `স্মার্ট` কিছুই নেই, লাগে না আমার চোখে। বরং নেশায় ডুবে থাকা জুয়াড়ি অপদার্থ মানুষদের আমার দুর্বল মনে হয়, অনেক চেষ্টাতেও ভাগাড়ের অস্পৃশ্য জঞ্জালের ভেতর থেকে মাথা উঁচু করে মানুষের মতো দাঁড়ানোর সামর্থ্য হলো না যাদের।

একথাও আবার সর্বক্ষেত্রে খাটে না জানি। সুদীপ্তর এক দাদু ছিলেন, যাকে ও বেঁটে দাদু বলে ডাকতো। রবীন্দ্রনাথ তাকে শান্তিনিকেতন থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, এমনই ছিল তার দৌরাত্ম্য। পরে ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে নেপালের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। হেন নেশা নেই যা নাকি এই মানুষটার ছিল না। কিন্তু সে মানুষ মোটেও দুর্বল ছিলেন না, বরং অসমসাহসী, হিন্দি সিনেমায় যে ধরনের চরিত্রকে আমরা `ডন` বলে থাকি, তেমনই।

যাই হোক, শুনেছি মেয়েদের নাকি বেঁচে থাকার জন্য একটা অবলম্বন লাগে। বছর খানেক আগেও শহরে কোনো এক সিরিয়ালের ইয়া বড় হোর্ডিং লাগতে দেখেছি এই ক্যাচ লাইনে। সময়টা দ্রুত বদলাচ্ছে, বদলাবে আরও। বাস্তবে আমার যা মনে হয়, মেয়েদের যদি বেঁচে থাকতে অবলম্বন লাগে একটা তো পুরুষের লাগে দশটা। যার যত বেশি অবলম্বন তার তত বেশি ফাঁকি। নেশাও তো ওই একপ্রকার অবলম্বন। আবার নেশা মানেই মদ সিগরেট গাঁজা বিড়ি চরসের নয়, নেশা সম্পর্কের, নেশা শরীরের, নেশা অর্থ যশ খ্যাতির, নেশা ভালোবাসার, নেশা আরো কতকিছুর, যা আজব ও আশ্চর্য।

তাই দিনশেষে, যেটুকুর জন্য নিজেকে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে দেখি, সেটুকুর জন্যই নিজেকে ধিক্কার দেই। কবে একটা মানুষের মতো মানুষ হয়ে দাঁড়াতে পারবো, টানটান মেরুদণ্ড নিয়ে, জানি না। তবু বুঝতে পারি কিছু কিছু জায়গায় এই নির্ভরতা এই নেশা এই অবলম্বন হয়ে পড়ে অনিবার্য। কিছু কিছু জায়গায় মানুষের দুর্বলতা থাকে, সে মানুষ বলেই।

এ সমস্ত কথাই এদেশের সাধারণ গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ু ও সাধারণ আর্থসামাজিক পরিবেশের কথা মাথায় রেখে বলা হলো। যে দেশে সারাদিন রোদ ওঠে না কেবল বরফ পড়ে সে দেশে মদটা যে নিয়ম করে পথ্যের মতো সেবন করতে হয় তা আমি জানি।

লেখক: কবি